মিশরে ইসলামী নবজাগরণের দিগদর্শী: মুহাম্মদ আবদুহ ও তাঁর চিন্তাধারা”
ভূমিকা :
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর সূচনায় ইসলামী বিশ্ব এক গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও জ্ঞানগত সংকটে নিপতিত ছিল। পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদ, অভ্যন্তরীণ জড়তা এবং শিক্ষার গতানুগতিকতা মুসলিম সমাজকে অচল করে রেখেছিল। এই সময়েই মিশরের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও সংস্কারক মুহাম্মদ আবদুহ ইসলামী চিন্তার নবজাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর চিন্তা, কর্ম ও প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়সমূহ শুধু মিশর নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে নবচেতনার সঞ্চার ঘটিয়েছে।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা :
মুহাম্মদ আবদুহর শৈশবকালেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ১৮৪৯ সালে মিশরের গারবিয়া প্রদেশের মাহাল্লা নাসর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল সাধারণ কৃষক পরিবার, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আবদুহর মাঝে জ্ঞানার্জনের এক প্রবল আগ্রহ ও আত্মপ্রবৃত্তি দেখা দেয়। তিনি খুব অল্প সময়ে কুরআন মুখস্থ করেন এবং স্থানীয় মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। শৈশবেই তাঁর স্মরণশক্তি ও বিশ্লেষণক্ষমতা শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিস্মিত করত। যদিও প্রথাগত শিক্ষার কাঠামো ছিল কঠোর ও রক্ষণশীল, তবুও তিনি নিজের কৌতূহলী মন ও জিজ্ঞাসু স্বভাব দিয়ে শিক্ষাকে জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রাথমিক পর্যায়েই তিনি যুক্তিবোধ, চিন্তার স্বচ্ছতা এবং ভাষাগত দক্ষতার পরিচয় দেন, যা পরবর্তীতে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ভিত্তি রচনা করে। শিশু আবদুহ কেবল পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি প্রাকৃতিক জগৎ, মানুষের আচরণ ও ধর্মীয় প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন শৈশবেই। তাঁর এই মেধা ও আত্মপ্রচেষ্টা ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ আলোকিত জীবনের প্রথম ধাপ।
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও আত্মিক সংকট :
১৮৬৬ সালে একজন তরুণ ছাত্র ঐতিহাসিক আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সে সময় আল-আজহারের পাঠ্যক্রম ছিল মূলত ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ, যেমন ফিকহ, হাদীস, তাফসির এবং আরবি ব্যাকরণ। এই পাঠ্যক্রমে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন বা যুক্তিবিদ্যার মতো বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ছিল না, যা একজন চিন্তাশীল ছাত্রের জন্য হতাশাজনক ছিল। এই সীমাবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা তার মধ্যে আত্মিক সংকট সৃষ্টি করে এবং তিনি সংসার বিমুখ হয়ে পড়েন।
এই সময়ে, তার অভিভাবক শেখ দারবিশ তাকে পুনরায় উদ্বুদ্ধ করেন যুক্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল চিন্তার দিকে ফিরে আসতে। শেখ দারবিশ তাকে বোঝান যে, ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক জ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যার সমন্বয় সম্ভব এবং এটি ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থী নয়। এই উৎসাহে, তিনি পুনরায় অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন এবং পরবর্তীতে ইসলামী শিক্ষার সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯শ শতকের শেষভাগে, আল-আজহারে শিক্ষার সংস্কার শুরু হয়। মুহাম্মদ আবদুহর নেতৃত্বে ১৮৯৫ সালে একটি শিক্ষা বিভাগ গঠিত হয়, যা চারটি সুন্নি মাযহাবের বিশিষ্ট আলেমদের নিয়ে গঠিত ছিল। ১৮৯৬ সালে একটি সংস্কার আইন পাস হয়, যার মাধ্যমে শিক্ষক বেতন বৃদ্ধি, নতুন শ্রেণীকক্ষ ও পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন, এবং ছাত্রদের জন্য একটি বিশেষ ফার্মেসি ও চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। এই সংস্কারের ফলে, গণিত, বীজগণিত, ইতিহাস ও ভূগোলের মতো আধুনিক বিষয়গুলি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এই সংস্কার আন্দোলনের ফলে, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যক্রম চালু হয়। এই পরিবর্তন ইসলামী শিক্ষার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং মুসলিম সমাজে প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশে সহায়ক হয়।
এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় সম্ভব এবং এটি মুসলিম সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জামালুদ্দিন আফগানির প্রভাব :
আবদুহর চিন্তাজগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন জামালুদ্দিন আফগানি। আফগানির সাহচর্যে তিনি রূপান্তরিত হন এক আত্মনির্ভরশীল, সচেতন ও সক্রিয় চিন্তাবিদে। আফগানি তাঁকে পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা ও সংবিধানিক শাসনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। এর প্রভাবেই আবদুহ ইসলামী চিন্তাধারায় যুক্তিবাদ, উদারতা ও আধুনিকতার মিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হন।
রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও নির্বাসন :
১৮৭৯ সালে মিশরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উরাবি বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে আবদুহকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। প্রথমে তিনি সিরিয়ায় আশ্রয় নেন, পরে প্যারিসে আফগানির সঙ্গে মিলে “আল-উরওয়াতুল উথকা” নামে একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি উপনিবেশবিরোধিতা ও মুসলিম ঐক্যের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। যদিও পত্রিকাটি ইসলামি দেশে নিষিদ্ধ হয়, তবুও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী ছিল।
শিক্ষা ও ধর্মীয় সংস্কারক হিসেবে আবদুহ :
১৮৮৮ সালে মিশরে প্রত্যাবর্তনের পর আবদুহ বিচারপতি পদে নিয়োগ পান এবং পরে আল-আজহারের প্রশাসনিক পরিষদের সদস্য হন। তিনি আল-আজহারের শিক্ষা পদ্ধতিতে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনেন—ইতিহাস, ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৮৯৯ সালে তিনি মিশরের প্রধান মুফতি হন এবং এ পদে থেকে তিনি এমন কিছু ফতোয়া দেন যা তাঁর উদার মনোভাব ও যুগবোধের পরিচায়ক।
উল্লেখযোগ্য তিনটি ফতোয়া হলো—
১. সুদভিত্তিক লেনদেন নির্দিষ্ট শর্তে বৈধ;
২. অমুসলিম দেশে বসবাসরত মুসলিমদের জন্য তাদের জবাই করা পশুর মাংস ভক্ষণযোগ্য;
৩. প্রয়োজনে মুসলিমরা ঐতিহ্যগত পোশাক ছেড়ে আধুনিক পোশাক পরিধান করতে পারে।
এসব ফতোয়া রক্ষণশীল মহলে সমালোচিত হলেও আবদুহ যুক্তি ও বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে ইসলামকে যুগোপযোগী রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
সামাজিক কর্মকাণ্ড ও লেখনী :
আবদুহ “ইসলামিক বেনেভোলেন্ট সোসাইটি” প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য ছিল দরিদ্রদের শিক্ষা ও নৈতিক সহায়তা প্রদান। তিনি “আরবী বইয়ের পুনর্জাগরণ সংঘ” প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তিনি প্রাচীন আরবি সাহিত্য ও ইসলামী ক্লাসিক রচনাসমূহ পুনরায় প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা “রিসালাতুত তাওহীদ” (ঐক্যবাদের পত্র) আল্লাহর একত্ববাদের দার্শনিক বিশ্লেষণভিত্তিক একটি অমূল্য রচনা। তাছাড়া, খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় রচিত “আল-ইসলাম ওয়ান-নাসরানিয়্যাহ” গ্রন্থটি মুসলিম জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক প্রতিরক্ষামূলক রচনা হিসেবে বিবেচিত।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও খ্যাতি :
আবদুহ শুধু আরবি ও ইসলামি বিশ্বেই নয়, পাশ্চাত্য মনীষীদের সঙ্গেও চিন্তাচর্চা ও পত্রালাপ চালিয়ে গেছেন। উইলফ্রিড ব্লান্ট, হারবার্ট স্পেন্সার, লিও টলস্টয় প্রমুখের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি আফ্রিকা ও ইউরোপ সফর করে জ্ঞানচর্চা ও মতবিনিময় করেছেন। এসব আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা তাঁকে ইসলামি সংস্কারক হিসেবে আরও প্রগাঢ় ও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে তোলে।
চরিত্র ও মূল্যবোধ :
আবদুহর জীবন ছিল আত্মত্যাগ, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। তিনি দরিদ্রদের জন্য নিজের ওয়াকফের অর্থ দান করতেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য চাঁদা তুলতেন, এবং সমাজে ন্যায় ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। মিশরে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
উপসংহার :
মুহাম্মদ আবদুহ ছিলেন এক অনন্য চিন্তাবিদ যিনি ধর্ম ও আধুনিকতাকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয় বরং সহযোগী হিসেবে দেখেছেন। তিনি ইসলামি চিন্তার ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ, সহনশীলতা ও মানবিকতার আলো ছড়িয়ে গেছেন। তাঁর প্রবর্তিত স্কুল ও দর্শন পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তাবিদদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং ইসলামী নবজাগরণের এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে। আজকের মুসলিম সমাজ যদি তাঁর চিন্তা ও নীতিগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করে, তবে আধুনিকতার সঙ্গে বিশ্বাসের সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।