নির্লজ্জতা ছড়িয়ে দেওয়ার এবং কাবাঘরের অসম্মানের এক নির্লজ্জ প্রচেষ্টা

ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অ্যাকটিভিজমের যুগে পিক্সেলহেল্পার pixelhelper নামক শিল্প-সংগঠনটি তাদের প্রতীকী প্রতিবাদের অভিনব উপায়ের কারণে পরিচিত হয়ে উঠেছে। জার্মানির অলিভার বিয়েনকোফস্কি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে আলোকচিত্র, স্থাপনা নির্মাণ এবং দূতাবাসে লাইট প্রজেকশনসহ নানা ব্যতিক্রমী কৌশলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে।

পিক্সেলহেল্পারের পোস্টগুলো, যেখানে তারা মক্কার কাবার সামনে "ডার্টি ডান্সিং স্টাইলের ভিডিও" বা "লিবারেল রেইনবো ইসলাম" মুহূর্তের দাবি করেছে, সেগুলো অত্যন্ত জাল বা ভিজ্যুয়াল এফেক্টস (ভিএফএক্স) ব্যবহার করে তৈরি। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে বেশ কয়েকটি বিষয় সমর্থন করে।

প্রথমত, এক্স-এর ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া: এক্স-এর পোস্টগুলো, যেমন @ss12ss21 থেকে, পিক্সেলহেল্পারের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগ এনেছে এবং দাবি করেছে যে বিষয়বস্তুটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পরিবর্তন করা হয়েছে। এই মনোভাব দর্শকদের মধ্যে ভিডিওর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে।

দ্বিতীয়ত, প্রাসঙ্গিক অসম্ভবতা: মক্কার মসজিদুল হারামে অবস্থিত কাবা ইসলামের অন্যতম পবিত্র স্থান, যা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রিত। কাবার সামনে নাচ বা রোমান্টিক ক্রিয়াকলাপের মতো প্রকাশ্য প্রদর্শন, বিশেষ করে যেগুলোকে উত্তেজক বা বিতর্কিত হিসেবে বর্ণনা করা হয়, সৌদি কর্তৃপক্ষের কঠোর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিয়মের কারণে অত্যন্ত অসম্ভব। এমনকি ফটোগ্রাফি এবং ভিডিওগ্রাফিও নিয়ন্ত্রিত, এবং অতীতে শ্রদ্ধা বজায় রাখতে সেলফি তোলার উপরও নিষেধাজ্ঞা ছিল।

তৃতীয়ত, যাচাইযোগ্য প্রমাণের অভাব: কোনো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যম বা স্বাধীন উৎস পিক্সেলহেল্পারের দাবির সমর্থন করে না। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা সত্য হলে ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতো। অতিরিক্ত ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ বা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতি এই বিষয়টিকে আরও অসত্য বলে সূচিত করে।

চতুর্থত, পিক্সেলহেল্পারের ইতিহাস: যদিও পিক্সেলহেল্পার উত্তেজক সক্রিয়তা এবং শিল্প প্রদর্শনীর জন্য পরিচিত, তাদের এই নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কিত দাবি প্রমাণের অভাবে অসমর্থিত। ব্যবহারকারীদের অভিযোগে "এআই" শব্দের ব্যবহার এই সম্ভাবনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে ভিডিওটি ডিজিটালভাবে পরিবর্তিত বা সম্পূর্ণ কম্পিউটার-উৎপন্ন হতে পারে, যা আধুনিক ভিএফএক্স এবং এআই সরঞ্জামের মাধ্যমে সহজেই সম্ভব।

পঞ্চমত, ভিএফএক্স-এর প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা: কাবার আশপাশের পরিবেশের একটি বাস্তবসম্মত দৃশ্য তৈরি করা বর্তমান ভিএফএক্স প্রযুক্তির সক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। এআই-উৎপন্ন বা পরিবর্তিত ভিডিওগুলো বাস্তব-বিশ্বের স্থানগুলোকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিলিপি করতে পারে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিম্ন-রেজোলিউশন ফরম্যাটে শেয়ার করা হলে, যা সত্যতা নির্ধারণ করা কঠিন করে তোলে।

