নৈরাজ্য থেকে ভারসাম্যে: পরিবেশ সংকট ও কুরআনের নির্দেশনা

প্রকৃতির ধ্বংসকে মানবজাতির সামষ্টিক চরিত্র এবং বর্তমান অবস্থার উপর অন্যায্য অভিযোগ হিসেবে দেখা হয়। একটি এলাকার পরিবেশগত স্বাস্থ্য সেখানে বসবাসকারী মানুষের প্রকৃত নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। আমাদের নৈতিক ব্যর্থতা এবং বিশ্বের ধ্বংসের মধ্যে সম্পর্ক আল্লাহ কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন: "মানুষের হাত যা অর্জন করেছে তার কারণে স্থল ও সমুদ্রে দুর্নীতি দেখা দিয়েছে, যাতে তিনি তাদের কৃতকর্মের কিছু স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন, যাতে তারা ফিরে আসে।" (সূরা আর-রুম ৩০:৪১)

ইতিহাস দেখিয়েছে যে অনেক বিপর্যয় ভুল মহাজাগতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং আত্ম-পরিচয় ধারণার ফলে ঘটেছে। বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থতার ফলে মানুষ এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে যা দুঃখজনকভাবে বারবার এবং পূর্বাভাসযোগ্য ক্ষতির দিকে পরিচালিত করেছে। এই নিবন্ধটি ইসলামী ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে এই ভুল ধারণাগুলির কিছু বিশ্লেষণ করে এবং একটি স্থায়ী মানব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। লক্ষ্য হল কুরআন ও সুন্নাহে প্রদত্ত নৈতিক নির্দেশনার উপর আলোকপাত করা, যা প্রকৃতির প্রতি একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল মনোভাব নির্দেশ করে এবং যা মানবজাতির বর্তমান ধ্বংসাত্মক পথের একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে।

কুরআনে আদম ও মানবজাতির ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে:

আর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন: "আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে যাচ্ছি।" (সূরা আল-বাকারা ২:৩০)

ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করলেন:

قَالُوٓا۟ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ 

“তুমি কি সেখানে এমন কাউকে স্থাপন করবে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে? আর আমরা তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করব।”

আল্লাহ উত্তর দেন: إِنِّىٓ أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ “আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।”

এতে বলা হয়েছে: “আর তিনি আদমকে সকল নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন।” (সূরা আল-বাকারা ২:৩১)

অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে এই “নাম” আল্লাহর গুণাবলীকে নির্দেশ করে—যেমন তাঁর সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়, বিশেষ করে মানুষের মধ্যে। কুরআন আরও বলে:

“এবং আমরা তাদেরকে আকাশে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আমাদের নিদর্শনাবলী দেখাবো, যতক্ষণ না তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এটিই সত্য।” (সূরা ফুসসিলাত ৪১:৫৩)

এই আয়াতগুলি আমাদের একটি বিশ্বতাত্ত্বিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং নীতিগত কাঠামো প্রদান করে; যা আমাদের শেখায় যে আমাদের চারপাশের বিশ্বের সাথে কীভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। যদি পৃথিবী ঈশ্বরের গুণাবলীর প্রতিফলন হয়—তাহলে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা আমাদের এর যথাযথ যত্ন নেওয়া এবং এর ভারসাম্য বজায় রাখার দাবি করে। প্রকৃত কৃতজ্ঞতা দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়—এবং কৃতজ্ঞতা হল পৃথিবী এবং নিজেদের রক্ষা করার মূল চাবিকাঠি।

বাস্তব জীবনের উদাহরণ এবং পরিণতি: জলবায়ু পরিবর্তন এবং ব্যাপক দূষণ

এই নৈতিক বিচ্যুতি এবং আত্মকেন্দ্রিক পদ্ধতির বাস্তব জীবনের উদাহরণ আজ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক অংশে দেখা যায়। অনেক রাজ্য এবং অঞ্চলে, শিল্প উদ্যোগের জন্য নির্বিচারে বন ধ্বংস করা হয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে এবং অসংখ্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হারিয়ে গেছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি, স্থানীয় আবহাওয়া, জল সরবরাহ এবং কৃষিও প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত হয়েছে। গত কয়েক দশকে পৃথিবী নজিরবিহীনভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখেছে—চরম আবহাওয়া, বরফগলা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিকতা। পাশাপাশি, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া দূষণ—প্লাস্টিক দ্বারা সমুদ্র দূষণ থেকে শুরু করে ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া আকাশ পর্যন্ত—মানবস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যকে চরম হুমকির মুখে ফেলেছে। এই সংকট শুধুই বৈজ্ঞানিক বা রাজনৈতিক নয়; বরং এটি এক গভীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়। ইসলাম, একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে, এ বিষয়ে একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।

পবিত্র কুরআনে একাধিকবার মানবজাতিকে “খলিফা” অর্থাৎ পৃথিবীর রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল-বাকারা (২:৩০) তে আল্লাহ বলেন: “আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করবো।” এই খিলাফত একটি দায়িত্ব, মালিকানা নয়। পৃথিবী আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আমানত, যার অপব্যবহার বিশ্বাসঘাতকতার সামিল।

সূরা রূম (৩০:৪১) এ আল্লাহ বলেন: “মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও জলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিছু স্বাদ আস্বাদন করান, যেন তারা ফিরে আসে।” এই আয়াত মানবসৃষ্ট দূষণের প্রতিফলন তুলে ধরে এবং নৈতিক প্রতিক্রিয়ার প্রতি আহ্বান জানায়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন প্রকৃতি ও পরিবেশের এক আদর্শ রক্ষক। তিনি প্রবাহমান নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ওজু করলেও পানি অপচয় করতে নিষেধ করতেন। তিনি গাছ লাগানোকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, “যে মুসলমান একটি গাছ রোপণ করে, এবং তাতে পাখি, মানুষ অথবা পশু খায়, তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হয়।” (বুখারী)

তবে দুঃখজনকভাবে আধুনিক সমাজ, লোভ, ভোগবাদ এবং অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের কারণে কুরআনে নির্ধারিত ‘মীযান’ তথা ভারসাম্য থেকে দূরে সরে গেছে। সূরা আর-রহমান (৫৫:৭-৯) এ বলা হয়েছে: “তিনি আকাশকে উচ্চে স্থাপন করেছেন এবং ভারসাম্য নির্ধারণ করেছেন, যাতে তোমরা ভারসাম্যে সীমালঙ্ঘন না করো।”

ইসলামী দৃষ্টিতে, জলবায়ু পরিবর্তন কেবল বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক সংকট নয়; এটি এক আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জাগরণ। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজের জীবনধারা, খরচ ও প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করা। পরিবেশ রক্ষা করা শুধুই দায়িত্ব নয়, বরং এটি আল্লাহর সৃষ্টি রক্ষার মাধ্যমে ইবাদতের একটি রূপ।

জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ইসলামী সমাধান

জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ মানে কুরআন ও সুন্নাহর মূল নীতিগুলোতে ফিরে যাওয়া। ইসলাম এমন একটি নৈতিক কাঠামো প্রদান করে যা ভারসাম্য, মিতব্যয়িতা ও ইনসাফের শিক্ষা দেয়—এসবই পরিবেশ রক্ষায় অপরিহার্য।

প্রথম ও প্রধান করণীয় হলো খিলাফতের ধারণা পুনর্জাগরণ। মুসলমানদের উচিত নিজেদেরকে আল্লাহর প্রতিনিধির ভূমিকায় দেখে সক্রিয়ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, অপচয় রোধ এবং টেকসই জীবনধারা অনুসরণ করা। এর বাস্তব উদাহরণ হতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে সমর্থন, বাড়িতে বিদ্যুৎ ও পানির সাশ্রয়, এবং সবুজ প্রযুক্তি প্রয়োগ।

দ্বিতীয়ত, ইসলাম মিতব্যয়িতা (ওয়াসাতিয়াহ)-এর উপর জোর দেয়। কুরআনে বলা হয়েছে: “তোমরা অপচয় করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আনআম ৬:১৪১) এটি ভোগবাদিতা ও অতিরিক্ত খরচের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা। ইসলাম সরল, পরিতৃপ্তিপূর্ণ জীবনযাপনকে উৎসাহিত করে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ধারণা হলো মীযান—আল্লাহর সৃষ্টিতে যে ভারসাম্য বিদ্যমান। এ ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা পরিবেশ রক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। এর মধ্যে পড়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, নদীনালা রক্ষা, বনভূমি রক্ষা এবং কার্বন নির্গমন হ্রাস।

ইসলাম সামষ্টিক কল্যাণ (মসলাহা আম্মা)-কে গুরুত্ব দেয়, যাতে বিশুদ্ধ পানি, বায়ু ও মাটি অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী ফিকহে ব্যবহৃত হিশবা (প্রশাসনিক তদারকি) ও উরফ (রেওয়াজ) প্রয়োগ করে পরিবেশবান্ধব আইন প্রণয়ন ও জনসচেতনতা বাড়ানো যায়।

তাছাড়া, ইসলামী অর্থনীতি—বিশেষত শরীয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ ও মাইক্রোফাইন্যান্স—সবুজ উদ্যোগ ও স্থানীয় টেকসই কৃষিকে উৎসাহিত করতে পারে।

মাদ্রাসা, মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। খুতবায় পরিবেশ নিয়ে আলোচনা, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং পরিবেশবিষয়ক শিক্ষাদান মুসলমানদের মধ্যে পরিবেশ-সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে।

আন্তর্জাতিকভাবে, মুসলিম দেশগুলো ইসলামিক নীতির ভিত্তিতে পরিবেশগত নীতি প্রণয়ন করতে পারে। OIC ও অন্যান্য সংগঠন এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচারাভিযান ও আন্তর্জাতিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, জলবায়ু সংকটের সমাধান ইসলামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে—আল্লাহর সৃষ্টি সংরক্ষণ, ভারসাম্য রক্ষা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যন্ত, সকল মুসলমানের উচিত ইসলামী নীতির আলোকে একটি পরিবেশবান্ধব জীবন গঠন করা।এই ক্ষতি কেবল প্রকৃতির উপরই নয়, পরিণামে মানুষের উপরও - খাদ্য ঘাটতি, পানির ঘাটতি, রোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে। এটি আল্লাহর নিদর্শনগুলির প্রতি অবজ্ঞা এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি অবজ্ঞার প্রতিফলন। মানবতার কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসের প্রকৃত প্রকাশ তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা এবং লালন-পালনের মাধ্যমেই হওয়া উচিত। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমরা কেবল এই পৃথিবীর মালিক নই, বরং এর খলিফাও - যাদের দায়িত্ব সৃষ্টি বজায় রাখা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। অতএব, প্রকৃতির প্রতি এই দায়িত্ব, সচেতনতা এবং কুরআনের নীতি অনুসরণ করেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারি।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter