গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ: বাংলা সালতানাতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
ভূমিকা
বাংলার ইতিহাসে এমন অনেক শাসকের নাম উজ্জ্বল, যাঁরা সামরিক শক্তি, কূটনীতি এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের অবদান রেখেছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১)। তিনি ছিলেন বাংলা সালতানাতের তৃতীয় সুলতান এবং ইলিয়াস শাহী বংশের একজন প্রধান শাসক। শুধু বাংলার ইতিহাসেই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান অমর হয়ে রয়েছে। আইন, সাহিত্য, কূটনীতি এবং সামরিক শাসনে তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও প্রজ্ঞা তাঁকে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক করে তুলেছে।
গিয়াসউদ্দীনের শাসনামল শুধুমাত্র বাংলা সালতানাতের ভৌগোলিক পরিধি বাড়ায়নি, বরং এটি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক নবজাগরণের যুগও রচনা করেছিল। তিনি ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলার মর্যাদা স্থাপন করেছিলেন।
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সিংহাসনে আরোহণ
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ বাংলা সালতানাতের সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর পিতা সিকান্দার শাহকে পরাজিত করার পর। ১৩৯০ সালে গিয়াসউদ্দীনের বাহিনী গৌলপাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে সিকান্দার শাহকে হত্যা করে, যদিও তিনি নিজ বাহিনীকে এই কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই ঘটনাই তাঁকে সুলতানের আসনে বসায়।
সিংহাসনে আরোহণের পর গিয়াসউদ্দীন শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হন। কামরূপ (বর্তমান আসাম) বিজয়ের মাধ্যমে তাঁর সামরিক ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বাংলার সামরিক এবং কৌশলগত শক্তি বাড়ায়। তাঁর শাসনের প্রথমদিকেই বাংলা একটি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ন্যায়পরায়ণতা
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ শাসনকালে আইনের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর শাসনামলে আইন ছিল সাধারণ জনগণ এবং শাসকের জন্য সমান।
একটি বিখ্যাত ঘটনায় দেখা যায়, তিনি শিকার করতে গিয়ে ভুলবশত একজন বিধবার পুত্রকে হত্যা করেন। ওই বিধবা স্থানীয় কাজীর কাছে অভিযোগ দায়ের করলে সুলতান নিজেকে সাধারণ অভিযুক্তের মতো আদালতে হাজির করেন। কাজীর রায় অনুযায়ী সুলতান বিধবাকে ক্ষতিপূরণ দেন।
এই ঘটনার একটি চমকপ্রদ দিক ছিল, কাজী এবং সুলতানের সাহসিকতা। কাজী সুলতানের সামনে স্পষ্টভাবে ন্যায়ের রায় দেন। সুলতান কাজীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন, তবে একইসঙ্গে বলেন, "যদি তুমি ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হতে, তবে তোমার প্রাণ নিতাম।" কাজী পাল্টা উত্তর দেন, "তোমার যদি আইন অমান্য করার সাহস থাকত, তবে আমি তোমাকে কঠোর শাস্তি দিতাম।"
এই ঘটনা শুধু গিয়াসউদ্দীনের ব্যক্তিত্বের মহানতা নয়, বরং মধ্যযুগীয় বাংলায় আইনের শাসনের শক্ত অবস্থানের প্রমাণও বহন করে। এটি বাংলার ইতিহাসে একটি অনন্য উদাহরণ।
কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ছিলেন অগ্রণী। তাঁর শাসনামলে বাংলা সালতানাতের কূটনৈতিক সম্পর্ক চীনের মিং সাম্রাজ্যের সাথে গভীরতর হয়। তিনি সম্রাট ইয়ংলের কাছে দূত পাঠান এবং উপহারও প্রেরণ করেন।
বাংলা সালতানাতের এই উদ্যোগ কেবল বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য ছিল না, বরং এটি দিল্লি সালতানাতের প্রভাব মোকাবিলার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেও কাজ করেছিল। চীন, বাংলার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্ক জোরদারে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছিল।
তাঁর কূটনৈতিক উদ্যোগের আরেকটি দিক ছিল আরবের পবিত্র স্থান মক্কা এবং মদিনার সঙ্গে সংযোগ। গিয়াসউদ্দীন সেখানকার মাদ্রাসা এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে অর্থ সাহায্য করেন। এর ফলে বাংলার ধর্মীয় ও শিক্ষাগত ভূমিকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতা
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর দরবারে পারস্য এবং বাংলা উভয় সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে তাঁর চিঠি বিনিময়ের ইতিহাস পারস্য-বাংলা সাংস্কৃতিক সম্পর্কের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মদ সাগীর তাঁর 'ইউসুফ-জুলেখা' কাব্য রচনা করেন গিয়াসউদ্দীনের অনুরোধে। এই কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের একটি মূল্যবান সংযোজন। একই সময়ে, হিন্দু কবি কৃত্তিবাস ওঝা 'রামায়ণ' অনুবাদ করেন, যা 'কৃত্তিবাসী রামায়ণ' নামে পরিচিত।
এই যুগে বাংলায় মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সংস্কৃতির মিলন ঘটে, যা বাংলার সামগ্রিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সাহিত্য এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শের এই সম্মিলন বাংলা সালতানাতকে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছিল।
সামরিক বিজয় ও প্রশাসনিক দক্ষতা
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের শাসন কেবল কূটনীতি বা সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সামরিক দিকেও ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। কামরূপ বিজয়ের মাধ্যমে তাঁর সামরিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।
তাঁর শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এই বিচারব্যবস্থা সাধারণ মানুষের মধ্যে সুশাসনের ধারণা জাগিয়ে তোলে এবং বাংলার সামগ্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে।
ধর্মীয় সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সংহতি
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তাঁর শাসনামলে ধর্মীয় সহনশীলতার উদাহরণ স্থাপন করেন। হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য তিনি উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর শাসনামলে হিন্দু ও মুসলিম কবি ও লেখকরা সমান পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন, যা তাঁর সাম্প্রদায়িক সংহতির দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে।
উপসংহার
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের শাসনকাল বাংলা সালতানাতের জন্য একটি স্বর্ণযুগ ছিল। তাঁর সামরিক বিজয়, আইনপ্রিয়তা, কূটনৈতিক সাফল্য এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা তাঁকে বাংলা ও দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
তাঁর ন্যায়পরায়ণতা এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও ইতিহাসে চর্চিত হয়। তিনি শুধু একজন দক্ষ শাসকই নন, বরং একজন মানবতাবাদী, সংস্কৃতিপ্রেমী এবং সাহসী নেতা ছিলেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের জীবন ও শাসন বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে।
তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে সুশাসন, ন্যায়পরায়ণতা এবং সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতাই একটি জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের শাসন আমাদের জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষার উৎস হয়ে থাকবে।