কোরআন শিক্ষার গুরুত্ব ও ফজিলত

             মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। এসকল নবী -রাসূলদেরকে গাইডবুক হিসেবে সহীফা ও কিতাব দিয়েছেন। এসব কিতাব সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ কিতাব হচ্ছে আল-কোরআন। পূর্ব পূবর্বর্তী কিতাবসমূহের উপরে ঈমান আনা এবং আল-কোরআনকে মেনে চলা মুসলিমদের উপরে আল্লাহ তায়ালা ফরজ করেছেন। আল-কোরআন এসেছে বিশ্ব মানবতাকে হিদায়াতের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘রমযান মাস, যাতে কোরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদের্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।’ (সূরা আল-বাকারা-১৮৫)
             হিদায়াতের এই কিতাব আল -কোরআন শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপরে ফরজ করা হয়েছে। নিম্নে আল-কোরআন শিক্ষা করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেআলোচনা করা হলো আল-কোরআন শিক্ষা করা ফরজ আল-কোরআনের প্রথম বাণী হচ্ছে, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক-১)
             এখানে ইক্বরা, অর্থ: পড়ো। এ আয়াতের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসমুলিমকে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন তোমরা যিনার জন্য, বোঝার জন্য এবং সঠিকটা মেনে চলার জন্য পড়া-লেখা করো, অধ্যয়ন করো। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তায়ালা ফরজ করে দিয়েছেন। আর এটার বাস্তব নির্দেশ দিয়েছেন রাসূল (সা.)।
             আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলসূ (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপরে ফরজ।’ (সূনান ইবনে মাজা) জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আল-কোরআন শিক্ষা করাও প্রত্যেক মুসলমানের উপরে আল্লাহ ফরজ করে দিয়ে ছেন। রাসূল (সা.) এ সম্পর্কে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,
              হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলসূ (সা.) বলেছেন, তোমরা কোরআন ও ফারায়েজ (উত্তরাধিকার আইন) শিক্ষা করো এবং মানুষদেরকে শিক্ষা দাও কেননা আমাকে উঠিয়ে নেয়া হবে।’ (সূনা সূ ন আত-তিরমিযি) তাই, আমাদের উপরে কর্তব্য আল-কো রআন ও ইলমে ফারায়েজ (উত্তারাধিকার আইন) শিক্ষা করা এবং এর আলোকে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্র পরিচালনা করা। আল-কোরআন শিক্ষা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত আল-কোরআন অধ্যয়ন করা, কোরআন জানা-বোঝার চেষ্টা করা পৃথিবীর সকল কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাজ। কারণ এ কো রআনের মধ্যে রয়েছে মানুষের জীবন পরিচালনা পদ্ধতি, হিদায়াতের সঠিক পথ। প্রত্যেক কাজ শুরু করার সময় রাসূল (সা.) বিসমিল্লাহ পড়ে (আল্লাহর নাম নিয়ে) শুরু করার কথা বলে ছেন। তবে যেকোনো কাজ শুরু করার আগে ‘আউযুবিযু ল্লাহি মিনাশ শাইতারিজ রাজীম’ অর্থাৎ শয়তা নের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলেননি। তবে একটি কাজ করার আগে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলেছেন, সেটা হলো আল-কোরআন তিলাওয়াত বা অধ্যয়নের সময়। এ সম্পর্কে আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘সুতরাং যখন তুমি কোরআন পড়বে তখন আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান হতে পানাহ চাও।’ (সূরা আন-নাহল-৯৮)
হাদিস হতে কিছু কথাঃ-
রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
   خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْاٰنَ وَعَلَّمَهٗ
‘যে কুরআন শরীফ শিক্ষা করে ও শিক্ষা দেয় সে-ই তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ বুখারী
মুসলিম শরীফে আছে :
اَفَلَا يَغْدُوْا اَحَدُكُمْ اِلٰى الْمَسْجِدِ فَيَتَعَلَّمُ مِنْ كِتَابِ اللهِ اٰيَتَيْنِ خَيْرٌ لَّهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ وَثَلَاثٌ خَيْرٌلَّهُ مِنْ ثَلِاثٍ وَاَرْبَعٌ خَيْرٌلَّهُ مِنْ اَرْبَعٍ وَمِنْ اَعْدَادِهِنَّ مِنَ الْاِبِلِ.
“তোমাদের মধ্যে কেহ মসজিদে গিয়ে কুরআনের দুইটি আয়াত কেন শিক্ষা লাভ করে লয় না? কুরআনের দুইটি আয়াত শিক্ষা করা দুইটি উট অপেক্ষা অধিক ভাল। এইরূপে তিনটি আয়াত তিনটি উট অপেক্ষা এবং চারটি আয়াত চারটি উট অপেক্ষা অধিক ভাল। এমনিভাবে যত সংখ্যক আয়াত হবে, তত সংখ্যক উট হতে অধিক ভাল।”
             আল-কোরআনের এ বক্তব্য থেকে জানা যায়, শয়তান সকল কাজেই বান্দা কে কুমন্ত্রণা দেয়। তবে কোরআন অধ্যয়নের সময় শয়তান সবচেয়ে বেশি কুমন্ত্রণা দিয়ে মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টা করে। কোরআনের কথা যেন মানুষ বুঝতে না পারে, সে জন্য শয়তান শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে থাকে। মুসলমানরা কোরআন থেকে দূরে সরে থাকলে শয়তান বেশি খুশি হয়। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা কোরআন অধ্যয়নের সময় শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলেছেন।
             এজন্য আমাদের উচিত আল- কোরআন জানা ও বোঝার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করা। আল-কোরআন হিদায়াতের একমাত্র কিতাব আল-কোরআন হচ্ছে বিশ্ব মানবাতার জন্য হিদায়াতের একমাত্র কিতাব। এই কোরআনই বিশ্বের সকল মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে, হিদায়াতের আলোয় আলোকিত করতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় এ কোরআন এমন একটি পথ দেখায় যা সবচেয়ে সরল এবং যে মুমিনগণ নেক আমল করে তাদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরপুস্কার। আর যারা আখিরাতে ঈমান রাখে না আমি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছি যন্ত্রণাদায়ক আযাব।’ (সূরা বনি ইসরাইল- ৯-১০)
             ‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।’ (সূরাআল-মায়েদা- ১৫-১৬)
             আল-কোরআন ছাড়া অন্য কারো কাছে হিদায়াত অন্বেষণ করা যাবে না। কেউ এটা করলে আল্লাহ নিজে তাকে গুমরাহ করে দিবেন। এ সম্পর্কে আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্য ক্তি কোরআন ছাড়া অন্য করো কাছে হিদায়াত চাইবে, আল্লাহ তা কে পথভ্রষ্ট করে দিবেন।’ (সূনান আত-তিরমিযি) অতএব, আমাদের জীবন চলার পাথ ইসলামকে সঠিকভাবে জানার জন্য হিদায়াতের একমাত্র কিতাব আল-কোরআন শিক্ষা অব্যাহত রাখতে হবে।
কুরআন শরীফের আয়াত উট অপেক্ষা অধিক ভাল, ইহা বুঝতে বেশী কিছু চিন্তার দরকার হয় না। কারণ, উট তো একমাত্র দুনিয়াতেই কাজে আসে, আর কুরআনের আয়াত দুনিয়া ও আখেরাত দু-জাহানে কাজে আসে। এখানে উটকে উদাহরণ স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা, আরব দেশের লোকেরা উটকেই বড় সম্পত্তি মনে করে, নতুবা একটি আয়াতের পরিবর্তে সমগ্র বিশ্বেরও কোন মূল্য হয় না।
             এই হাদীস দ্বারা এই উপদেশ লাভ করা যায় যে, সমস্ত কুরআন শরীফ না পড়তে পারলেও যতটুকু পড়–ক না কেন ততটুকুতেই বড় ফযীলত ও অতি বড় নেয়ামত। হাদীসে আছে-
