ইসলামী দর্শনে জ্ঞান ও আমলের পারস্পরিক সম্পর্ক: সফলতার প্রামাণ্য পথ
ভূমিকা
ইসলাম ধর্ম হল এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, ব্যবহার, আচরণ এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক ও সহজ দিকনির্দেশনা দেয়। এই দিকনির্দেশনার মূল উৎস হলো কুরআন ও সুন্নাহ। আর এই দুটি উৎসের আলোকে ভিক্তি করে মানুষকে জীবন গঠন করতে হলে মানুষের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে সঠিকভাবে আমল করা। কিন্তু এখন যদি পৃথিবীর প্রতিটি কোণের মানুষকে লক্ষ্য করা যায় তাহলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসবে , এমন বহু মানুষ আছে যারা ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, তারা কুরআনের বহু আয়াত মুখস্থ করেছেন, হাদীস পড়েন, বক্তৃতা শুনেন, ইসলামিক বই পড়েন, কিন্তু এই জ্ঞান তাদের জীবনে প্রতিফলিত হয় না। তাদের আচরণে, কথাবার্তায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে, লেনদেনে বা পারিবারিক জীবনে ইসলামিক শিক্ষা দেখা যায় না। এই ধরণের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। কেননা, আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে বলেন
كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُون
“তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক।
তো এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি , শুধু জ্ঞান অর্জন করা যথেষ্ট নয়, বরং সেই জ্ঞানের ভিক্তিতে জীবনগঠন করাই হলো একজন ঈমানদার ব্যক্তির প্রকৃত রূপ। জ্ঞানের ভিক্তিতে যদি আমল না করা যায় তাহলে সেই জ্ঞান সেই কিয়ামতের দিনে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
العِلْمُ شَجَرَةٌ، وَالعَمَلُ ثَمَرَتُه
“জ্ঞান হলো একটি বৃক্ষ, আর আমল হলো তার ফল”
এই হাদীসটি আমাদের শেখায়, আপনি যতই জ্ঞান অর্জন করুন না কেন, যদি তাতে আমল না থাকে তাহলে সেই বৃক্ষে কোনও ফল নেই। একজন ফলহীন গাছ যেমন কারও উপকারে আসে না, তেমনি আমলবিহীন জ্ঞানও সমাজ ও নিজের জন্য কখনও উপকারী হতে পারে না। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ (“জ্ঞান অর্জন করো, তবে তার সঙ্গে আমলও করো, কারণ জ্ঞান ব্যতীত আমল অন্ধ, আর আমল ব্যতীত জ্ঞান পাথর”)। অর্থাৎ জ্ঞান থাকলে দিকনির্দেশনা থাকে, কিন্তু আমল না থাকলে নিদিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারা যায়না। আবার শুধু আমল থাকলে পথচলাতো হয়, কিন্তু দিকনির্দেশনা না থাকায় পথভ্রষ্ট হওয়ার অনেক সম্ভাবনা থাকে। তাই সফলতা তখনই আসবে বা আমরা সফলতা তখনই অর্জন করতে পারব, যখন আমরা জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সেই জ্ঞান কে আমলে পরিণত করব।
কুরআন ও হাদীসের আলোতে জ্ঞান ও আমলের গুরুত্ব
পবিত্র ইসলাম ধর্মে জ্ঞান অর্জন একটি মহান ইবাদত, আর সেই জ্ঞান অনুযায়ী আমল করা তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অসংখ্য স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কেবল জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না; বরং সেই জ্ঞান অনুযায়ী আমল না করলে তা আল্লাহর নিকট কোনো মর্যাদা পায় না। আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেছেন—
“قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُون”
অর্থাৎ, “আপনি বলুন— যারা জ্ঞান অর্জন করে এবং যারা করে না, তারা কি সমান হতে পারে?”
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে আল্লাহর কাছে জ্ঞানীদের মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। আরেক স্থানে আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَات”
অর্থাৎ, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বহু গুণ বৃদ্ধি করবেন।”
নবী মুহাম্মদ ﷺ বলেন—
“من سلك طريقًا يلتمس فيه علمًا، سهل الله له به طريقًا إلى الجنة”
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো পথে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।”
কিন্তু যদি আমরা সেই জ্ঞানের আলোকে আমল না করি, তবে সেই জ্ঞান আমাদের জন্য জান্নাতের পথ নয়, বরং জাহান্নামের পথও হতে পারে। রাসূল ﷺ আরও বলেন—
“أشدّ الناس عذابًا يوم القيامة عالمٌ لم ينفعه علمه”
অর্থাৎ, “কিয়ামতের দিনে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি পাবে সেই আলেম, যার জ্ঞান তাকে উপকার দেয়নি।” এটি অত্যন্ত ভীতিকর সতর্কবার্তা। অতএব, জ্ঞান অর্জনের পর তা আমলে রূপান্তরিত না করলে, সেই জ্ঞান আখিরাতে আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—
“مَثَلُ الَّذِينَ حُمِّلُوا التَّوْرَاةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا”
অর্থাৎ, “যাদের তাওরাত (আল্লাহর কিতাব) দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তদনুযায়ী কাজ করেনি, তারা সেই গাধার মতো— যে পিঠে বই বহন করে কিন্তু কিছুই বুঝে না।”
এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যদি তা মানুষের অন্তর ও চরিত্রে পরিবর্তন না আনে এবং সৎপথে দিকনির্দেশনা না দেয়, তবে সে কেবল বোঝা বহন করছে, উপকার কিছুই পাচ্ছে না।
ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেছেন— “জ্ঞান এমন কিছু নয় যে কেবল মুখস্থ করলেই মানুষ জ্ঞানী হয়ে যাবে; বরং জ্ঞান হলো এমন এক আলো, যা অন্তরকে আলোকিত করে, চরিত্রকে শুদ্ধ করে এবং বান্দাকে আল্লাহর দিকে টেনে নিয়ে যায়।” আমরা কুরআনে দেখতে পাই— আল্লাহ যেসব নবী প্রেরণ করেছেন, তাঁরা শুধু জ্ঞান লাভেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; বরং সে জ্ঞানের আলোকে আমল করেছেন, মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন, কষ্ট সহ্য করেছেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই আমলে অবিচল থেকেছেন।
হাদীসে এসেছে—
“ليس العلم بكثرة الرواية، إنما العلم خشية الله”
অর্থাৎ, “জ্ঞান বহু বর্ণনা করার নাম নয়; বরং জ্ঞান হলো আল্লাহভীতি।”
অতএব, প্রকৃত জ্ঞান সেই যা মানুষকে বিনম্র করে তোলে, চোখে অশ্রু আনে, গোনাহের কারণে হৃদয়ে ভয় সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়।
জ্ঞান ও আমল মিলেই আসে আসল সফলতা
সত্যিকারের সফলতা কেবল বইয়ের পাতা থেকে মুখস্থ করা জ্ঞানের মাধ্যমে আসে না; বরং সেই জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ করে এবং তার ভিত্তিতে জীবনকে সুন্দর ও সঠিক পথে পরিচালনা করার মাধ্যমেই তা অর্জিত হয়। আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেছেন— “তারা কিতাবকে পড়ে, অথচ তা অনুযায়ী কাজ করে না; তারা সেই গাধার মতো, যে বই বহন করে কিন্তু কিছুই বুঝে না।” আবার আল্লাহ তায়ালা বলেন— “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীসে সতর্ক করেছেন— “কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে সেই আলিমের, যে নিজে আমল করত না।”
এসব আয়াত ও হাদীস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়— মানুষ যদি অর্জিত জ্ঞানের মুতাবিক আমল না করে, তবে সেই জ্ঞানই একদিন তার জন্য শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জ্ঞান যদি সত্যিই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহরণ করা হয়, তবে তা আমাদের নামাজ, রোজা, ন্যায়-নীতি, সততা এবং মানুষের সঙ্গে সদাচরণে প্রতিফলিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি জানে যে মিথ্যা বলা গুনাহ, অথচ প্রতিদিন মিথ্যা বলতে থাকে, তবে সে কেবল জ্ঞান ধারণ করছে, কিন্তু তা অনুসারে আমল করছে না।
হযরত ওমর (রাঃ) বলতেন— “তোমরা জ্ঞান শিখো, তারপর সে অনুযায়ী আমল করো।” প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কেবল বইপত্র পড়ার ধর্ম নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং সর্বমুহূর্তে আল্লাহর বিধান মেনে চলতে আহ্বান জানায়। আল্লাহ তায়ালা রাসূল ﷺ-কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন— “বলুন, আমি কেবল আল্লাহর আদেশ অনুসরণ করি, যা আমার কাছে ওহি করা হয়েছে।” এই আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয়— জীবনে প্রকৃত সফলতা তখনই আসে, যখন জ্ঞান ও আমল একত্র হয়ে মানুষের চরিত্র ও কর্মে প্রতিফলিত হয়।
উপসংহার
জ্ঞান ও আমল ইসলামের দুই অমূল্য রত্ন। এই দুইটি ছাড়া একজন মুমিন ব্যক্তির জীবন কখনই পূর্ণ হতে পারে না। যেমন একটি পাখি তার দুই ডানা ছাড়া কখনও আকাশে উড়তে পারে না, তেমনি একজন মানুষ জ্ঞান ও আমল ছাড়া কখনও সত্যিকার সফলতা অর্জন করতে পারে না। ইসলাম শুধু বই পড়ে জানার নাম নয়, বরং শেখা জিনিসকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার নামই হল ইসলাম। কুরআনে বলা হয়েছে, "তোমরা কি লোকেদের সৎ কাজের জন্য আদেশ দাও আর নিজেদের জন্য ভুলে যাও? এই আয়াত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, জ্ঞান অর্জন করার সঙ্গে আমল না থাকলে তা হয় ভণ্ডামি। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করার পর সেই কোরআন অনুযায়ী না চলে, সেই ব্যক্তি হল সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তি”। আজ আমরা অনেক কিছু জানি, আমরা অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি, নামাজের ফজিলত, সততার গুরুত্ব, মিথ্যার ক্ষতি, কিন্তু আমরা বাস্তবে তা কয়জন মানি? যেমন একজন ডাক্তারের কাছে যদি চিকিৎসার সমস্ত জ্ঞান থাকে কিন্তু সে যদি নিজে ওষুধ না খায়, তাহলে সে কেমন ডাক্তার? তেমনি আমরাও যদি ইসলাম সম্পর্কে জানি কিন্তু সে ইসলাম অনুযায়ী না চলি, তবে আমাদের জ্ঞান কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ জ্ঞানকে পথ হিসেবে দিয়েছেন, সেই পথে চলার একমাত্র উপায় জ্ঞানের প্রতি আমল । একমাত্র তখনই আমাদের জ্ঞান সফল হবে, যখন সেই জ্ঞান কে আমরা আমলের দ্বারা পূর্ণ করব। জ্ঞান মানুষকে সম্মান দেয়, আর আমল তাকে জান্নাতের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।