কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী ভাবনা ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কণ্ঠ

ভূমিকা

“ধর্ম নয়, মানুষ বড়” এই উক্তিটি শুধু একটি বাক্য নয়, এটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনদর্শনের এক অনন্য প্রকাশ।  তিনি একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও জাতিগত বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তাঁর লেখনীতে ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়, বরং ন্যায়, সাম্য ও মানবতাবাদের প্রতিক হিসেবে গণ্য। বিদ্রোহী কবি নজরুল যখন কলম ধরেছিলেন, সেই সময় ছিল ব্রিটিশদের শাসনকাল, ব্রিটিশরা ভারতীয়দের উপর যেই অত্যাচার নিপীড়ন চালাতো তার উপরেই বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম লিখে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। 

তিনার মনে ছিল বিদ্রোহের আগুন এই আগুনকে প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন কান্ডারীর হুশিয়ার আরো ইত্যাদি। তিনার  প্রত্যেকটি লেখনীতেই জেগে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন তার জন্য তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আমরা জেনে থাকি।

আর সেই সময় সমাজ ছিল হিন্দু মুসলমান বিভাজনের রাজনীতিতে বিষাক্ত।

এমন একটি প্রেক্ষাপটে নজরুল হয়ে উঠলেন এক বিদ্রোহী সুর, যে সুর বলেছিল মানুষই বড়, ধর্ম নয়।

নজরুলের সাহিত্য ও সংগীতে ইসলামের গভীর প্রভাব থাকলেও,  তিনি এতে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তিনি এই ব্রিটিশ শাসন কালকে নিন্দা করে তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা। 

ধর্মের নামে বিভেদ, রক্তপাত বা ঘৃণা এইসব নজরুলের কাছে ধর্মের অপমান ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব, কীভাবে নজরুল তাঁর সাহিত্য, সংগীত ও রাজনৈতিক অবস্থানের মাধ্যমে ইসলামকে মানবিকতার ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, এবং একইসাথে কীভাবে তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের বিপরীতে  মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

নজরুলের ইসলামী পরিচয় ও শিক্ষা

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন  মুসলমান ঘরের ছেলে এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলামিক পড়াশোনা ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে তিনার জন্ম ।

তিনি শৈশবে মক্তবে আরবি, কুরআন, ফিকহ ও হাদীসের পাঠ গ্রহণ করেন। তাঁর বাবাও ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন। ফলে ছোটবেলা থেকেই নজরুল একটি ইসলামি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন।

ছোট বয়সেই নজরুল স্থানীয় লেটো গানে অংশ নেন, যেখানে ধর্মীয় নাটক, ইসলামি ইতিহাস ও সুফি ভাবনার প্রভাব ছিল প্রবল। তিনি কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন,  এবং তিনি মসজিদে আযান দিতেন । পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি কিছুকাল কাদেরিয়া তরিকার একজন পীরের মুরিদ ছিলেন বলেও জানা যায়। তাঁর সাহিত্যজীবনের প্রাথমিক পর্বে নজরুল ইসলামি ইতিহাস, নবী (স.)-এর জীবন, সাহাবিদের আত্মত্যাগ, কারবালার শোকগাথা ইত্যাদি বিষয়কে ঘিরে কবিতা ও গান রচনা করেন যেমন: মহররম, কাবা , তাজ হুযুর, আমার কৈফিয়ত, নবী প্রেমের গান, প্রভৃতি।

তবে নজরুলের ইসলামী চেতনা শুধুমাত্র ধর্মীয় আনুগত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর মধ্যে যে ইসলামি শিক্ষা প্রবাহিত ছিল, তা মানবিকতা, ন্যায়, এবং সাম্যবাদের ধারায় গড়ে উঠেছিল। কোরআনের ‘লা ইকরাহা ফিদ-দীন’ (لا إكراه في الدين), ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই বা ‘ইন্‌নাল্লাহা ইয়ুহিব্বুল্‌ মুকসিতীন’ (আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন) এইসব মূলনীতির প্রতিফলন নজরুলের লেখায় বারবার ফিরে আসে। 

মানবতাবাদী ইসলাম: নজরুলের কণ্ঠে কুরআনিক মূল্যবোধ

নজরুল ইসলাম ধর্মকে মানুষের কল্যাণের জন্য মনে করতেন। তাঁর চোখে ইসলাম ছিল শান্তি, ন্যায়, দয়া আর ভালোবাসার প্রতীক। তিনি বারবার বলেছেন, “ইসলাম যে সত্যের ধর্ম, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের ধর্ম” মানে, ইসলাম কেবল নামাজ-রোজার ধর্ম নয়, বরং এমন এক জীবনব্যবস্থা, যেখানে সব মানুষকে সমান চোখে দেখা হয়।

নজরুল বুঝতেন, কোরআনে কোথাও বলা হয়নি যে, মানুষকে ধর্মের কারণে ঘৃণা করতে হবে। বরং সেখানে বলা হয়েছে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, ন্যায় করতে হবে, কাউকে ছোট করে দেখা যাবে না। নজরুল এই শিক্ষাই তাঁর কবিতা ও গানে তুলে ধরেছেন।

তিনি লিখেছেন:

 “তুমি হিন্দু না মুসলমান? আমি জানি না!

মানুষ বলেই এ-জীবনে আমার পরিচয়।”

এই চারটি লাইনে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন মানুষ পরিচয়টাই আসল, ধর্ম নয়। নজরুল বিশ্বাস করতেন, সবার আগে মানুষ হওয়া দরকার। তিনি নিজে মুসলমান ছিলেন, আল্লাহ ও নবীকে ভালোবাসতেন, কিন্তু তাই বলে তিনি অন্য ধর্মের মানুষকে কোনদিন ঘৃণা করতেন না। তিনি সমস্ত ধর্মের মানুষকে সমান চোখ দিয়ে মূল্যবোধ করেছেন।

সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী অবস্থান

নজরুল ইসলাম সব সময় বলতেন ধর্ম নিয়ে বিভেদ নয়, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা থাকাই সবচেয়ে দরকার। তিনি ছিলেন এমন এক সময়ের কবি, যখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ বাড়ছিল, দাঙ্গা হতো, একে-অপরকে ঘৃণা করত। নজরুল এসব দেখতেন আর খুব কষ্ট পেতেন। তিনি মনে করতেন, এসব ভেদাভেদের জন্য ধর্ম দায়ী নয়, দায়ী মানুষ।

তিনি অনেক কবিতা ও প্রবন্ধে এই বিভেদের বিরুদ্ধে লিখেছেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন:

মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।

মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।

এই কবিতার লাইনে নজরুল বোঝাতে চেয়েছেন—যেন হিন্দু-মুসলমান দুইটি ফুল, একে অপরের পরিপূরক। যেমন চোখে ফুল দেখলে মন আনন্দে ভরে যায়, তেমনি মুসলিম যেন নজরে, আর হিন্দু যেন প্রাণে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন যে, এই দুই সম্প্রদায় একে অপরের অংশ, পরস্পরের শত্রু নয়। নজরুল চাইতেন এই দুই সম্প্রদায় ভালোবাসায় মিলেমিশে থাকুক।

তিনি অনেকবার বলেছেন, যারা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে, ঘৃণা ছড়ায়, তারা সত্যিকারের ধর্মীয় মানুষ নয়। তাঁর ভাষায়:

“যেদিন হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে দাঁড়াবে,

সেইদিন ভারত নিজের মর্যাদা ফিরে পাবে।”

নজরুল শুধু মুসলমানদের পক্ষেই লেখেননি। তিনি হিন্দুদের প্রতিও সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, দুর্গা ও কালীকে নিয়ে কবিতা ও গান। আবার তিনি একইভাবে লিখেছেন নবী মুহাম্মদ (স.), কারবালার শহীদদের, ও ইসলামের ইতিহাস নিয়ে।

নজরুল বারবার বলেছেন, ধর্ম হলো প্রেম ও শান্তির পথ। তিনি বলেন:

“ধর্মের নামে যারা হানাহানি করে, তারা আসলে ধর্মের শত্রু।”

নজরুলের লেখায় দ্বৈততা: ইসলামি ভাবনা ও সর্বধর্ম সমন্বয়

নজরুল ইসলাম মুসলমান ছিলেন, তাই তাঁর অনেক লেখায় ইসলামি ভাবনা দেখা যায়। তিনি আল্লাহ, নবী মুহাম্মদ (সা.), কোরআন, সাহাবিদের জীবনের কথা অনেক কবিতা ও গানে লিখেছেন। তিনি হাম্দ (আল্লাহর প্রশংসা), নাত (নবীপ্রশংসা), মিলাদ ও মহরম নিয়ে গান লিখেছেন। এই সব লেখায় তিনি মুসলমানদের ইতিহাস, কষ্ট, এবং আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরেছেন।

তবে শুধু ইসলাম নয়, নজরুল হিন্দু ধর্মকেও  সম্মান করতেন। তিনি অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন যেখানে হিন্দু দেবদেবীর নাম এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর বিখ্যাত কবিতা “মোহররম” মুসলমানদের কারবালা যুদ্ধ নিয়ে, আর “আনন্দময়ীর আগমনে” দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে রচিত।

নজরুলের এই লেখাগুলো আমাদের শেখায়, আমরা আলাদা ধর্মের হতে পারি, কিন্তু আমাদের ভিতরে যে ভালোবাসা, মানবতা, তা এক। তাঁর লেখায় দেখা যায়, তিনি মুসলমানদের অধিকার ও দুঃখ নিয়ে লিখেছেন, আবার হিন্দুদের দেবতাকে শ্রদ্ধাও জানিয়েছেন। এই দ্বৈততা কোনো দ্বন্দ্ব নয়, বরং এটি ছিল তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ সব মানুষের জন্য, সব ধর্মের প্রতি।

উপসংহার

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের শেখিয়েছেন, ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। তিনি তার কবিতা ও গানে বারবার বলেছে, হিন্দু-মুসলমান একসাথে থাকতে পারে, থাকতে হবে। তাঁর অনেক লেখা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ধর্মের নামে বিভাজন ভুল, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বই সঠিক পথ।

আজকের সময়ে, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে, আমাদের একত্রে মিলেমিশে বাস করার খুবই দরকার। ভাগাভাগি নয়, একতা দরকার। কারণ একতা ছাড়া শান্তি আসবে না, উন্নতি হবে না। কাজী নজরুল যেমন কবিতায় বলেছেন:

 মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।

মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।

এই কথা আমাদের শিখায়, আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। তাই আমাদের সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে একসাথে ভালোবাসা ও সম্মানের সাথে থাকতে হবে।

আজ যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ায়, বা ধর্মের নামে হিংসা হয়, তখন নজরুলের শিক্ষা “ধর্ম নয়, মানুষ বড়”—এই কথাটি সবচেয়ে বেশি দরকার। স্কুল, কলেজ, পরিবার সব জায়গায় এই শিক্ষা পৌঁছানো দরকার।





Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter