মদিনার রাজনীতি ও বানু কুরায়যা: চুক্তিভঙ্গের পরিণতি ও ইসলামী রাষ্ট্রের ন্যায়নীতি

ভূমিকা :

ইসলামী ইতিহাসে “বানু কুরায়যা” অবরোধ একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়, যা কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, অঙ্গীকারের গুরুত্ব এবং রাষ্ট্রদ্রোহের পরিণতি সম্পর্কে এক গভীর শিক্ষা বহন করে। এই ঘটনাটি সংঘটিত হয় ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে, খন্দকের যুদ্ধ (Battle of the Trench) সমাপ্তির পরপরই। নবী মুহাম্মদ -এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম সমাজ তখন মদিনায় নিজেদের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত ছিল। এই সময়ে ইহুদি গোত্র বানু কুরায়যা মুসলমানদের সঙ্গে করা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও চুক্তির ভিত্তি :

বানু কুরায়যা ছিল মদিনায় বসবাসরত তিনটি প্রধান ইহুদি গোত্রের একটি, অন্য দুটি ছিল বানু নাদির ও বানু কায়নুকা’। তারা মূলত ইসরাইলীয় বংশোদ্ভূত, এবং মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী, তাদের ছিল প্রায় দেড় হাজার তরবারি, দুই হাজার বর্শা, তিন শতাধিক বর্ম ও পাঁচ শতাধিক ঢাল — অর্থাৎ তারা ছিল একটি সশস্ত্র ও প্রভাবশালী জাতি। তাদেরকে “আহলুল হালকা” বা “অস্ত্রধারী জনগোষ্ঠী” হিসেবেও অভিহিত করা হতো।

নবী করিম মদিনায় হিজরতের পর স্থানীয় মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থানের জন্য একটি ঐতিহাসিক দলিল প্রণয়ন করেন, যা ‘মদিনা সনদ’ (Constitution of Medina) নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল— সকল পক্ষ একে অপরের শত্রুদের সহায়তা করবে না, এবং মদিনা যদি বাইরের আক্রমণের শিকার হয়, তবে সবাই একযোগে তা প্রতিরোধ করবে। বানু কুরায়যাও এই চুক্তির অংশ ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিরোধের কারণে তাদের অন্তরে নবী ও মুসলিম সমাজের প্রতি বিরাগ জন্ম নেয়।

চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতার সূচনা :

খন্দকের যুদ্ধের সময়, যখন কুরায়শ ও গাতাফান উপজাতিসহ প্রায় ১০,০০০ সৈন্য মদিনা আক্রমণ করে, তখন মুসলমানরা মদিনার উত্তরাংশে প্রতিরক্ষা খন্দক খনন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রথমদিকে বানু কুরায়যা নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, এমনকি মুসলমানদের কিছু নির্মাণ সরঞ্জামও ধার দেয়। কিন্তু খায়বারের ইহুদি নেতা হুয়াইয়্য ইবনে আখতাব তাদেরকে প্ররোচিত করে বলেন, মুহাম্মদ এবার পরাজিত হবেন। ফলে বানু কুরায়যা গোপনে কুরায়শদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং মদিনা সনদের শর্ত ভঙ্গ করে বসে।

এই বিশ্বাসঘাতকতা মুসলিম সমাজের জন্য ছিল অতি বিপজ্জনক, কারণ বানু কুরায়যার অবস্থান ছিল মদিনার দক্ষিণে, যেখানে মুসলমানদের নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। তাদের আক্রমণ মানে মুসলমানদের পেছন দিক থেকে ছুরিকাঘাত করা। তাই নবী নিজেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

অবরোধের সূচনা ও সামরিক কৌশল :

খন্দকের যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) নবী -এর কাছে এসে আদেশ দেন,

“আপনি কি অস্ত্র রেখেছেন? আমরা এখনো রাখিনি। এখনই বের হন বানু কুরায়যার দিকে।” (সহিহ বুখারি, হাদীস ৪১১৯) এই নির্দেশ অনুযায়ী, নবী  ঘোষণা করেন:

“তোমাদের কেউ আসরের নামাজ আদায় করবে না, যতক্ষণ না তোমরা বানু কুরায়যার এলাকায় পৌঁছাও।”

প্রায় তিন হাজার মুসলিম সৈন্য বানু কুরায়যার দুর্গ ঘিরে ২৫ দিনব্যাপী অবরোধ শুরু করে। বানু কুরায়যার যোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় থেকে সাত শত। মুসলমানরা দুর্গ আক্রমণ করেনি, বরং চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল যাতে কোনো সরবরাহ ভিতরে যেতে না পারে। ধীরে ধীরে খাদ্য, পানি ও রসদের ঘাটতি দেখা দেয়।

অবরোধ চলাকালীন মুসলমানরা রাতভর তাকবির ধ্বনি উচ্চারণ করে, মশাল জ্বেলে পাহারা দিত, যা শত্রুদের মধ্যে গভীর ভয় সৃষ্টি করে। এই মানসিক চাপ ও ক্ষুধা-তৃষ্ণা অবশেষে তাদের মনোবল ভেঙে দেয়। নেতা কা‘ব ইবনে আসাদ প্রথমে প্রতিরোধে অনড় থাকলেও পরে বুঝতে পারেন যে আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ।

আত্মসমর্পণ ও সা‘দ ইবনে মু‘আযের সালিশ :

অবরোধ শেষে বানু কুরায়যা আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু তারা অনুরোধ জানায় যে তাদের বিচার করবেন আওস গোত্রের নেতা সা‘দ ইবনে মু‘আয (রা.), যিনি তাদের পুরনো মিত্র ছিলেন। নবী তাদের অনুরোধ মঞ্জুর করেন। সা‘দ (রা.) তখন খন্দকের যুদ্ধে আহত ছিলেন, কিন্তু ন্যায়বিচারের আহ্বানে সাড়া দেন। তিনি তাওরাত ও ইসলামী ন্যায়নীতির আলোকে সিদ্ধান্ত দেন: যোদ্ধাদের মৃত্যুদণ্ড, নারী ও শিশুদের বন্দি করা, এবং সম্পদ রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা করা হবে। নবী এই রায় শুনে বলেন, “তুমি আল্লাহর বিধান অনুযায়ীই বিচার করেছ।” (সহিহ বুখারি) এই রায় ছিল একদিকে চুক্তিভঙ্গের ন্যায্য প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার অপরিহার্য ব্যবস্থা।

শাস্তি কার্যকর ও ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়া :

ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম, আল-ওয়াকিদি ও ইবনে সা‘দের বর্ণনায় দেখা যায়, যোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে—কেউ বলেন ৪০০, কেউ বলেন ৭০০ বা ৯০০ জন পর্যন্ত পুরুষ যোদ্ধা নিহত হন। নারীরা ও শিশুরা বন্দি হয়, এবং তাদের সম্পদ মুসলমানদের হাতে আসে।

কুরআনে এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে—

“আর তিনি আহলে কিতাবদের মধ্যে যাদের শত্রুদের সহায়তা করেছিল, তাদের দুর্গ থেকে নামিয়ে আনলেন, এবং তাদের অন্তরে ভয় নিক্ষেপ করলেন—তাদের একদলকে তোমরা হত্যা করলে এবং একদলকে বন্দি করলে।”(সূরা আহযাব: আয়াত ২৬)

এরপর বলা হয়েছে—

“আর তিনি তোমাদেরকে তাদের ভূমি, ঘরবাড়ি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বানালেন।” (সূরা আহযাব: আয়াত ২৭)

এভাবে বানু কুরায়যার অবরোধ শেষ হয় ইসলামী রাষ্ট্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে।

সা‘দ ইবনে মু‘আয (রা.)-এর শাহাদাত ও ইসলামী ন্যায়বিচারের প্রতীক :

রায় ঘোষণার কিছু পরেই সা‘দ ইবনে মু‘আয (রা.)-এর পুরনো ক্ষত পুনরায় ফেটে যায় এবং তিনি শাহাদত বরণ করেন। নবী তাঁর মৃত্যুতে বলেন, “সা‘দ ইবনে মু‘আযের মৃত্যুর সময় আর রহমানের আরশ কেঁপে উঠেছে।” এই উক্তি কেবল একজন সাহাবির মর্যাদা নয়, বরং ন্যায় ও সততার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। তিনি ইসলামী বিচারব্যবস্থায় এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যেখানে আবেগ নয়, বরং ন্যায় ও চুক্তির প্রতি অঙ্গীকারই সর্বোচ্চ স্থান পায়।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব :

বানু কুরায়যার অবরোধ ও তার পরিণতি মদিনার রাজনৈতিক বাস্তবতাকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দেয়। ইহুদি গোত্রগুলোর প্রভাব শেষ হয়ে যায়, এবং নবী -এর নেতৃত্বে ইসলামী রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হয়। চুক্তিভঙ্গ ও রাষ্ট্রদ্রোহের বিরুদ্ধে যে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছিল, তা ভবিষ্যৎ মুসলিম প্রশাসনের জন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

মুসলমানদের জন্য এটি ছিল একটি নৈতিক শিক্ষা—বিশ্বাস, আনুগত্য ও চুক্তিপালনই সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। একই সঙ্গে, এই ঘটনার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের শাসনব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, তার বাস্তব প্রয়োগও প্রতিফলিত হয়।

উপসংহার:

বানু কুরায়যা অবরোধ ইসলামী ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে—যে সমাজ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে, তার অস্তিত্ব স্থায়ী হয় না। নবী মুহাম্মদ এই ঘটনায় প্রতিশোধ নয়, বরং ন্যায় ও শৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সা‘দ ইবনে মু‘আয (রা.)-এর রায় চিরকাল ইসলামী ন্যায়বিচারের আলোচনায় এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে।

এই ঘটনা ইসলামী সভ্যতার সূচনালগ্নে প্রতিষ্ঠিত করে—ন্যায়বিচার, চুক্তিপালন ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই এক সুস্থ সমাজের ভিত্তি। 



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter