মুসলিম যুবসমাজ ও অনলাইন সংস্কৃতি: অশ্লীল রচনা, গেমিং, ডোপামিন-অর্থনীতি
ভূমিকা
বিশ্ব এখন সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল একটি যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন অনলাইন বিনোদন মাধ্যম যুবসমাজের দৈনন্দিন জীবন যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং স্মার্টফোনের বিস্তারের কারণে পর্নোগ্রাফি, ভিডিও গেম, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি প্রায় সীমাহীনভাবে উপলব্ধ। এসব বিষয়বস্তুতে অতিরিক্ত আকৃষ্ট হওয়া সহজ এবং মনকে দ্রুত পুরস্কৃত করে, পরবর্তীতে এক ধরনের “ডোপামিন অর্থনীতি” সৃষ্টি করে, যা আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্ট্যানফোর্ডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আধুনিক প্রজন্মের আসক্তির প্রাথমিক উৎস হলো ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যম। যেমন এক সংবাদ অনুসারে, সমকালীন সমাজের অতীতের ন্যূনতম জীবনের চেয়ে অনেক বেশি ঐশ্বর্যমণ্ডিত অবস্থায় থাকার কারণে আমাদের সকলকেই ডোপামিন-নির্ভর আসক্তির শিকার হতে হয় এবং “আজকের দিনে আসক্তির পদার্থ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমই বিবেচিত”।
মুসলিম যুবসমাজও এই বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে বঞ্চিত নয়। আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে যে ১৬–২২ বছর বয়সী মুসলিম তরুণদের মধ্যে ৬১% মানুষ পর্নোগ্রাফিতে প্রবেশের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১১–১৪ বছর বয়সের সকল মেসেজিং কলের ১০০% পর্নোগ্রাফি এবং মাস্টারবেশনের আসক্তি সংক্রান্ত অভিযোগ ছিল। অর্থাৎ প্রথাগত নৈতিক বাধা সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই অনলাইন সংস্কৃতি বিশেষ করে তরুণদের মনোযোগ, পরিচয় ও নৈতিক মানদণ্ডকে প্রভাবিত করছে। এই প্রবন্ধে আমরা পর্নোগ্রাফি, গেমিং, সামাজিক মাধ্যম ইত্যাদির যৌথ বাস্তবতা বিশ্লেষণ করবো; মনস্তাত্ত্বিক ও স্নায়ুবিজ্ঞানের আলোকে আসক্তির কারণ ও পরিণতি বুঝবো; এবং ইসলামী শিক্ষাবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কীভাবে শৃঙ্খলা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলন দ্বারা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায় তা আলোচনা করবো। এতে অন্যান্য ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিবেশেও যে সমস্যাগুলো বিদ্যমান, সেগুলোর সাথে তুলনামূলক দিকটিও সংক্ষেপে উল্লেখ করা হবে।
অনলাইন পর্নোগ্রাফি, গেমিং ও যুবসমাজের চিত্র
ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি ও ভার্চুয়াল গেমিং এখন অত্যন্ত সহজলভ্য। গুরুতর গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্কদের বিষয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনলাইন ট্রাফিক পর্নোগ্রাফির জন্য নিয়োজিত। ৯৩% পরিক্ষিত কিশোর ছেলে ও ৬২% মেয়ে জুনিয়র বয়সেই পর্ন দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ভারত, বাংলাদেশসহ মুসলিম-সংখ্যাবেশিষ্ট দেশে এই প্রবণতা কিছুটা চুপচাপ থাকলেও, গবেষণা ও জরিপ তথ্য স্পষ্ট করে যে মুসলিম যুবক-যুবতীদের মধ্যেও পর্নোগ্রাফি চর্চা বিস্তৃত। উদাহরণস্বরূপ, কানাডিয়ান একটি সমীক্ষায় পাওয়া গেছে ১৬–২২ বছর বয়সী মুসলিম তরুণদের মধ্যে প্রায় ৫৯% নিয়মিত পর্ন দেখেন। অর্থাৎ, অন্যান্য সমাজের মতো মুসলিম সমাজেও পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মাঝে পর্ন ব্যবহার কম হলেও (১৭% মহিলা থেকে ৮৩% পুরুষ) এই প্রবণতা লক্ষণীয়। এ ছাড়া ভিডিও গেম বা স্ট্রিমিং ভিডিও দেখাও তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়: উত্তরপূর্ব এশিয়ার মত অঞ্চলে ছেলেরা গেম খেলায় আবিষ্ট থাকে, যেখানে পাকিস্তানেও ও যুবকদের জন্য গেমিং একটি সাধারণ বিনোদন মাধ্যম। মুসলিম পরিবারগুলোতে সচরাচর সন্তানদের জিহ্বা, দৃষ্টি ও হাতে বাঁধাধরা থাকে, কিন্তু গোপনপর্যায়েই অনলাইন জগতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েই আধুনিক যুবসমাজ বহুবার শৃঙ্গার ও উত্তেজনার উৎস হিসেবে পর্ন এবং ভৌতিক গেমের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এই চাহিদাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না, কারণ ইন্টারনেট আমাদের দৈনন্দিন কর্মের অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। প্রাচীন যুগে যৌনসঙ্গ আসক্তি কিংবা অতিরিক্ত খেলাধুলো ধুম্মপানের মত বিবেচিত হতো, এখন তা ডিজিটাল বিনোদনের অভ্যাসে রূপ নিয়েছে। পর্নোগ্রাফি তরুণদের মনোভাব ও সম্পর্কের প্রতি ভুল ধারণা তৈরি করে: এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে পর্ন দেখার অভ্যাস স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের একটি বিকৃত মানসিকতার জন্ম দিতে পারে, যৌনতা ও বিবাহ সম্পর্কে অশালীন ও বিকৃত বিশ্বাস প্রচার করে। উদাহরণস্বরূপ, পর্ন দেখার কারণে অনেক যুবক শরীরচর্চার বা স্পর্শকাতরতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় অস্বাভাবিক রূপ নেয়, স্ত্রী-স্বামীর সম্পর্কের প্রকৃত স্বাদ বুঝতে পারে না এবং পরিণামে বাস্তব জীবনের যৌন সম্পর্ককে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করে। কুখ্যাত গবেষক ডেভিড পেরি লক্ষ্য করেন, পর্ন দেখতে দেখতে যুবকদের মধ্যে অল্পবয়সেই উত্তেজক ও সহিংস দৃশ্যে আসক্তি তৈরী হয়, যা সহমর্মিতা ও হিংসার প্রতি সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে মুসলিম যুবকেরা নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধ জানলেও প্রলোভন সামলাতে ব্যর্থ হয় এবং সমাজের শালীনতা নীতি হ্রাস পায়।
এছাড়া ভার্চুয়াল গেমিংও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন ঘণ্টা-ঘণ্টা গেম চালানোর ফলে যুবকদের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, মনোযোগ ছিটকে যায়, ও শিক্ষাবর্ষহীনতা দেখা দেয়। গেমিং এ আগ্রহের মধ্যে অত্যধিক পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রবণতা আছে, যা মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্রকে সক্রিয় করে। উদাহরণস্বরূপ, স্ট্যানফোর্ডের গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে বিশেষ গেমের খেলায় পুরস্কার কেন্দ্রে (নিউক্লিয়াস অ্যাকুম্বেন্স, অ্যামিগডালা, অর্বিটোফ্রন্টাল কর্টেক্স) প্রচণ্ড সক্রিয়তা বাড়ে, বিশেষ করে পুরুষের ক্ষেত্রে। দ্রুত পুরস্কার এবং প্রতিযোগিতার খেলার মাধ্যমে পুরুষদের মস্তিষ্ক পুরস্কার পেতে আরও বেশি উদ্দীপ্ত হয়, ফলে তারা গেম খেলে আসক্ত হয়। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যম ও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোও সদা নতুন কনটেন্ট দেখিয়ে ডোপামিন মুক্তি ঘটায়, যাকে এক গবেষক “ডেজিটাল ধূমপান” বলছেন। উদাহরণস্বরূপ, মোবাইল অ্যাপগুলো দৈনন্দিন সভ্যতার আদিম সামাজিকতা কে “ড্রাগিফাই” করে দিয়ে আশ্চর্যজনক পরিমাণ ডোপামিন সরবরাহ করে, যা হেরোইন বা মাদকদ্রব্যের মতো তীব্র আনন্দ দেয়।
আদতে পর্ন, গেমিং বা সোশ্যাল মিডিয়া যেকোনোটি ইচ্ছাপূরণের উৎস হিসেবে কাজ করে, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারে প্রতিফলন হয় ভিন্ন: মনোযোগ বিভক্তি, সময়ের অপচয়, বাস্তব জীবনের সম্পর্কের অবহেলা। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগে অতিমাত্রায় ডোপামিন পাওয়ার পর মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক ডোপামিন স্তর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে নিচে নামিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে ব্যবহারকারীরা একটি বিপরীত অবস্থা অনুভব করে – ইন্টারনেট ব্যবহার করতে করতে সুখ উপভোগ করলেও, ব্যবহার থামানোর পর হতাশা ও দুঃখ বৃদ্ধি পায়। এই ভাবে, নিরবচ্ছিন্ন ডিজিটাল বিনোদনের পরিণতি হতে পারে উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং মানসিক স্থিতিশীলতার ধ্বস।
আসক্তি-বিজ্ঞান: ডোপামিন এবং মনস্তত্ত্ব
অনলাইন বিনোদন আসক্তি বিশেষত মনস্তাত্ত্বিক ও নিউরোবায়োলজিক দিক থেকে জটিল। আমাদের মস্তিষ্ক পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার ব্যবহার করে। খাবার, যৌনতা, সামাজিক প্রশংসা ইত্যাদি প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা আমাদের ডোপামিন মুক্তি ঘটায় যাতে আমরা তা পুনরাবৃত্তি করি। কিন্তু আধুনিক অনলাইন বিনোদন অতিরিক্ত উদ্দীপনা দেয়: পর্ন দেখার সময় শরীরে প্রচুর ডোপামিন ছোঁড়া হয়, যা সংযোগগুলোকে শক্তিশালী করে এবং বারবার পর্ন দেখার আকাঙ্খা জন্মায়। যেমন একটি গবেষণায় দেখা গেছে দীর্ঘ সময় ধরে পর্ন দেখার ফলে ডোপামিনের তীব্র মুক্তি ঘটে, যা পর্নের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও আসক্তি তৈরি করে। এইভাবে পর্ন দেহকে মিথ্যা সুখবোধ দেয়, কিন্তু বাস্তব সম্পর্কের থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং অবশিষ্ট জীবনকে অস্পষ্ট করে তোলে। এক ব্যবহারকারী অভিজ্ঞতা বলেছেন যে সে পর্ন দেখার অভ্যাস ছেড়ে দিলে স্ত্রীকে সামলানো আগের মতো আর সম্ভব হয় না, কারণ পর্ন মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে রেখেছিল।
গ্রহণযোগ্য পুরস্কার সন্বন্ধীয় বিভিন্ন ডিজিটাল বিনোদন—পর্ন, গেম, সোশ্যাল মিডিয়া—সবই ডোপামিনের উপরই নির্ভর করে। অনলাইন গেমে নিয়মিত বিজয় বা নতুন চ্যালেঞ্জ মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্রকে চালু করে। ভিডিও গেম খেলার সময় পুরস্কার কেন্দ্র অধিক সক্রিয় হওয়ায় খেলোয়াড়ের আগ্রহ ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক মাধ্যমেও প্রতিটি নতুন ‘লাইক’, মন্তব্য বা ভিডিও দেখলে মস্তিষ্কে উপরে লক্ষ্য করা ডোপামিনের হালকা ধাক্কা পড়ে, যা পরবর্তী মুহূর্তে আরও পুরস্কারের লোভ উদ্রেক করে। TikTok, Instagram ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে অ্যালগরিদম সর্বক্ষণ নতুন নান্দনিক বিষয় দেখায়, যা দেখতে লোভ তৈরি করে এবং ‘নোভেলটি-সন্ধান’ ফাংশন অনুযায়ী মস্তিষ্ককে বারবার চাঙ্গা রাখে। এভাবে কৃত্রিম পরিবেশে অর্জিত পুরস্কারের পরিবর্তে পুনরাবৃত্তি চাহিদা তৈরি হয়।
আদতে এসব আচরণ শিক্ষিত নেশার শর্ত তৈরি করে। মস্তিষ্কের পুরস্কার সিস্টেম মাদকসদৃশ কাজ করলে একটি “টলারেন্স” বা সহিষ্ণুতা তৈরি হয়; অর্থাৎ একই পুরস্কার পেতে বেশি মাত্রার উদ্দীপনা প্রয়োজন হয়। লাইফলং ডিজিটাল অ্যাডিকশন মানে হল নতুন নতুন ছবি, দৃশ্য অথবা স্তর দেখা, যতক্ষণ না পর্যন্ত আরসুন্যায়ন পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারনেট পর্নের বৈশিষ্ট্য হল অসংখ্য বিকল্প, তীব্রতা ও নতুনত্ব; একের অধিক ট্যাবে পর্ন ভিডিও খোলা ও প্রয়োজনীয় অংশে সেগুলো খুঁজে দেখার ফলে ডোপামিনের বিপুল প্রবাহ হয়। এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করে যে পর্ন অনুশীলনের মাধ্যমে সে বাকি প্রেম জীবনে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে, কারণ মস্তিষ্ক আজীবন সেই ভার্চুয়াল উত্তেজনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
এছাড়া এই অতিরিক্ত উৎসাহ অপ্রত্যাশিত মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে। দীর্ঘ সময় পর্ন দেখার অথবা গেমিং-এর কারণে ঘুমের ঘাটতি হতে পারে, যা চেতনায় স্বচ্ছতা ও একাগ্রতা হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ, উপরের প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, “পর্নের মাধ্যমে রক্তে অ্যাড্রেনালিন তৈরি হয়ে ঘুম কম হয় এবং একাগ্রতা চলে যায়”। তাছাড়া অনলাইন গেম এবং মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে সৃষ্টি হতে পারে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মানসিক চাপ এবং “লৌয়া নি:শক্তি”–শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা। স্ট্যানফোর্ডের গবেষণায় পাওয়া যায়, ডিজিটাল মাধ্যমের নির্মিত ছদ্ম-সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক প্রায়শই হতাশা অনুভব করে এবং ‘লুণিত নিরাশা’ বা learned helplessness দেখা দিতে পারে। প্রতিদিন নিখুঁত জীবনের ছবিকে দেখে যুব সমাজ নিজের সাথে তুলনা করে পঙ্গু বোধ করতে পারে। এক গবেষক উল্লেখ করেছেন, যারা যৌথ সামাজিক জীবনের 'সঠিক' প্রমাণ দেখেছেন, তারা বারবার নিরাশ হয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এই সব অভ্যাস তরুণদের আচরণে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আনে। এক গবেষণায় দেখা যায় পর্নোপ্রবণ কিশোরদের মধ্যে অবসাদ ও পারিবারিক সমস্যা অনেক বেশি থাকে। তারা মানসিক চাপ বা বিষণ্ণতা মোকাবিলা করতে পর্নোগ্রাফি বা গেমিংয়ের আশ্রয় নেয়। আইসলামিক গবেষণায়ও ধরা পড়েছে যে মুসলিম যুবকেরা বেশিরভাগ সময় বোর হবার, একাকিত্ব অনুভব করার বা সমস্যা ভুলে থাকার জন্য পর্ন দেখেন। এগুলো মূলত কোপিং মেকানিজম; কিন্তু ডোপামিনের সহজলভ্যতার কারণেই তারা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সুস্থতার বদলে সাময়িক তৃপ্তি পায়। মস্তিষ্ক সময়ের সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং বাস্তব জীবনের কাজগুলোতে আগ্রহ কমে যায়। ফলে শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা, আত্মসম্মান হ্রাস এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটতে পারে।
ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি: নৈতিকতা, সময় ব্যবস্থাপনা ও সমাধান
ইসলামী শাসন ও দৃষ্টি অনুযায়ী মানবসম্পদ যেমন শরীর, সময় ও সম্পদ সর্বদাই সৎ কাজে ব্যয়িত হওয়া উচিত। আল-কুরআনে আল-আসর সূরায় সহজ ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হয়, “কালকে শপথ! নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।” তারপর চল্লিশ-তিনটি আয়াতে ব্যাখ্যা করা হয় যে সাফল্য পায় সে যিনি ঈমান এবং সৎ কাজের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ, সত্য ও ধৈর্য্য পরামর্শ দেয়। এই আয়াতসমষ্টি আমাদের শেখায় যে সময়ের অপচয় সবচেয়ে বড় ক্ষতি। হাদীসে এসেছে, মানুষের দুইটি আশীর্বাদ আছে যা তারা নষ্ট করে দেয়: সুস্থতা এবং (ভালো কাজের জন্য থাকা) অবসর সময়। অর্থাৎ ইসলাম আমাদের চেতনায় ঘুমন্ত সময় ও সুস্বাস্থ্যকে অপচয় না করে তা সদুপযোগে কাজে লাগাতে আদেশ করে।
আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক শান্তির জন্য সময়ের সদ্ব্যবহার অপরিহার্য। মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে, আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা না বলে কাজই শুরু করে না। যেমন হাদীসে আছে, “যে কোনো কাজ পরবর্তীকাল পর্যন্ত না টেনে, ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলে ওর অভিমান করো না”। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে সময়ের গতিকে কোনোভাবেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না, তাই প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো মুসলমানের কর্তব্য। কুরআনে মক্কী পর্যায়ে ঐশ্বরিক আদেশ এসেছে, “মুমিন পুরুষদের এ-নির্দেশ দাও যে তারা তাদের দৃষ্টি নিম্নে নামাক এবং তাদের পাশবাচার রক্ষা করুক” । অর্থাৎ, চোখের উপরে চাহনি রাখা এবং যৌন স্বল্পাচার থেকে নিজেকে বিরত রাখা পবিত্রতার জন্য অপরিহার্য। মহানবি হযরত মুহাম্মদ ﷺ-এর সতীদশায় এসেছে যে মানুষ তার সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্যভিচার করে; চোখের অশ্লীল দৃষ্টি ঈমানকে দুর্বল করে এবং যৌনতার প্রতি আমাদের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করে দেয়। এই শিক্ষাগুলো যথেষ্ট নির্দেশ দেয় যে ডিজিটাল পর্ন ও অনৈতিক গেমিংয়ের মতো কৃত্রিম লোভ থেকে নিজেকে বিরত রাখা ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
মানসিক ও আত্মিক শক্তি ধরে রাখতে ইসলাম কয়েকটি উপায় নির্দেশ দিয়েছে। ধর্ষণ-সম্মত চাহনি নিয়ন্ত্রণ না হলে খারাপ অভ্যাস লেগে যায়, তাই নবী ﷺ বলেছেন, “যারা বিয়ে করতে পারে তারা বিয়ে করুক; এবং যারা পারবে না, তারা নরসুন্দর (লালসা) কমাতে রোজা রাখুক” । এটি যৌন ইচ্ছাশক্তি নিয়ন্ত্রণের সহজ উপায় হিসেবে উপবাসকে উল্লেখ করে। অন্যদিকে বিয়ে তরুণদের জীবনে আবেগ-সমৃদ্ধতা আনতে পারে এবং পর্নের লোভ কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
এছাড়া দৈনন্দিন ডোজাকাজে শৃঙ্খলা ও সময় ব্যবস্থাপনা ইসলামি শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নবী ﷺ এর সাহাবিদের মধ্যে প্রচলিত ছিল যে তারা যখন দুই জন দেখালাপ করতো, আল্লাহর কসম, পরে আলসার মন্ত্রণা আসলে তারা আল-কুরআন পাঠ করতো এবং সেই মুখবন্ধে আলাসার প্রলোভন রাখতো (আবু দাউদ)। এই মতাদর্শ থেকে বোঝা যায় যে প্রলোভন ও বিনোদন সম্পন্ন অবসরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই সমাধান। আধুনিক সময়ে যেমন একটি ভাল প্রার্থনা বা কুরআনের তিলাওয়াত কাজ করতে পারে, সেভাবেই ধ্যান, সুস্থ জীবনযাপন, শপিং বা কর্মমুখী কাজগুলিও সাহায্য করে বোরডম বা মানসিক চাপ প্রতিহত করতে। উদাহরণস্বরূপ, আজকের যুবকরা অবসরে যদি শরীরচর্চা, নতুন কোনো সৃজনশীল শখ আয়ত্ত করতে প্রচেষ্টা করে, অথবা সমাজসেবায় অংশগ্রহণ করে, তবে ডোপামিনের বিকল্প উৎস পাবে। এক গাইডলাইন উল্লেখ করে, বোর হবার জন্য দিনের রুটিন সাজানো উচিত – পড়াশোনা, খেলাধুলা, নিজেকে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে পর্ন থেকে মন সরিয়ে নেয়া যায়।
ইসলাম মানসিক স্বাস্থ্যের কথাও বলে: অতিরিক্ত আশা-নিরাশার ঊর্ধ্বগতি এড়িয়ে চলতে এবং পরম প্রশান্তি লাভ করতে সবসময় আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে উৎসাহিত করে। কোরআনের আয়াত “আল্লাহ সবকিছু জানেন” আমাদের মনে করায় যে তাঁর সাহায্য ও নির্দেশনা সর্বদাই উপলব্ধ; তাকেও স্মরণ করলে মন শান্তি পায়। ফলে বিপাকে পড়লে দোয়া ও ইবাদত-মুনাজাতের মাধ্যমে যুবক মানসিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। পাশাপাশি ইসলাম মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার জন্য সামাজিক সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয় – পরিবারের সান্নিধ্য, সৎ বন্ধুত্ব এবং দীক্ষিত সম্প্রদায় এই সকল মানবিক অন্বেষণের জায়গা, যা একাকিত্ব ও শূন্যতার বোধ কমায়।
সর্বোপরি, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনধারার শিক্ষা দেয় যা ইন্টারনেটের অতিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণে আনে। নবী ﷺ বলেছেন, “তোমার অর্ধেক ভাগ জীবন গিয়েছে এবং তোমার কাছে আর মরণ নিকটবর্তী (ঈদ ও পরকালের দিকে) এ কথা ভাব” – অর্থাৎ প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। এই দৃষ্টিভঙ্গি আদর্শ করে যে যে তরুণ তার সময় ইসলামি অনুশীলন (নামাজ, রোজা, জিকর) বা শিক্ষাজীবনে