اَلْمَاهِرُ بِالْقُرْاٰنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِىْ يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ وَيَتَتَعْتَعُ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَّهٗ اَجْرَانِ. بخارى
             ‘যে ব্যক্তি স্পষ্টভাবে অনায়াসে কুরআন শরীফ পড়তে পারে সে ব্যক্তি ঐ সমস্ত ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে, যাঁরা বড়ই পবিত্র, বড়ই সম্মানী এবং যারা লোকের আমলনামা লিখেন। আর যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ে, কিন্তু মুখে বাধবাধ ঠেকে এবং বড়ই কঠিন বোধ করে, সে-ও দ্বিগুণ সওয়াব পাবে।’ দ্বিগুণ সওয়াবের কারণ এই যে, শুধু পাঠ করার জন্য এক সওয়াব পাবে, আর পড়ার সময় কষ্টের কারণে যে বিরক্ত হয়ে পড়া ক্ষান্ত না করে পড়তে থাকে, তজ্জন্য আর একটি সওয়াব পাবে। -বুখারী শরীফ
             যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ ভালমত পাঠ করতে না পারা সত্তে¡ও বিরক্ত হয়ে পাঠ ছেড়ে দেয় না, তার জন্য এই হাদীস কত বড় খোশখবরী (সুসংবাদ) দেওয়া হয়েছে যে, তাকে দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হবে। অন্য হাদীসে আছে-
اِنَّ الَّذِىْ لَيْسَ فِىْ جَوْفِه شَىْءٌ مِّنَ الْقُرْاٰنَ كَالْبَيْتِ الْخَرِبِ. ترمذي
             ‘যাহার সিনার মধ্যে (অন্তরে) একটুও কুরআন নাই, সে যেন একখানা উজাড় ঘর।’ -তিরমিযী কোনো মুসলমানের অন্তরই কুরআন শূণ্য থাকা চাই না। হাদীসে আছে-
مَنْ قَرَأَ مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهٗ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ اَمْثَالِهَا لَا اَقُوْلُ الۤمۤ حَرْفٌ بَلْ اَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيْمٌ حَرْفٌ . ترمذي
             ‘যে ব্যক্তি (আল্লাহর কিতাব) কুরআন শরীফের একটি অক্ষর পড়ে, সে একটি নেকি পায়, আর প্রত্যেক নেকি দশ নেকির সমান (এই হিসাবে প্রত্যেক অক্ষরে দশ নেকি করে পাওয়া যায়)। আমি এ কথা বলি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ এক অক্ষর; বরং ‘আলিফ’ এক অক্ষর, ‘লাম’ এক অক্ষর এবং ‘মীম’ এক অক্ষর। -তিরমিযী
             এর দৃষ্টান্ত এই যে, যদি কেউ ‘আলহামদু’ পড়ে, তবে এর পাঁচটি অক্ষরের পঞ্চাশ নেকি পাবে। আল্লাহু আকবার! কত বড় ফযীলত। সুতরাং সামান্য একটু কষ্ট ও পরিশ্রম স্বীকার করে যে এত বড় ফযীলত হাসিল না করবে, তার উপর বড়ই আক্ষেপ।
রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ وَعَمِلَ بِمَا فِيْهِ اُلْبِسَ وَالِدَاهٗ تَاجًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ضَوْءُهٗ اَحْسَنُ مِنْ ضَوْءِ الشَّمْسِ فِىْ بُيُوْتِ الدُّنْيَا لَوْ كَانَتْ فِيْكُمْ فَمَاظَنُّكُمْ بِالَّذِىْ عَمِلَ بِهٰذَا.
             ‘যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়েছে এবং উহার হুকুমের উপর আমল করেছে, তার মাতা-পিতাকে কিয়ামতের দিন এমন একটি তাজ (মুকুট) পরান হবে, যার আলোক সূর্যের আলোক হতে অধিকতর উজ্জল হবে- যে আলোক দুনিয়াতে যে সূর্য যখন তোমাদের মধ্যে আসে, তখন তোমাদের ঘরের মধ্যে হয় অর্থাৎ, সূর্য যখন কাছে আসে, তখন তোমাদের ঘরের মধ্যে কত আলো হয়, সেই তাজের আলো ইহা অপেক্ষাও অধিক হবে। যখন মাতা-পিতার এত বড় মর্তবা হবে, তখন যে ব্যক্তি স্বয়ং কুরআন শরীফ পড়বে ও তদনুযায়ী আমল করবে, তার সম্বন্ধে তোমাদের কি ধারণা? অর্থাৎ, তার মর্তবা অসীম ও অতুলনীয়।’
             ছেলে-মেয়েদেরকে যদি সময়াভাবে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ শিক্ষা না-ও দেওয়া যায়, তবে (পারা বা সূরা) যতটুকু হউক না কেন, তাই শিক্ষা দেওয়া নেহায়েত দরকার। যদি হিফজ করতে পারে, তবে তো অফুরন্ত ফযীলত।
             অনেক মুসলমান নিজের সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষার পরিবর্তে জাগতিক শিক্ষা দেওয়াটা অধিক গুরুত্ব ও গৌরবের বিষয় মনে করে। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কুরআন সহীহ-শুদ্ধতার প্রতি লক্ষ্য করা হয় না, একই সাথে কুরআনের প্রতি আদবের শিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বহীন।
             বর্তমানে মুসলমানদের ঘর ও মসজিদ তিলাওয়াত শূন্য হয়ে গেছে। গুনাহের আসবাব দ্বারা ঘর, দোকান-পাট ভরে গেছে। একসময় মুসলমানদের ঘর-বাড়ি থেকে কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ আসত। সেখান থেকে এখন আসছে গান-বাদ্যের আওয়াজ। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও বরকতের জন্য কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত করা হতো। এখন দোকান-পাটে টি.ভি. ও ভি. সি.ডি. এবং বাদ্য-বাজনার মাধ্যমে উন্নতি কামনা করা হয়। মসজিদে কুরআন মাজীদ থাকলে তা তালাবদ্ধ আলমারিতে রাখা হয়। অনেক স্থানে শুধু ব্যবস্থাপনার কারণে তিলাওয়াতের সুযোগ হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মসজিদে বা ঘরে কুরআনকে ধরা ছোঁয়ার কেউ নেই। অথচ মসজিদে কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত সম্পর্কে হযরত উকবা ইবনে আমের রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমরা মসজিদে নববীর সুফ্ফায় বসা ছিলাম। এমন সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনলেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে কে ইহা পছন্দ কর যে, সকাল বেলা বতহান বা আকীক নামক বাজারে যেয়ে কোন রকম গোনাহ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন না করে দু’টি অতি উত্তম উটনী নিয়ে আসবে? সাহাবায়ে কেরাম রাযি. আরজ করলেন, ইহা তো আমাদের সকলেই পছন্দ করবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মসজিদে গিয়ে দু’টি আয়াত পড়া বা দু’টি আয়াত শিক্ষা দেওয়া দু’টি উটনী হতে এবং তিনটি আয়াত তিনটি উটনী হতে এমনিভাবে চারটি আয়াত চারটি উটনী হতে উত্তম এবং ঐগুলোর সমপরিমাণ উট হতে উত্তম। -মুসলীম, আবু দাউদ
রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ فَاسْتَظْهَرَهٗ فَاَحَلَّ حَلَالَهٗ وَحَرَّمَ حَرَامَهٗ اَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ وَشَفَّعَهُ فِىْ عَشَرَةٍ مِّنْ اَهْلِ بَيْتِهِ كُلُّهُمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهٗ النَّارَ
             ‘যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়বে এবং তা হিফজ করবে এবং তার হালালকৃতকে হালাল ও হারামকৃতকে হারাম জেনে চলবে, (অর্থাৎ, কুরআনের খেলাফ যেন কোনো আকীদা না হয়। উপরে আমলের কথা বলা হয়েছিল, এখানে আকীদার কথা বলা হলো।) আল্লাহ তাকে বেহেশতে স্থান দিবেন এবং তার আত্মীয়বর্গের মধ্য হতে দশজন লোকের জন্য তার সুপারিশ গ্রহণ করবেন যাদের জন্য দোযখ সাব্যস্ত হয়ে ছিল।’ -তিরমিযী
             এই হাদীসে কুরআন শরীফ হিফজ করার ফযীলত আরো বেশী বর্ণনা করা হয়েছে। আর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী মা-বাবা। অতএব, মা বাবার জন্য যে সুপারিশ ও বখশিশ হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নাই। নিজের ছেলেকে হাফেজ বানাবে যে কত বড় ফযীলত তা এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়।
রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اِنَّ هٰذِهِ الْقُلُوْبَ تَصْدَءُ كَمَا يَصْدَءُ الْحَدِيْدُ اِذَا اَصَابَهُ الْمَاءُ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ! وَمَا جِلَائُهَا؟ قَالَ كَثْرَةُ ذِكْرِ الْمَوْتِ وَتِلَاوَةِ الْقُرْاٰنِ. بيهقى
             ‘পানি লাগলে লোহায় যেরূপ মরিচা ধরে, সেই রকম মানুষের দিলেও মরিচা ধরে। (মজলিস হতে) আরজ করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! সেই জিনিস কি যাদ্বারা দিলকে সাফ করা যায়? রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, মৃত্যুকে বেশী স্মরণ করলে এবং কুরআন শরীফ পড়তে থাকলে। (দিল সাফ থাকে, মরিচা ধরে না)।’ -বায়হাকী
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ ﷺ وَنَحْنُ نَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ وَفِيْنَا الْعَرَبِىُّ وَالْعَجَمِىُّ فَقَالَ اقْرَؤُوْا فَكُلٌّ حَسَنٌ
             ‘হযরত জাবের রাযি. হতে বর্ণিত আছে যে, একবার রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এমতাবস্থায় তাশরীফ আনলেন, যখন আমরা কুরআন শরীফ পাঠ করছিলাম, তখন আমাদের মধ্যে পাড়াগাঁয়ের লোকও ছিল। (আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আরবী লোক ছিল, তারা কুরআন শরীফ শুদ্ধভাবে পড়তে পারত, আর কয়েকজন পাড়াগাঁয়ের লোকও ছিল, যারা শুদ্ধভাবে কুরআন শরীফ পড়তে পারত না।) হযরত বললেন, পড়তে থাক, সবই ভাল।’
             অর্থাৎ চেষ্টা করতে থাক যদি তা সত্তে¡ও ভালো পড়তে না পার তাতে মন ছোট করো না, আর যারা ভালো পড়তে পারে, তারা যেন তোমাদেরকে ঘৃণা না করে। (আল্লাহ তা‘আলা দিল দেখেন।) একথা দ্বারা বুঝা গেল যে, ‘জবান (মুখ) সাফ নয় বা বয়স বেশি হয়ে গিয়েছে, এমতাবস্থায় সহীহ করে (শুদ্ধ করে) পড়তে পারা যাবে না, সুতরাং সওয়াব কি হবে? বরং গোনাহ (পাপ) হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ এমন মনে করা উচিত নয়। বরং রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে সান্তনা দিয়ে পড়তে বললেন।
মিশকাত শরীফে আছে-
مَنِ اسْتَمَعَ اِلٰى اٰيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللهِ كَتَبَتْ لَهٗ حَسَنَةٌ مُّضَاعَفَةٌ وَمَنْ تَلَاهَا كَانَتْ لَهٗ نُوْرًا يَّوْمَ الْقِيَامَةِ
             ‘যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের একটি আয়াত শুনার জন্যও কান লাগাবে অর্থাৎ মনোযোগের সাথে শুনবে, তাকে এমন একটি নেকি (পূণ্য) দেওয়া হবে, যা সর্বদা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। (কতদূর যে বাড়বে তার কোন সীমা নির্দেশ করেন নাই। অতএব, আল্লাহ তা‘আলার রহমতের দরবারে আশা করা যায় যে, ইহা ধারণাতীত বাড়বে।) আর যে ব্যক্তি সে আয়াতটি পাঠ করবে, তার জন্য সেই আয়াতটি কিয়ামতের দিবসে একটি উজ্জল নূর হবে।’ আহমদ
কুরআন শরীফ কত বরকতের জিনিস। যদি নিজে পড়তে না পারে, তবে কোনো কুরআন পাঠকের পড়ার দিকে কান লাগিয়ে শুনলেও বিশেষ সওয়াব পাওয়া যায়। হে আল্লাহর বান্দা! ইহা তো কিছুই কঠিন নয়। (এখনও জাগ, আখেরাতের জন্য একটু চিন্তা কর, অলস্য নিদ্রা পরিত্যাগ কর, আর ঘুমে বিভোর থেকো না।)
রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اِقْرَؤُوْا الْقُرْاٰنَ فَاِنَّهٗ يَأْتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيْعًا لِّاَصْحَابِه – مسلم
             ‘(হে আমার উম্মতগণ!) তোমরা কুরআন শরীফ সর্বদা তিলাওয়াত করতে থাক; কেননা যারা কুরআন শরীফ সর্বদা তিলাওয়াত করবে, কিয়ামতের দিন কুরআন শরীফ তাদের জন্য সুপারিশ করবে (তাদেরকে দোযখ হতে বাঁচিয়ে দিবে)।
রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-
يَجِيْئُ صَاحِبُ الْقُرْاٰنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَقُوْلُ الْقُرْاٰنُ يَا رَبِّ حَلِّه فَيُلْبَسُ تَاجُ الْكَرَامَةِ ثُمَّ يَقُوْلُ يَا رَبِّ زِدْهُ فَيُلْبَسُ حُلَّةُ الْكَرَامَةِ ثُمَّ يَقُوْلُ يَارَبِّ اِرْضَ عَنْهٗ فَيُرْضٰى عَنْهُ فَيُقَالُ اِقْرَأْ وَارْقَ وَيَزْدَادُ بِكُلِّ اٰيَةٍ حَسَنَةٌ-  ترمذى
             কুরআন শরীফ পাঠকারীগণ কিয়ামতের দিবসে যখন আল্লাহর দরবারে আসবে, তখন কুরআন শরীফ বলবে, ‘হে আল্লাহ! তাদেরকে সম্মানের লেবাস পরিধান করান। অতঃপর তাদেরকে বড় সম্মানের তাজ পরান হবে। অতঃপর কুরআন শরীফ পুনরায় বলবে, ‘হে আল্লাহ! তাদেরকে আরো দিন।’ তখন তাদেরকে আরো সম্মানের লেবাস পরান হবে। পুনরায় কুরআন শরীফ বলবে, ‘হে আল্লাহ! আপনি তাদের উপর চিরকালের জন্য সন্তুষ্ট হয়ে যান।’ অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর চিরকালের জন্য সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন এবং বলবেন: ‘কুরআন শরীফের এক একটি আয়াত পাঠ করো এবং এক একটি উচ্চ দর্জায় আরোহণ করতে থাক।’
             অন্য এক হাদীসে এই পড়া এবং উপরের দর্জায় চড়ার বিস্তৃত বর্ণনা এসেছে। যা এরূপ: ‘যে ভাবে দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পড়তে সেই রকম পড়তে ও চড়তে থাকো; যে আয়াতে গিয়ে তোমার পড়া শেষ হবে সেখানেই তোমার থাকার স্থান।’
হে মুসলমানগণ!
             এই সকল হাদীস খুব চিন্তার সাথে পাঠ করুন। কুরআন শরীফ অমূল্য রত্ন , যত্নের সাথে শিক্ষা লাভ করুন এবং নিজের ছেলে-মেয়েদেরকেও শিক্ষা দিতে চেষ্টা করুন। যদি সহীহ করে পড়তে না পারা যায়, তবে ঘাবরানোর কোনো কারণ নাই। চেষ্টা করতে থাকলেও বহু সওয়াব পাওয়া যাবে। যদি হিফজ (কণ্ঠস্থ) না হয়, তবে দেখে দেখে পড়তে ও পড়াতে থাকবে। তাতে অনেক ফযীলত হাসিল হবে। যদি সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ পাঠ শিক্ষা লাভ করার সময় ও সুযোগ না ঘটে, তবে যারা সম্পূর্ণ কুরআন শিক্ষা লাভ করেছেন তাদের নিকট বসে শুনলেও অনেক সওয়াব পাওয়া যাবে।
সকলেরই জানা আছে যে, যে সকল কাজ অত্যন্ত দরকারী তা করাতে সওয়াব পাওয়া যায়, অথচ তা হাসিল করার উপায়গুলি অর্জন করা যেমন জরূরী বা দরকারী, তেমন তাতে অফুরন্ত সওয়াবও নিহিত আছে।
             অতএব, কুরআন শরীফ শিক্ষার বন্দোবস্ত করাও নেহায়েত জরূরী এবং তাতে অশেষ সওয়াব আছে। প্রতি গ্রামে মুসলমান ভাইগণ মিলিতভাবে চেষ্টা করবেন, যাতে গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় কুরআন শরীফ শিক্ষার জন্য মক্তব স্থাপিত হয়। সেই মক্তবে ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার বন্দোবস্ত করা একান্ত দরকার। বয়স্কদেরও কুরআন শরীফ শিক্ষার জন্য কিছু সময় বের করতে হবে। দুনিয়ার সমস্ত কাজ-কর্মের জন্য সময় মিলে, আর আল্লাহর কালাম কুরআন শরীফ শিক্ষার জন্য সময় মিলবে না?
             শিক্ষক যদি বিনা বেতনে পাওয়া যায়, তবে ভালই। নতুবা সকলে মিলে চাঁদা করে শিক্ষকের জীবিকা নির্বাহের যোগ্য কিছু সম্বল সংগ্রহ করে দেওয়া দরকার। যে সমস্ত ছেলেরা দারিদ্রতার কারণে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ পড়তে পারে না, তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দেওয়া আবশ্যক। এই প্রথা বাংলাদেশ ব্যতীত অন্যান্য ইসলামী দেশে এখনও প্রচলিত আছে, যেমন- দেওবন্দ, সাহারানপুর, থানাভবন এবং অন্যান্য মাদরাসায় ছাত্রগণ নিশ্চিন্ত হয়ে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ শিক্ষা করতে পারে। আর ছেলেরা মক্তবে যতটুকু শিক্ষা করবে, ততটুকু তারা বাড়ীর মেয়েদেরকে শিক্ষা দিলে স্ত্রী-পুরুষ সকলেই কুরআন শরীফ শিক্ষা করতে পারে। যদি কেউ আমপাড়া দেখে পড়তে না পারে, তবে অন্ততপক্ষে কিছু সংখ্যক সূরা মুখস্ত পড়ে নেওয়া আবশ্যক।
কুরআনে কারীমের প্রতি ইমামে আ‘জমের আযমত
             আবু হানীফা রহ. ইজতিহাদে সবচেয়ে বড় ও বিজ্ঞ ইমাম ছিলেন। এ কারণে তাকে ‘ইমামে আযম’ বলা হয়। তিনি কুরআন শরীফের বড় আশেক ছিলেন। ছিলেন কুরআনী জ্ঞানের মহাপÐিত। কুরআন ও হাদীসের আলোকে ফিক্হের প্রবর্তন করেছেন। তিনি অত্যন্ত খোদাভীরু ও কোমল হৃদয়ের অধীকারী ছিলেন। ইলম ও আলেমদের তিনি খুবই সম্মান করতেন। কুরআন শরীফের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতি আন্তরিক অনুভব করতেন। তাদের প্রতি ছিল তার ঐকান্তিক ভালোবাসা। তাঁদেরকে খুশি করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। তাঁদের সেবায় থাকতেন উৎসর্গিত।
             একদিনের ঘটনা। তাঁর ছেলে যেদিন শিক্ষকের নিকট পবিত্র কুরআনের সবক শুরু করল, সেদিন তিনি ছেলের শিক্ষকের খেদমতে পাঁচ হাজার দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) উপঢৌকন স্বরূপ পেশ করলেন। এরপর যেদিন তাঁর ছেলে সূরা ফাতিহা শেষ করল, সে দিনও তিনি শিক্ষকের খিদমতে পাঁচ হাজার দেরহাম হাদিয়া স্বরূপ পেশ করলেন এবং অতি ন¤্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে আরয করলেন, “আল্লাহর কসম, যদি আমার নিকট এর চেয়েও বেশি দেরহাম থাকত, তবে অবশ্যই তাও আপনার খেদমতে পেশ করতাম।”

Related Posts

Leave A Comment

2 Comments

Voting Poll

Get Newsletter