শিক্ষাই শক্তি: শেরে বাংলা ফজলুল হকের জীবনে শিক্ষা ও সমাজ ভাবনা

এ কে ফজলুল হকের পূর্ণ নাম আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি “শেরে বাংলা” (বাংলার বাঘ) নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য তিনি ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষাবিষয়ক নেতা। ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠায় তিনি জীবনের প্রায় পঞ্চাশটি মূল্যবান বছর উৎসর্গ করেছিলেন।

তিনি ১৮৭৩ সালে বাকেরগঞ্জ জেলার এক মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুহাম্মদ ওয়াজেদ ছিলেন একজন আইনজীবী এবং দাদা কাজী আকরাম আলী ছিলেন একজন মুখতার ও আরবি-ফরাসি ভাষার পণ্ডিত।

এ কে ফজলুল হকের শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার প্রয়াস

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জীবনচরিতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি গভীর অনুরাগ। ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং ইসলামের মূল গ্রন্থ, আল-কুরআনের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। একজন বাঙালি মুসলমান হিসেবে উনিশ শতকের শেষভাগে এবং বিশ শতকের শুরুতে তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল যুগান্তকারী, যা তৎকালীন সমাজে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত।

তিনি ১৮৭৩ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জ জেলার এক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, অনুসন্ধিৎসু ও অধ্যবসায়ী। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি কলকাতায় এসে ভর্তি হন বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে, যেটি ছিল তৎকালীন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে তিনি এফ.এ (বর্তমানে সমমান এইচএসসি) পরীক্ষায় ডিস্টিংশনসহ উত্তীর্ণ হন, যা তাঁর প্রতিভার প্রাথমিক স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজেই তিনি রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও গণিতে ট্রিপল অনার্স নিয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (বি.এ.) ডিগ্রি লাভ করেন। এটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ ও চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়সংযোজন, যা থেকে বোঝা যায়, তিনি শুধুমাত্র মেধাবী নন, বরং উচ্চস্তরের জ্ঞান অন্বেষণে আত্মনিবেদিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন, যা তৎকালীন মুসলিম সমাজে এক বিরল অর্জন। গণিতের মতো একটি কঠিন বিষয়ের উপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তিনি কেবল পাণ্ডিত্য অর্জনই করেননি, বরং মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে ওঠেন।

শুধু বিজ্ঞান ও গণিতেই নয়, তিনি ইংরেজি, আরবি, ফারসি ও বাংলাতেও দক্ষ ছিলেন। এই বহুভাষিকতা তাঁর চিন্তাকে বহুমাত্রিক করে তোলে এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে তাঁকে এক দূরদর্শী নেতা হিসেবে গড়ে তোলে। ১৮৯৭ সালে তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে একজন ব্যারিস্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় মুসলিম, যিনি এই উচ্চতর আইন শিক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

জ্ঞানচর্চার প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও অবদান

ফজলুল হক বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা হলো জাতির মুক্তির একমাত্র পথ। মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন শিক্ষার অভাবকে। সেই চিন্তা থেকেই তিনি শুধু নিজের শিক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং সারা জীবন মুসলিম সমাজের শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সহায়তায় ও উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়—কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ), মুসলমানদের উচ্চশিক্ষায় অগ্রসর করার অন্যতম প্রতিষ্ঠান, রাজশাহীতে আদিনা ফজলুল হক কলেজ, যার মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দুয়ার খুলে যায়, ঢাকায় ইডেন গার্লস কলেজ ভবন, যা মুসলিম নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেল, যাতে মফস্বলের শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষার সুবিধা পান। তিনি ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুহাম্মদান এডুকেশনাল কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন, যা মুসলমানদের শিক্ষা প্রসারের জন্য এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ ছিল। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে মানবিক চেতনার সংযোগ স্থাপন। তিনি শিক্ষাকে কেবল পুঁথিগত বিদ্যা হিসেবে দেখেননি, বরং সামাজিক পরিবর্তন ও জাতীয় জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন।

স্বদেশ ও জাতির কল্যাণে তাঁর অবদানের জন্য ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জাতীয় ইতিহাসে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী। স্বাধীনতার চেতনা ও গণতান্ত্রিক বোধ জাগ্রত করতে তাঁর অসামান্য অবদান দেশের মানুষ কখনোই ভুলবে না। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আগামী প্রজন্মের রাজনীতিকদের জন্য একটি আদর্শ হয়ে থাকবে। তিনি দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেছেন। রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা ও কৃষিসহ দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একজন সহজ-সরল জীবনযাপনকারী ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি রাজনীতিতে আসেন। তিনি ছিলেন তাঁদের প্রতি সদয় ও ভদ্র আচরণকারী। মুসলিম লীগের একজন প্রধান নেতা হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের দুরবস্থার মূল কারণ শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ, আর উন্নয়নের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য।

তাঁর প্রচেষ্টায় ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন—কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ, রাজশাহীতে আদিনা ফজলুল হক কলেজ, ঢাকায় ইডেন গার্লস কলেজ ভবন, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেল ইত্যাদি।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান

১৯০৬ সালের ২৭ থেকে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুহাম্মদান এডুকেশনাল কনফারেন্সে তিনি অংশ নেন। এই সম্মেলনের ফলস্বরূপ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালে তিনি বাংলার শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত মোট ২১ বছর আইন পরিষদে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯১৭ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯১৮ সালে সাধারণ সম্পাদক হন। একই বছরে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি এবং কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব একযোগে পালন করেন। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যকার ঐতিহাসিক লখনউ চুক্তি প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯২৯ সালে তিনি অল বেঙ্গল টেন্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হন এবং ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন।

এ কে ফজলুল হক ছিলেন এক খাঁটি বাঙালি ও খাঁটি মুসলমান। তাঁর ব্যক্তিত্বে বাঙালি ও মুসলিম পরিচয়ের এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়, যা ভবিষ্যতের বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবনার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। তিনি সেই মিলনের প্রতীক।

স্বাস্থ্য অবনতির কারণে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল, শুক্রবার, ৮৯ বছর ৬ মাস বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন এবং শ্রদ্ধা জানাতে সেদিন সকল অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter