পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসরণ বন্ধ করুন এবং ইসলামী ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরুন।

মুলত হীনমন্যতার কারণেই মুসলিম সমাজে পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায়, ঔপনিবেশিক শাসন, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং আধুনিক শিক্ষার ইউরোকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিমদের আত্মপরিচয়ে সংকট তৈরি করে। এর ফলে তারা নিজেদের দুর্বলতার জন্য ইসলামকেই দায়ী করতে শুরু করে। পশ্চিমাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, ক্ষমতার দাপট এবং বাহ্যিক চাকচিক্যের সাথে দুর্বল ও বিভক্ত মুসলিম বিশ্বের তুলনা করে মুসলিম যুবসমাজ পশ্চিমা মডেলকেই উন্নতির একমাত্র রাস্তা বলে মনে করতে থাকে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটা হীনমন্যতার একটি রূপ, যেখানে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে পরাধীন মানসিকতা তৈরি হয়। ইতিহাস প্রমাণ করে যে মুসলিম সভ্যতা একসময় বিজ্ঞান, চিকিৎসা, দর্শন ও প্রশাসনে বিশ্বনেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু আত্মসমালোচনার অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং জ্ঞানচর্চা থেকে সরে আসার কারণে মুসলিম সমাজ পিছিয়ে পড়ে। আজকের দিনে মুসলিমদের জন্য প্রয়োজন নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ওপর আস্থা রাখা, ইসলামি শিক্ষার মৌলিক আদর্শে ফিরে যাওয়া এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের পথ তৈরি করা, অন্ধ অনুকরণের নয়। এজন্য শিক্ষা, গবেষণা এবং আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠনের মাধ্যমে বাস্তবিক উন্নয়ন সম্ভব।

উন্নয়ন মানে ঐতিহ্য এড়িয়ে যাওয়া নয়

মুসলিম উম্মাহর বিশ্বপুনর্জাগরণের পূর্বশর্ত হলো নিজেদের আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার জাগরণ। বর্তমান বিশ্বে বহু মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজ নিজেদের দ্বীন, জীবনব্যবস্থা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাব এত গভীর হয়েছে যে, অনেকেই মনে করে উন্নত হতে হলে নিজের দ্বীনী ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বিসর্জন দিতে হবে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, মুসলিম জাতি সেই জাতি, যারা একসময় জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সাহিত্য, দর্শন, এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ইবনুল হায়থাম আলোকবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, ইবন সিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন, ইবন খালদুন সমাজবিজ্ঞানের প্রথম তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছেন, এবং আল-বেরুনি ভূগোল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। এরা প্রত্যেকেই দ্বীনকে লজ্জাজনক কিছু নয়, বরং শক্তির উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

আজকের মুসলিমদেরও এ ইতিহাস স্মরণ করে নিজেদের স্বকীয়তা নিয়ে গর্ববোধ করা জরুরি। আত্মগ্লানিতে ভোগা কোনো জাতি কখনো উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। যে জাতি নিজের পরিচয় নিয়ে সংকোচ বোধ করে, অন্য জাতিগুলোও তাকে অবজ্ঞা করে। আত্মমর্যাদার শক্তি থেকেই আসে আত্মবিশ্বাস, আর আত্মবিশ্বাস ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়। কুরআন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য উদ্ভূত হয়েছো।” (সূরা আল-ইমরান ৩:১১০)। মুসলিমদের অবশ্যই এই মর্যাদাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে হবে এবং বীরের মতো নিজেদের পরিচয় বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে।

আধুনিক দৃষ্টান্তও আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। মালয়েশিয়া এবং তুরস্কের মতো কিছু দেশ নিজেদের মুসলিম পরিচয় অটুট রেখেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ মুসলিম সমাজকে পশ্চিমা অনুকরণ ছাড়াই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। তিনি মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস জাগাতে বলেছিলেন যে, উন্নতি মানে পশ্চিমা হওয়া নয়, বরং নিজেদের আদর্শিক ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে উন্নত হওয়া।

আজকের মুসলিম উম্মাহ এমন এক চরম আত্মবিস্মৃতির যুগ অতিক্রম করছে, যেখানে নিজেদের দ্বীন ও সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য যেসব বহিরাগত প্রবল জলধারা আঘাত হানছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমরা নিছক দর্শক হয়ে গেছি। আমরা সেই সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ মানবীয় দর্শন — ইসলামী জীবনবিধান — কে ছুড়ে ফেলেছি, যার শক্তিতে এক সময় গোটা দুনিয়া আলোচিত হয়েছিল। আমাদের পূর্বসূরিরা তাদের ঈমানকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য শক্তি হিসেবে ধারণ করতেন, যার জন্য তাঁরা কষ্ট স্বীকার করতেন, যুদ্ধ করতেন, জীবন বিলিয়ে দিতেন। আজ আমরা সেই ঈমানকে কথায় স্বীকার করি, কিন্তু কাজে মিথ্যা প্রতিপন্ন করি।