ব্যয় করবে, সে মানসিকভাবে সুরক্ষিত থাকবে। যেমন হাদীসে নির্দেশ আছে যে কাজ করার আগে পরিকল্পনা করতে হবে (‘তোমার উটকে বাঁধো তারপর তওয়াক্কুল করো’), তেমনি ইসলাম ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিয়ে ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক যোগাযোগ বা গেম খেলার সময় নির্দিষ্ট করে নিলে অতিরিক্ত সুযোগ থেকে রেহাই মেলে; পরিকল্পিত ভিডিও দেখাশোনা বা মাত্রামিত গেম সেশন দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি থেকে বাঁচায়।
উপসংহার
সর্বোপরি, বর্তমান অনলাইন সংস্কৃতির ছন্দ মুসলিম যুবসমাজসহ সমস্ত তরুণের জন্য চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করছে। পর্নোগ্রাফি, ভিডিও গেম ও সোশ্যাল মিডিয়া–এগুলো অতিরিক্ত ব্যবহার ডোপামিন-নির্ভর আচরণ উদ্দীপিত করে এবং মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গবেষণাগুলো স্পষ্ট করে দেখায় যে এই চাহিদা শিশু-কিশোরদের মস্তিষ্ককে ঐশ্বরিক নিয়ম ভঙ্গ করে অতিরিক্ত পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আসক্ত করতে পারে। এদিক থেকে পরিস্থিতি ইসলাম স্বাভাবিক মানব প্রকৃতির একটি মাপকাঠি দিয়ে বিবেচনা করে এবং সতর্ক করে দেয় যে “মানুষ ছাড়া সবাই ক্ষতিগ্রস্ত” (সূরা আল-আসর) যদি তারা সৎ কাজ এবং সততার দিক অনুসরণ না করে। ইসলাম আমাদের সময়ের মর্যাদা শেখায় এবং মস্তিষ্কের খেয়ালপত্রে আসক্তি তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে উদ্গত করে।
বিজ্ঞান ও ইসলাম উভয়ই নির্দেশ করে যে সঠিক ব্যবহারে প্রযুক্তি ফলদায়ক হতে পারে (উদাহরণস্বরূপ, অনলাইন শিক্ষা বা ধর্মীয় বিষয় অনুধাবন করা), কিন্তু অতিরিক্ত প্রবৃত্তি আমাদের ক্ষতি করে। কোরআন ও হাদীস আমাদের শাসন দেয় যে দৃষ্টিশক্তি ও মনে পরিশুদ্ধ থাকা উচিত, এবং সময়ের অপচয় রোধ করে সদা সত্য ও ধৈর্যের পথে থাকার আহ্বান জানায় (সূরা আল-আসর)। তাই নারীদের জামিল বিহীন চেহারা না প্রদর্শন করার আদেশের মতো কুরআন ২৪:৩০-৩১-এর নির্দেশ আমাদের অনলাইন আচরণেও প্রযোজ্য – পর্দা করে নৈতিকতা রক্ষা করতে হবে।
শেষোক্ত, আমাদের উচিত ইন্টারনেটকে পরিমিত ও সৎ কাজে ব্যবহার করা। গেম খেলতে বা ভিডিও দেখতেও পারি, কিন্তু সময় নষ্ট না করে সেগুলোকে পর্যবেক্ষণীয় সীমায় বেঁধে রাখা দরকার। ইসলাম স্বীয় আদর্শ ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে যুবসমাজকে এই আধুনিক নেশা থেকে মুক্তি পেতে প্রেরণা দেয়। নিয়মিত প্রার্থনা, আল-কুরআন পাঠ এবং ধ্যান-জিজ্ঞাসা যুবককে ধৈর্য, নিয়ন্ত্রণ ও উদ্দেশ্যবোধ প্রদান করে। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি শনিবারের কাজে যথাসময় করে, সে তার জীবনকে সফল করে তোলে।” বাস্তবে সময়কে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে রেখে ইবাদত-নিয়মে মনকে নিয়ন্ত্রণ করলে অনলাইন অতিভোগের অসুবিধা অল্পে কমানো সম্ভব। মোটকথা, ইসলামি নৈতিকতা ও আত্মিক সচেতনতা ডিজিটাল যুগে ব্যক্তির মনকে বিশৃঙ্খলা থেকে সরিয়ে আনতে কার্যকর হাতিয়ার, যা যুবসমাজকে সজাগ, দায়িত্বশীল ও অর্থপূর্ণ জীবনের পথে পরিচালিত করে।