তবে তাদের কিছু কার্যক্রম মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেছে—এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয়ভাবেও সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই প্রবন্ধে পবিত্র কুরআনের বাণী, ফাতওয়া ও প্রামাণ্য তথ্যের আলোকে কা‘বা, হজ ও কুরআনীয় অক্ষর-চিহ্ন নিয়ে করা পিক্সেলহেল্পারের কিছু কর্মের ইসলামি মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে। আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে—ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে "হুরমাহ" (পবিত্রতার সংরক্ষণ), মত প্রকাশের সীমা ও ধর্ম-বিদ্রূপের সামাজিক প্রতিক্রিয়া।

ঘটনাভিত্তিক আলোচনা: পিক্সেলহেল্পারের ক্যাম্পেইন ও মুসলিমদের আপত্তি

১. কা‘বার সদৃশ স্থাপনা, মরক্কো (২০১৮)

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মরক্কোর মারাক্কেশের নিকটস্থ আইত ফাসকা অঞ্চলে পিক্সেলহেল্পার একটি ঘনকাকৃতি স্থাপনা নির্মাণ করে, যা কা‘বার সঙ্গে অবিকল মিলে যায়। এটি 'সৌদি পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে সৃজনশীল প্রতিবাদ' হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাদের ওয়েবসাইটে এ স্থাপনাকে হজ বানিজ্যিকীকরণের ব্যঙ্গচিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মরক্কোর দণ্ডবিধির ২২০ ধারার আলোকে—যা মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্মাচরণের অসম্মান নিষিদ্ধ করে—এই স্থাপনাটি কয়েক দিনের মধ্যেই ভেঙে দেয়। মরক্কোর শায়খ হামজা বেনচেরিফসহ বহু আলিম এ কর্মের নিন্দা করে বলেন:
"প্রতিবাদ করা যায়, তবে পবিত্রতাকে অপবিত্র করা ইসলামে অনুমোদিত নয়।"

মরক্কোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়,
"এটি ছিল ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র স্থানের একটি অবৈধ অনুকরণ—যা জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিকে অসম্মান করেছে।"

وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
"যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, তা তো অন্তরের তাকওয়ার নিদর্শন।"
(সূরা হজ্জ ২২:৩২)

২. সৌদি দূতাবাসে কুরআনিক ফন্টের প্রক্ষেপণ (বার্লিন, ২০১৯)

২০১৯ সালের অক্টোবরে পিক্সেলহেল্পার বার্লিনে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসের গায়ে এমবিএস বিরোধী স্লোগান ও কুরআনের অক্ষরের ন্যায় দেখতে আরবি লিপি প্রজেক্ট করে। উদ্দেশ্য ছিল জামাল খাশোগি হত্যার প্রতিবাদ, কিন্তু ব্যবহৃত কুরআনিক শৈলী অনেক মুসলিমকে কষ্ট দেয়।

মিসরের দারুল ইফতা ২০২১ সালে এ সংক্রান্ত ফাতওয়া (ফাতওয়া নম্বর ২৩১৯) জারি করে:
"কুরআনিক লেখা বা প্রতীক কোনো বিদ্রূপ বা রাজনৈতিক ব্যঙ্গের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম ও অনুচিত।"

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
"নিশ্চয়ই আমরাই 'উল্লেখ' (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, এবং আমরাই একে সংরক্ষণ করব।"
(সূরা হিজর ১৫:৯)

৩. হজকে “সার্কাস” বলা (২০২০)

২০২০ সালে পিক্সেলহেল্পার এক পোস্টে হজকে "মিলিয়ন-ডলারের সার্কাস" বলে উল্লেখ করে। যদিও হজ ব্যবস্থাপনায় বানিজ্যিকীকরণের সমালোচনা করা যেতে পারে, তবে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি নিয়ে বিদ্রূপ ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গর্হিত।

ইমাম আল-কারাফি বলেন:
"যদি কেউ দীনের মূল ভিত্তিকে বিদ্রুপ করে, তা কুফর হিসেবে পরিগণিত হয়, যদিও তার বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়।"
(আল-ফুরুক)

وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا
"মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও—তারা তোমার কাছে পায়ে হেঁটে আসবে।"
(সূরা হজ্জ ২২:২৭)

ইসলামি নীতিমালা: মত প্রকাশের সীমারেখা

ইসলাম অনিয়ন্ত্রিত মতপ্রকাশকে অনুমোদন করে না। ইসলামী বোধ অনুযায়ী, তিনটি মূলনীতি থাকতেই হবে:

হুরমাহ (পবিত্রতা): ধর্মীয় প্রতীক ও কর্ম পবিত্র।

মাসলাহাহ (সামাজিক কল্যাণ): ব্যক্তিস্বাধীনতা যদি সামাজিক ঐক্য ভেঙে ফেলে, তা অগ্রহণযোগ্য।

আদাবুল খিলাফ (বিরোধের শিষ্টাচার): মতভেদ থাকলেও শিষ্টতা রক্ষা করতে হবে।

নববী নির্দেশনা

"من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليقل خيراً أو ليصمت"
"যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে, নাহলে চুপ থাকে।"
(সহীহ বুখারী ৬১৩৬)

وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ
"তারা যাদের আল্লাহর পরিবর্তে ডাকে, তাদের গাল দিও না।"
(সূরা আন‘আম ৬:১০৮)

রাসূল মুশরিকদের মূর্তিকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ করতেন না, কারণ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আল্লাহকেই অপমান করা হতো। একইভাবে, ইসলামী প্রতীক ব্যবহার করে ধর্মীয় সংস্কৃতির বিদ্রূপে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিভাজন সৃষ্টি হয়—যা ফিতনা।

সামাজিক ক্ষতি ও ইসলামোফোবিয়া

এসব প্রতিবাদ ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাশাপাশি ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দেয়। SETA Foundation প্রকাশিত European Islamophobia Report 2023 অনুযায়ী,
২০২২ সালে জার্মানিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১,১৫৭টি ঘৃণামূলক অপরাধ ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৪% বেশি। এর মধ্যে ৩২% ঘটনায় ইসলামী প্রতীক ব্যবহার করে উসকানির উল্লেখ পাওয়া গেছে।

وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ
"তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।"
(সূরা বাকারা ২:১৯৫)

উপসংহার

পিক্সেলহেল্পারের কার্যক্রম পশ্চিমা প্রতিবাদ সংস্কৃতিতে ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতি অবজ্ঞার একটি দৃষ্টান্ত। যদিও তাদের উদ্দেশ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, তবে ইসলামী প্রতীকের ব্যবহার ও বিদ্রূপমূলক উপস্থাপনা ইসলামের নৈতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয়। পিক্সেলহেল্পারের পোস্টগুলি সৌদি আরবের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নিয়মাবলির প্রতি সম্পূর্ণ অজ্ঞতা বা ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞা প্রকাশ করে। কাবার আশপাশে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যেখানে ফটোগ্রাফি এবং ভিডিওগ্রাফি সীমিত, এবং এমনকি সাধারণ সেলফি তোলার উপরও নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রিত স্থানে উত্তেজক ক্রিয়াকলাপের দাবি করা শুধুমাত্র অবিশ্বাস্য নয়, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে।

ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে উৎসাহিত করে, কিন্তু তা হতে হবে শালীনতা, শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক পরিণতির বিবেচনায়।
আধুনিক মুসলিম অ্যাক্টিভিস্টদের ও আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ সংগঠনগুলোর জন্য এটি এক সতর্কবার্তা: আদব ছাড়া প্রতিবাদ—ইসলামসম্মত নয়, কার্যকরও নয়।

তথ্যসূত্র:

SETA Foundation. (2023). European Islamophobia Report 2023.

Dar al-Iftaa al-Misriyyah. (2021). Fatwa No. 2319.

Al-Qarāfī. Al-Furūq. بيروت: عالم الكتب.

Ibn ʿĀbidīn. Radd al-Mutār. دار الفكر.

Al-abarī. Tafsīr al-abarī. دار المعارف.

Al-Ghazālī. Iʾ ʿUlūm al-Dīn (Vol. 3).

The Qur’an: Surah al-ajj (22:27, 22:32); al-ijr (15:9); al-Anʿām (6:108); al-Baqarah (2:195).

Al-Bukhārī. aī al-Bukhārī (adīth 6136); Muslim. aī Muslim (adīth 47).



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter