ইসলাম ও নারীবাদ ইসলামী দৃষ্টান্তে কতটা প্রযোজ্য?

বিগত কয়েকদিন থেকে পুরো দেশ গর্জে উঠেছে আর জি কর গনধর্ষনের বিরুদ্ধে। ঠিক যেমন এর পূর্বেও গর্জে উঠেছিল নির্ভয়া কান্ডের বিপক্ষে। অদ্য বিশ্বে প্রতিনিয়ত এমনই নানাবিধ নারীদের উপর হিংস্রতা, বর্বরতা, নির্মমতা, নিষ্ঠূরতা, গনধর্ষন, অপহরণ, যৌননিগ্রহ, নিপীড়ন, জ্বালাতন অব্যাহত। নারীরা যেন আজ সমাজে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, পদদলিত, অবহেলিত। জোরতালে নাই কোনো লিঙ্গ ভিত্তিক তাদের সমতা। যা দৃষ্টিপাত করে মনে হচ্ছে যেন পুরুষরা আজ মানুষ রূপে পশুত্বের রূপ ধারন করছে। যার জেরে, এমতাবস্থায় বিগত কয়েক দশক পূর্ব থেকে নারীদের অধিকার ও মর্যদা ফিরিয়ে দিতে নতুন এক মতবাদ বের করা হয়েছে যা নারীবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এই নারীবাদের প্রকোপ আজ সারা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছে। অধিকাংশ নারীই অদ্য দাবি করে, আমি একজন নারীবাদী। কিন্তু কী এই নারীবাদ? ইসলামই বা এর প্রসঙ্গে  কী বলে? এই নিবন্ধে সমুদয় প্রশ্নগুলির উত্তর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নিবন্ধটি সম্পূর্ণ করতে লেখক বিভিন্ন গ্রহনযোগ্য গ্রন্থপঞ্জী ব্যবহার করেছেন। 

নারীবাদকে ইংরেজিতে feminism (ফেমিনিজম) ও আরবি ভাষায় نِسْويّة (নিসয়িয়্যা) বলা হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, নারীবাদ হচ্ছে এমন এক মতবাদ যা লিঙ্গ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমতার কথা। অর্থাৎ, নারীদেরও  সর্বক্ষেজ্ঞে পুরুষের ন্যায় সমান পদমর্যদা, অধিকার প্রদান করা, হোক সেটি চাকুরিজীবির ক্ষেত্রে নতুবা কোনো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিংবা সামাজিক ক্ষেত্রে।  কিন্তু চাকরি পেতে বা রক্ষা করতে নিজেকে পন্য হিসাবে ব্যবহার করার মত অসৎ পথ অবলম্বন করাকেই কী বলে নারীবাদ? সিনেমা, থিয়েটার, বিজ্ঞাপন, পত্র-পত্রিকায় নগ্ন-অর্ধনগ্ন অবস্থায় উপস্থাপন করাকেই কী বলে নারীবাদ? একজন সুন্দরী মেয়েকে ঘর থেকে বাইরে এনে দুই পুরুষের মাঝখানে, নাইটক্লাবে, বাসস্টান্ডে, নদীর কুলে, রেষ্টুরেন্টে, অডিটোরিয়ামে, পার্কে, মেলায়, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বসতে দেওয়াই কি নারী স্বাধীনতা? কড়া মেকাপে সেজেগুজে বিমানবালা হয়ে যাত্রীদের সেবা করা, খাবারের ট্রে ঠেলে এনে খাবার পরিবেশন, শপিং মলের মত বিভিন্ন দোকানে দিনরাত দাড়িয়ে থেকে, কোন অফিসের বসের কিংবা স্কুলের হেডের অথবা মোবাইল কোম্পানির জবে কাস্টমারদের ফোন রিসিভ করে নোংরা গালিগালাজ কড়া কথাতেও অতি স্বাভাবিক থেকে মধুর সুরে ইয়েস স্যার, সরি স্যার বলার মত কাজগুলোকেই কী বলে নারী ক্ষমতায়ন? 

অতএব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, নারীবাদ ইসলামোফোবিয়াকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার এক অন্যতম চক্রান্ত ছাড়া কিছুই নয়। ইসলাম ধর্ম মেয়েদেরকে ছেলেদের মতো সমান অধিকার দেয়নি, বিয়ে মানে পরাধীনতা, স্বামী সেবা, সন্তান পালন, নারী অতএব দাসী, ছেলে জন্মানোর মেশিন, পর্দা মানেই বন্দী পাখি এমনই নানাপ্রকার মিথ্যা অপবাদ মহিলাদের মনে গড়ে তুলা হচ্ছে।“পর্দা প্রথা মানবো না, বন্দী ঘরে থাকবো না”, “জান (নারী) -জিন্দেগী (জীবন)- আযাদি (স্বাধীনতা)”-এর মতো আন্দোলন চালানো হচ্ছে। তাদের ব্রেন ওয়াশ করে বোঝানো হচ্ছে, ক্যারিয়ার গঠন হলো মুখ্য বিষয়। পরিশেষে নারীদের পিতা বা স্বামীর সুশীতল রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে রাস্তা ঘাটে কঠোর রৌদ্রে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে।

তাই তো ইসলাম দ্ব্যর্থহীনভাবে লিঙ্গ সমতার বিরোধী এবং এই নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেননা কুরআন বলছে , “আর পুরুষ নারীর মত নয়“ [৩:৩৬], “তাদের উপর (স্ত্রীদের) পুরুষদের মর্যদা (শ্রেষ্ঠত্ব) রয়েছে।“ (২:২২৮) এই দুইটি আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পুরুষরা নারীর চেয়ে শক্তিশালি ও মর্য়াদাপূর্ণ। এরই হেতু অসংখ্য নবী ও রসূলদের মধ্যে একজনও নারী ছিলেন না।

তবে একটি জাতির প্রায় অর্ধাংশ নারী। জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অচল করে রাখা আর এক পায়ে হাঁটার চেষ্টা করা একই কথা। সে জাতির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম নারী ও পুরুষের অংশগ্রহনের একটি সুন্দর সমন্বয় সাধন করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীও পুরুষের মতোই একই জীবন সত্বা হতে সৃষ্ট, একই বংশ থেকে উদ্ভূত অর্থাৎ পৃথিবীর সকল নারী-পুরুষ একই আদম সন্তান। মৌলিকতার দিক দিয়ে ইসলাম নারী পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখেনি। অর্থনৈতিক মর্যদা, ব্যক্তিগত সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার, ধর্মীয় মর্যদা, স্বামী নির্বাচন, বিবাহবিচ্ছেদ, সদাচরন পাওয়া, পুনর্বিবাহ, মোহর, ভরন-পোষণ, জীবনে নিরাপত্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা ও নাগরিক অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে ইসলাম নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। অপরপক্ষে উত্তরাধিকার ও সাক্ষ্যের মত কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্যের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হলেও ইসলাম তাদের এরও সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। যা প্রতিষ্ঠিত করেছে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা। যেহেতু দুটো মানুষের দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্র আলাদা। দুটো মানুষের শারীরিক গঠন প্রকৃতি, শারীরিক শক্তি, ধরন ধারন আলাদা। তাহলে এই দুটি মানুষের ক্যারিয়ার একই হবে কী কারণে বা কোন হিসেবে? কিছু ক্ষেত্রে ওদের দায়িত্ব আলাদা কিন্তু দুজনই মানুষ। আমলের দিক থেকে দুজনেই সমান। এমনকি কখনও কখনও দেখা যায় যে মহিলা লিঙ্গটি বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত। উদাহরণস্বরূপ, মহিলারা ঋতুস্রাবের সময় নামাজ থেকে অব্যাহতি পান অথচ নামায ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি স্তম্ভ। এছাড়াও আল্লাহর পথে লড়াই করার প্রতিদানের জন্য পুরুষদের শারীরিক, আর্থিক, সামাজিকভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয় কিন্তু একজন নারী হজ্জ করেই জিহাদের সওয়াব অতি সহজেই অর্জন করে নিতে পারে। তাছাড়া আকীকার ক্ষেত্রে একজন ছেলের জন্য দুইটি প্রানী অপরপক্ষে একটি মেয়ের জন্য একটি প্রানী যবেহ করার হুকুম রয়েছে। 

তবুও ইসলাম নারীদের কাজ করার স্বাধীনতা দেয় যতক্ষণ না এটি ধর্মের সীমা মেনে চলে। ইসলামের সোনালী ইতিহাসে অগনিত মহীয়সী, বিদূশী ও বীরঙ্গনা নারী ছিলেন যারা জ্ঞানচর্চা, যুক্তিবিদ্যা, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্ঞানশাস্ত্রের মতো নানা বিষয়ে পুরুষদের চাইতে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ছিল আর এজন্য তাদের পর্দা খুলে ফেলতে হয়নি। পঞ্চদশ শতাব্দীতে, আল-সাখাভী ১২ খন্ডের “দাও আল-লামি” নামক গ্রন্থে ১,০৭৫ জন নারী পণ্ডিতের কথা উল্লেখিত করেন। তন্মধ্যে একজন হলেন ফাতিমা আল-ফিহরি যিনি ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং যদি বর্তমান যুগে দৃষ্টিপাত করতে চান তবে দেখুন নাসার মুসলিম নারী বিজ্ঞানী দুই সন্তানের মা তাহানি আমেরকে। তিনাকে এই পদে পৌঁছাতে ইসলামের বিধানকে আমান্য় করতে হয়নি, নিজের পর্দা খুলে ফেলতে হয়নি, বিয়ে থেকে দূরে সরে যেতে হয়নি, স্বামী সেবা ও সন্তানদীর লালন-পালন থেকে বিরত হতে হয়নি। 

নারীরাই পুরুষের শক্ত মেরুদন্ড, অফুরন্ত শক্তি ও অদম্য মনোবলের মূল উৎস। কেননা যে পুরুষ বিশ্ব কাঁপানো ইতিহাস সৃষ্টি করে সে জন্ম নেয় এক নারীর গর্ভেই। এরই ফলে ইসলামে নারী যখন মা, তখন সন্তানের জন্য জান্নাত, মেয়ে হলেও বাবার জন্য জান্নাত এবং স্ত্রী হলে স্বামীর জন্য অর্ধেক-দ্বীন পূরণের সহধর্মিনী। বাবার ঘরে সে রাজকন্যা, স্বামীর বাড়ির রাজরানী,ছেলের কাছে রাজমাতা, ভাইয়ের নিকট রাজবোন। আজ মানুষ হীরা-গয়নাকে যেমন দামি বলে নানাকৌশলে সেগুলিকে রক্ষা করে ঠিক তেমনি ইসলামও নারীকে হিজাব প্রথা দিয়েছে যা সর্বদা নারীকে সুরক্ষা প্রদান করে। এছাড়াও দিয়েছে মুহাররামদের (যাদের সাথে বিয়ে করা নিষিদ্ধ) সাথে বাড়ি থেকে বেরোনোর আজ্ঞা। যেহুতু ইসলাম জানে নারীরা সেইসব হীরা-গয়না থেকেও অতিদামি। সেই কারণেই তো ইসলাম শাশ্বত সত্য ও শান্তির ধর্ম এবং চিরন্তন প্রগতিশীলও সার্বজনীন এবং আল্লহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন। সারা বিশ্বের নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও অবহেলিত নারী সমাজের হরণকৃত অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে কেবল ইসলামই। একমাত্র ইসলামই বিশ্ব নারী সমাজকে শান্তি ও মানবতা ফিরিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে ও কিয়ামত পর্যন্ত দিতেও থাকবে। ইনশা আল্লাহ।

দ্রষ্টব্য- এই প্রসঙ্গটি এক বিশাল ও বিস্তারিত সমালোচনামূলক বিষয় যা এক পাতায় বা কিছু শব্দে তুলে ধরা খুব দুস্তর বিষয় ফলে এর দ্বিতীয় পর্ব অতিশীঘ্রই প্রকাশিত করা হবে। ইনশা আল্লাহ।






Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter