বাঙালি মুসলিম শিক্ষার বর্তমান অবস্থা: সমস্যা এবং সমাধান
ভারত স্বাধীনতার ৭৬ বছর পেরিয়ে গেলো, কিন্তু মুসলমান সমাজে - দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা - বিশেষ কোনো মাত্রিক বিকাশ প্রতক্ষ করা যায় না। যদিও বিভিন্ন সরকারী, সামাজিক এবং সংগঠনিক কর্মকোলাপ চলছে, তাবও কিন্তু এর ফলাফল ব্যাপক মাত্রায় দেখা যায়নি। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ করে পূর্ব রাজ্য পশ্চিম বঙ্গ মুসলমানদের অবস্থা একেবারে শোচনীয়, যার দ্রুত নিরাময় উপায় অনুসন্ধান করা আবশ্যক।
তথ্য সংক্রান্ত
বৈশিক স্তরে বাঙালি মুসলিম আরবদের পরে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগত গোষ্ঠী। দেশীয় স্তরে বাঙালি মুসলমান - যা এই প্রবন্ধের বিষয় - ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ২৫.২৫ শতাংশ। যেখানে তারা রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার এই যে এত বিশাল জনসংখ্যা সঠিক মানসম্পন্ন শিক্ষার বঞ্চনায় ভুগছে যা তাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংগঠন, সামাজিক মান ও মর্যাদার সমগ্র স্তরকে ঋণাত্মক মাপে প্রভাবিত করেছে।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সাক্ষরতার হার মোটামুটি ৬৮ শতাংশ। যদিও পরিমাপ অর্ধশতাংশের উর্ধে, তবুও এটি কিন্তু রাজ্যের মুসলমানদের এক চরম শূন্যতা অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। ড্রপআউটের রিপোর্ট (২২%) অত্যন্ত আতঙ্কজনক। 'হাফ বেকড চিকেন' হওয়ার প্রক্রিয়া লিঙ্গ ভিত্তিক পরিসংখ্যানে পরিষ্কারভাবে স্পষ্ট। শিক্ষা ব্যাবস্থায় নারী ও পুরুষের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য এই পর্যালোচনাতে বিস্তৃত করার একটি অপরিহার্য বিষয়।
প্রাথমিক বনাম উচ্চশিক্ষা: আসল বিপত্তি
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষায় মুসলিম শিক্ষার একটি সুন্দর চিত্র পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে মুসলিম ছেলে-মেয়ের অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ না হলেও যথেষ্ট। উক্ত সফলতা থেকে এক পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যে তাদের নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার হরে হ্রাসের অবনতির মান দেখে এই ধারণার স্বপ্ন ভেঙে যায়। সফলতা উদযাপন তখনই হবে যখন শুধু সমীক্ষায় নয়, বাস্তবিকতায়ও ভালো ফল দেখা যাবে। আর তা সম্ভব যখন তাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষা দেয়া হবে। বেশিরভাগ বাঙালি শিক্ষার্থী সাধারণত এই দুটি স্তরে প্রাথমিক জ্ঞানও পেতে সক্ষম হয় না। পরিস্থিতি দেখে এমন মনে হচ্ছে যে রাজ্যে মুসলিম উচ্চশিক্ষা সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। বর্তমানে, মুসলিম ছেলে মেয়ে উভয়ই পারিবারিক দায়দায়িত্ব, বাল্যবিবাহের এবং অনুরূপ কারণে উচ্চ উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যেতে পারছেনা। এই ক্ষেত্রে, সরকার এবং অন্যান্য সামাজিক তত্ত্বাবধায়কদের কার্যকর সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।
উচ্চশিক্ষা থেকে মুসলিম নারীদের বঞ্চিত হওয়ার পেছনে সম্ভাব্য আরও কিছু কারণ বিভিন্ন্য মুসলিম ছাত্র কাজ করতে সক্ষম হওয়ার সাথে সাথে তার পরিবারের অস্থিরতা দেখে শিক্ষার সম্পর্ক ভেঙে দেয় কারণ। তারপর সে পরিবারের আর্থিক দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে ফেলে। অর্থাৎ, শিক্ষা ছেড়ে তাকে উপার্জনের রাস্তায় ঢুকে পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত, তারা কেরালা, তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্রের মতো অন্যান্য রাজ্যে শ্রমের জন্য পারি দিচ্ছে। শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় নয়, কাজের জন্য মহানগরী মুসলিম যুবকদের প্রধান গন্তব্য। এমনকি মুসলিম নারীদেরও বিরি তৈরির মতো বহিরাগত বিভিন্ন গৃহস্থালির কাজ এবং ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। সমস্যা এই যা, শিক্ষা লক্ষ্য বিন্দু থেকে হতে যাচ্ছে। মোট কোথায়, মুলসিম সমাজে ছেলে-মেয়ের শিক্ষার পথে একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আর্থিক সংকট।
সরকারি সচেতনতা
মেয়ের মাধ্যমিক শেষ হতে না হতেই তার পরিবারের সামনে বিবাহ-ভয় দেখা দেয় যেহেতু সমাজে প্রচলিত উচ্চ যৌতুকের জঘন্য প্রক্রিয়া। তাই একজন বাবা যখন স্বাচ্ছন্দ্য বিবাহ প্রস্তাব খুঁজে পায়, তখনই সে ভবিষ্যত পরিকল্পনা ভুলে মেয়ের বিয়ে ব্যাপারে এগিয়ে যায়। অমুসলিম নারীদের বিপরীতে মুসলিম নারীদের শিক্ষার গতি হওয়ার আরেকটি যুক্তিসঙ্গত কারণ হল সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। যদিও ইসলামি তত্ত্বানুসারে পুরুষ নারী উভয়েরই জন্য শিক্ষা প্রয়োজন, কিন্তু মুসলিম সমাজ আধুনিকতার সঙ্গে শিক্ষা পরিকাঠামো গঠন করতে পারেনি। তাছাড়া, মুসলমানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি কিছু অসচেতনতাও দেখা যায়।
রাজ্যে একটি মুসলিম জনসখ্যার অবস্থান। তাছাড়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর এবং উত্তর ২৪ পরগণার হচ্ছে কিছু মুসলিম জনবহুল জেলা। এই মুসলিম কেন্দ্রীভূত এলাকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা খুবই বিরল। তবুও, এই অঞ্চলের অধিকাংশ কলেজ নিম্ন ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক বিবেচনায় চলছে। রাজ্যের প্রায় প্রাইভেট টিউশন স্কুলের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। সরকারী বেতনভুক্ত শিক্ষক হিসেবে তারা যা করেন না, তারা টিউশন মাস্টার হিসেবে করেন। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাইভেট টিউশনে যে পরিমানে শিক্ষা পায় আসলে তাদের স্কুলে একই শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া উচিত।
রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি বৃত্তি প্রদান করে মুসলিম শিক্ষার সমস্যাগুলি প্রশমিত করার জন্য প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ফলে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল ও মাদ্রাসায় মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম নারীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে রাজ্য সরকার বিশেষ পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। উচ্চ শিক্ষার জন্যও একই উৎসাহ প্রয়োজন।
বর্তমান সমাধান
বাস্তবে মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থা অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় অনেক উন্নত এবং ইতিহাস সাপেক্ষ। তাত্ত্বিক এবং ব্যাবহারিক স্তরে ইসলামের কর্মাবলী সবই জ্ঞানের উপর ভিত্তি। কিন্তু ভবিষ্যৎ বদলে যায় যখন তারা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং সংস্কারের সাথে মোকাবিলা করা ছেড়ে দেয়। এমনকি গণতান্ত্রিক সরকারগুলিও যথেষ্ট কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সমান শিক্ষার অধিকারের সত্ত্বেও তারা পিছিয়ে। এখনও, মুসলমানদের সুযোগ ভুরি ভুরি, কিন্তু উদ্যোগতা নেয়। প্রথমত, শিক্ষার সুযোগ তাদের ঐতিহ্য থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যুক্ত। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় গণতান্ত্রিক সংবিধান শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। দুর্ভাগ্যক্রমে, দুই ক্ষেত্রেই বর্তমান মুসলমান সমাজ পিছিয়ে। ফলতঃ, অশিক্ষার পরিণীতি তাদের প্রাত্যহিক জীবনে। সংস্কার না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও সঞ্চালন হতে পারে। সরকার এবং স্বাধীন সংস্থা সঠিক অভিসন্ধি নিয়ে উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায় মিশন স্কুলের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, আল-আমীন মিশন শিক্ষাগত ধারায় মুসলমানদের ক্ষমতায়নে একটি যুগান্তকারী মার্ক অর্জন করেছে। তবুও এটি আংশিক অর্জন যা সম্প্রদায়ের উচ্চ এবং নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে একটি সরল রেখা টেনে দিয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার ব্যবসা আরম্ভ হয়েছে। বঞ্চিত পরিবার শিক্ষার জন্য একটি মিশনের বার্ষিক ব্যয় বহন করতে পারে না। দারিদ্রতা আবার মুসলিম শিক্ষার উন্নতির জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রবণতার পরিবর্তন হওয়া চায়।
এই দৃষ্টিকোণ ছাড়াও, কেরালা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করা যেতে পারে। কারণ এই কাঠামে ধর্ম এবং পার্থিব শিক্ষার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই জ্ঞানের একটি সমন্বিত রূপ প্রদান করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মানসম্পন্ন ধর্মীয় ও বস্তুগত জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করে দারুল হুদা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এই শিক্ষা ব্যবস্থার একটি প্রতীকী অংশ। সুফী-বিজ্ঞানী ড. মুনকির হোসেন সাহেবের প্রচেষ্টায় বীরভূম জেলার ভীমপুর গ্রামে বাংলার মাটিতেও এই দারুল হুদা জ্ঞান আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। বিকল্প উপায় আগামী গণনায়।