সুন্নাতুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসূল আঁকড়ে ধরুন

আমরা দ্বীন নিয়ে লজ্জাবোধ করি, অথচ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনগণ দ্বীনের জন্য গর্ব অনুভব করতেন। আল্লাহর প্রতি ঈমান ছিল তাদের বুকের আগুন, যা তাদেরকে অন্ধকার বিশ্বে আলোকবর্তিকা করে তুলেছিল। হযরত ওমর (রা.) ঘোষণা করেছিলেন, “আমরা এমন এক জাতি, যাকে আল্লাহ ইসলাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন। যদি আমরা অন্য কোনো জিনিসের মধ্যে সম্মান খুঁজতে যাই, আল্লাহ আমাদের অপমানিত করবেন।” আজ আমরা ঠিক সেই অপমানিত অবস্থার মধ্যে আছি, কারণ আমরা নিজেদের পরিচয় ভুলে গেছি।

আমাদের পূর্বসূরিরা স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন; তাঁরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁরা বিশ্বব্যাপী ন্যায়, সাম্য ও আলোকিত জ্ঞানের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) যখন খিলাফতের দায়িত্ব নিলেন, তিনি বলেছিলেন, "দুর্বলদের মধ্যে তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সেই দুর্বলই শক্তিশালী, যতক্ষণ না আমি তার হক আদায় করে দিই।" এমন আত্মত্যাগী নেতৃত্বের তুলনায়, আমরা আজ আত্মকেন্দ্রিক, ছোটখাটো স্বার্থে বিভক্ত, নিজেদের ছোট সফলতাকেই বড় গর্ব মনে করি।

পূর্বসূরিরা পূর্ণতার অধিকারী ছিলেন। তারা ঈমান, আমল, চরিত্র ও জ্ঞান — সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ এক আদর্শ গড়েছিলেন। তাদের জীবনে কৃত্রিমতার কোনো স্থান ছিল না। তাদের চিন্তা ছিল মহৎ, দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। আজকের মুসলিম উম্মাহর অনেক ক্ষেত্রেই সেই অন্তসারশূন্যতার করুণ চিত্র দেখা যায় — বাহ্যিক আড়ম্বরের মাঝে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা অনুপস্থিত। আমাদের মসজিদ বড়, কিন্তু হৃদয় সংকীর্ণ; আমাদের পোশাক ইসলামী, কিন্তু চরিত্র বিকৃত; আমাদের কণ্ঠে আল্লাহর নাম, কিন্তু কাজে শয়তানের অনুসরণ।

এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে এখনই মুসলিম উম্মাহর জাগরণ প্রয়োজন। প্রয়োজন আবার সেই সাহাবায়ে কেরামদের মতো ঈমানের জীবন অনুভব করা, নিজেদের স্বার্থ ভুলে গিয়ে মানবতার জন্য আল্লাহর বাণী ছড়িয়ে দেওয়া। প্রয়োজন দ্বীনের ওপর গর্ব করার, প্রয়োজন নিজেরা পরিপূর্ণ হওয়ার। আর এই জাগরণ একদিনে আসবে না; এটি শুরু করতে হবে প্রতিটি ব্যক্তির আত্মবিশ্লেষণ থেকে, পরিবারের ভিতরে দ্বীনি পরিবেশ গড়ে তুলে, সমাজে দ্বীনের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে।

আল্লাহর বাণী আমাদের স্মরণ রাখতে হবে:

"নিশ্চয়ই, আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।" (সূরা রা'দ: ১১)

এখন সময় এসেছে, আমরা আমাদের অন্তসারশূন্যতা কাটিয়ে ঈমানের পূর্ণতায় নিজেদের গড়ি, আল্লাহর দ্বীনকে বীরের মতো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরি, এবং আবার সেই শ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদা পুনরুদ্ধার করি।

শেষকথা

মুসলিমরা আজ যে- সম্যসার সম্মুখীন, তার সাথে তুলনা দেওয়া যায় একজন মুসাফিরের। যে কিনা সফর করতে করতে এমন এক রাস্তায় এসে পৌছাছে , যেটা আড়াআড়ি ভাবে চলে গিয়েছে দুই দিকে । চাইলে সে ওখানটাতেই দাড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এর ফলাফল হল অনাহারে ধুকেধুকে মরণ। আবার পাশ্চাত্য সভ্যতার দিকে যে -পথ চলে গিয়েছে , সেটা ধরেও সে অগ্রসর হতে পারে । কিন্তু এর মধ্যমে তাকে তার অতীত জীবনটাকে চিরকালের জন্য বিদায় জানাতে হবে। অপর পথটি চলে গিয়েছে সত্যিকার ইসলামের দিকে । সে চাইলে এটিও বেছে নিতে পারে। কিন্তু এই পথ শুধু তাদেরকেই আহব্বান করে, যারা নিজেদের অতীতে বিশ্বাসী। পাশাপাশি সেই অতীতকে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতে রূপান্তর করতে চায়। তাই মুসলিম উম্মাহর সামনে এখনকার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো — দ্বীনের আলোয় নিজেদের পরিচয়কে চেতনাবান করা, অন্য কোনো সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে ফেলা বা নকল না করে নিজেদের মৌলিকত্ব বজায় রাখা। এ চেতনা ছাড়া কোনো সত্যিকারের পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter