জুলহিজ্জার প্রথম দশ দিন: বরকত, ফজিলত ও আমলের সোনালি সুযোগ
ভূমিকা
ইসলামের বরকতময় মাসসমূহের মধ্যে জিলহজ্জ একটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ মাস। জুলহিজ্জার ৮ম দিনে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়, যা ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ পালনকারীদের জন্য বাধ্যতামূলক। ৯ম দিনটি হলো আরাফার দিন—যে দিনে ইসলাম ধর্ম সম্পূর্ণ হয়। এবং এই দিনগুলিতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি করে , এবং রোযাকারীদের আগের ও পরের বছরের গুনাহ মোচন করে দেওয়া হয়। এই মাসের প্রথম দশ দিন ইসলামের দৃষ্টিতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআনে এর শপথ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
وَالْفَجْرِ , وَلَيَالٍ عَشْرٍ
“শপথ ফজরের, এবং শপথ দশ রজনির।” (সূরা ফজর: ১-২)
তাফসিরবিদগণের মতে, এই দশ রজনি বলতে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ রাত বোঝানো হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.), মুজাহিদ (রহ.), এবং ইবনে যুবায়ের (রহ.) প্রমুখ মনীষীগণ এ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন, এবং ইবনে কাসির (রহ.) এটিকে বিশুদ্ধতর মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
একটি পবিত্র বৈপরীত্য
জুলহিজ্জার প্রথম দশ দিন মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার এক পবিত্র বৈপরীত্য তৈরি করে। এই দিনগুলো বহু কারণে পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ—এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ত্যাগের গভীর ধারণা। এ সময়ই হজের আনুষ্ঠানিকতায় মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের নিদর্শনগুলোকে সম্মান জানানো হয়। ইব্রাহিম (আঃ)-এর তাঁর পুত্রকে কুরবান করার প্রস্তুতি উদীয়ার (কুরবানি) মাধ্যমে স্মরণ করা হয়, আর হাজরার নিজের ও তাঁর শিশুর পিতার সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া, মরুর তপ্ত ও বিরান পরিবেশে, সায়ী (সাফা ও মারওয়ার মধ্যে দৌড়ানো) দ্বারা স্মরণীয় হয়ে আছে।
আল্লাহ ত্যাগের আদেশ দেন। ইব্রাহিম (আঃ) ও হাজরা সেই আদেশ মান্য করেন, এবং গভীর বিশ্বাস ও আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তাই এই মহান দিনগুলোতে আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নিজেদের প্রশ্ন করার: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমি কী ত্যাগ করতে প্রস্তুত? এই পবিত্র উপহারকে গ্রহণ করতে আমি কত দূর যেতে রাজি?
সহজ ত্যাগ বনাম প্রকৃত আনুগত্য
যদিও আমাদের জন্য অনেক বড় পুরস্কার নির্ধারিত, এই দিনগুলো অনেক সময় আমাদের অগোচরেই কেটে যায়। এর জন্য দোষ দেওয়া যেতে পারে মানব স্বভাবের জড়তাকে—আমরা সাধারণত কোনো কাজ করি বাধ্য হলে, বা যদি তা সুবিধাজনক হয়। আমরা তখনই কাজ করি, যখন তা আমাদের পরিকল্পনার সঙ্গে মিলে যায়, আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য ভঙ্গ করে না, এবং তেমন খরচও লাগে না।
কিন্তু জুলহিজ্জার এই প্রথম দশ দিন আমাদের আত্মসমর্পণের ডাক দিয়ে সেই স্বভাবিক প্রতিক্রিয়াকে চুপিসারে বাধা দেয়। প্রকৃত ত্যাগ কঠিন। তা অস্বস্তিকর, কখনো ব্যথাদায়কও। এটি প্রায়ই সুবিধার বিপরীতে অবস্থান করে এবং বিরলই ঘটে যখন আমরা প্রস্তুত থাকি। তা আমাদের থেকে কর্ম চায় যখন আমাদের শক্তি কম থাকে, যখন পরিবেশ অনুকূল নয়। দান করা সহজ যখন আমরা দান করার মুডে থাকি, পরিকল্পনা করে রেখেছি, বা সমাজ একত্রিত হয়ে ফান্ডরেইজ করে। কিন্তু যদি কোনো অভাবী অপ্রত্যাশিতভাবে দরজায় আসে—একটি মিটিংয়ের মাঝখানে, রান্না করার সময়, কিংবা সারাদিনের ক্লান্তির পর বিশ্রাম নিতে বসা মাত্র? সুযোগ সব সময় সুবিধাজনক হয় না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় রোযা রাখা, অন্যরা ঘুমালে উঠে ইবাদত করা, কিংবা কষ্ট পাওয়ার পরও ক্ষমা করে দেওয়া—এসবই প্রকৃত ত্যাগের চিহ্ন। এগুলো সেইসব মানুষের কাজ, যারা সত্যিই নিবেদিতপ্রাণ।
মুহূর্তকে গ্রহণ করা
আল্লাহ আমাদের নিকট সৎকর্মের সুযোগ পাঠান যখন তিনি উপযুক্ত মনে করেন—এটি পরীক্ষার জন্য, কে উত্তম আমল করে তা দেখার জন্য। জুলহিজ্জার এই দশ দিন তারই একটি নিদর্শন—আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার, যখন অন্যরা পিছিয়ে পড়ে তখন এগিয়ে যাওয়ার, এবং বছরের শ্রেষ্ঠ আমলগুলো করার এক বিরল সুযোগ।
এই পবিত্র দিনগুলো যখন অতিবাহিত হচ্ছে, তখন সেগুলিকে সম্মান ও ভক্তিভরে গ্রহণ করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন:“যিনি আমাকে সবকিছু দিয়েছেন, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য আমি কী ত্যাগ করতে পারি?” এই দশ দিন শুধু একটি অনুগ্রহময় সুযোগ নয় এগুলি আমাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে: কেউ না দেখলে আমরা আসলে কে, কেউ না চাইলে আমরা কীকে মূল্য দিই, আর আল্লাহ নীরবে ডাক দিলে আমরা কিভাবে সাড়া দিই। তাই আপনি প্রকাশ্যে কাজ করুন বা নির্জনে, করুন সত্যিকারের আন্তরিকতা ও ত্যাগ নিয়ে। যেমন হজের সময় হাজীরা ঘোষণা করেন: “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক—আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির।”
দশ দিনের ফযীলত ও গুরুত্ব
বরকত ও ফযীলতে মোড়ানো জুলহিজ্জা মাসের এই দশটি দিন, যদি কোনো মুমিন ব্যাক্তি এই মাসে সাফল্য অর্জন করতে চাই তাহলে তাকে সেই সব জিনিসগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে যা তাকে সাফল্য হতে বাধা দেয়। হাদিসে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দিন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, এমন কোন দিন নেই যার আমল জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হবে। প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করা থেকেও কি অধিক প্রিয়? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বললেন, হাঁ জিহাদ করা থেকেও অধিক প্রিয় তবে যদি এমন হয় যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে বের হল এবং এর কোনো কিছুই ফেরত নিয়ে এল না। এছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (ﷺ) বলেন: “এই দশ দিনে নেক আমলের তুলনা চলে না। তাই তোমরা এ সময়ে অধিক পরিমাণে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ) পাঠ করো।”(মুসনাদ আহমদ)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَات
“যাতে তারা নিজেদের উপকার লাভ করতে পারে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, তিনি যেসব চতুষ্পদ জন্তু তাদেরকে রিজিক দিয়েছেন সেগুলোর ওপর।”(সূরা হজ: ২৮)
ইমাম বুখারি (রহ.) উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন বোঝানো হয়েছে।”
জন্য একটি অতুলনীয় সুযোগ। তবে, জীবনের অনেক কিছুর মতো, এগুলোও ত্যাগ ছাড়া আসে না। যেসব জিনিস সত্যিকারের মূল্যবান, তা অর্জনে প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম, সংকল্প, এবং ত্যাগ। এমনকি যখন পুরস্কার মহান, সময় উপযুক্ত, ও উপায় সহজলভ্য—তবুও আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ত্যাগ করা সেইসব জিনিস যা আমরা ভালোবাসি, কামনা করি, বা নিজেদের প্রাপ্য মনে করি। আরাম, স্বাধীনতা, সময়, বা পছন্দ হোক না কেন, আমরা সাফল্যের
আরাফা ও কুরবানির দিনের বিশেষ ফজিলত
এই দশ দিনের মধ্যে আরাফার দিন (৯ জিলহজ্জ) এবং কুরবানির দিন (১০ জিলহজ্জ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “আরাফা দিনের চেয়ে বড় কোনো দিন নেই, যেদিন আল্লাহ বেশি সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন।”(সহিহ মুসলিম)
আরাফা দিবসে রোজার ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (ﷺ) বলেন: “আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, আরাফার রোজা আগের এক বছর এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফের কারণ হবে।” (সহিহ মুসলিম)
কুরবানির দিন সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো কুরবানির দিন, এরপরের দিন।” (আবু দাউদ) জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনন্য কারণ, এ সময়: নামাজ, রোজা, সদকা, হজ, ও কুরবানি করা। এই সকল ইবাদত একসঙ্গে পালন করা সম্ভব হয়, যা অন্য কোনো সময়ের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।
উপসংহার
জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন শুধু সময় নয়, এটি এক মহান নেয়ামত। এ দশ দিনে নেক আমল করে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বিরল সুযোগ পাই। তাই আমাদের উচিত এ দিনগুলোতে বেশি বেশি: নামাজ আদায় করা, নফল রোজা রাখা, কুরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে মনোযোগী হওয়া দান সদকা করা, তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ পড়া। এই বরকতময় দিনগুলো যেন আমাদের জীবনে পরিবর্তনের বার্তা বয়ে আনে—সেটিই হোক আমাদের প্রার্থনা।