মুসলিম ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অন্যতম অভিযাত্রী

ভূমিকা

মানব সভ্যতার ইতিহাস মূলত ভ্রমণ ও অনুসন্ধানের ইতিহাস। মানুষ যুগে যুগে সীমান্ত পেরিয়ে জ্ঞান, সংস্কৃতি, ধর্ম, বাণিজ্য ও সভ্যতার আদানপ্রদান ঘটিয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে এমন কিছু নাম রয়েছে, যারা কেবল ভ্রমণই করেননি, বরং তাঁদের ভ্রমণকে রূপ দিয়েছেন জ্ঞানের নতুন দিগন্তে। সেইসব বিরল ভ্রমণকারীদের অন্যতম হলেন ইবনে বতুতা। এক মুসলিম অভিযাত্রী, যিনি ১৪শ শতকে প্রায় সমগ্র পরিচিত পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন।তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা কেবল ভৌগোলিক বিস্ময় নয়, বরং সভ্যতা, ধর্ম, সমাজ ও মানবসম্পর্কের এক অন্যতম দলিল। ইউরোপীয় অভিযাত্রী মার্কো পোলোর আগে পরে অনেক ভ্রমণকারী ইতিহাসে আসলেও, ইবনে বতুতার মতো এত বিস্তৃত ভ্রমণ কেউই সম্পন্ন করতে পারেননি।ইবনে বতুতার নামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সাহস, কৌতূহল, ধৈর্য ও মানবিক অনুসন্ধানবোধ। তাঁর লেখা  রিহলা গ্রন্থটি আজও মুসলিম সভ্যতা ও বিশ্বসংস্কৃতির ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ।

জন্ম, শিক্ষা ও প্রারম্ভিক জীবন

ইবনে বতুতার পূর্ণ নাম ছিল আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-লাওয়াতি আলতাঞ্জি। তিনি ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে মরক্কোর উত্তর উপকূলবর্তী শহর তাঞ্জিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল এক উচ্চবংশীয় মুসলিম আইনজ্ঞ পরিবার, যারা মালিকি ফিকহ (ইসলামী আইন) অনুশীলন করতেন। ছোটবেলা থেকেই ধর্ম, আরবি সাহিত্য ও ফিকহ শিক্ষায় তিনি ছিলেন পারদর্শী।তবে ইবনে বতুতার অন্তরে ছিল অন্য এক আহ্বান। অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। মাত্র ২১ বছর বয়সে, ১৩২৫ সালে তিনি ঘোষণা করেনআমি বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রিয় বাড়ি ও পরিবারকে বিদায় জানিয়ে উদ্দেশ্য একটাই আল্লাহর ঘর (কাবা) দর্শন।এই হজযাত্রাই ছিল তাঁর বিশাল অভিযাত্রার সূচনা। কিন্তু মক্কা পৌঁছে তিনি উপলব্ধি করেন পৃথিবী অনেক বড় এবং মানুষের বৈচিত্র্য অসীম। সেই থেকে শুরু হয় তাঁর অনন্ত ভ্রমণ যা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ৩০ বছর।

ভ্রমণের পথ ও বিস্ময়কর যাত্রা

উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য

প্রথমেই ইবনে বতুতা মরক্কো থেকে মিশর তারপর প্যালেস্টাইন ও সিরিয়া হয়ে মক্কায় যান। তখনকার ইসলামি বিশ্ব ছিল এক বিশাল সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক জাল যেখানে আরব, আফ্রিকা ও এশিয়া যুক্ত ছিল ধর্ম ও বাণিজ্যের মাধ্যমে। তিনি মক্কা সফর শেষে ইয়েমেন, ওমান ও পারস্য উপসাগর ঘুরে দেখেন। তাঁর লেখায় কায়রো শহরের সৌন্দর্য, দামেস্কের বিদ্যাচর্চা ও মক্কার আধ্যাত্মিক পরিবেশের প্রশংসা পাওয়া যায়।

পূর্ব আফ্রিকা

এরপর তিনি আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে যান। আজকের সোমালিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া পর্যন্ত পৌঁছান। সেখানে মুসলিম বণিকদের সমৃদ্ধ উপনিবেশ দেখে তিনি বিস্মিত হন। তিনি লেখেন,জাঞ্জিবারের নারীরা মুক্তোর মতো সুন্দর, পুরুষেরা সাহসী, এবং বাজারগুলো সমুদ্রের বাণিজ্যে পরিপূর্ণ।

ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া

১৩৩৩ সালে ইবনে বতুতা ভারত পৌঁছান। সে সময় দিল্লিতে শাসন করছিলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক, যিনি তাঁকে সম্মানের সঙ্গে বিচারপতি (কাজি) পদে নিয়োগ দেন। দিল্লির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, শহরটি ছিল ‘দুনিয়ার এক মহৎ রাজধানী’। কিন্তু তুঘলকের অনিশ্চিত মেজাজ ও অতি বিলাসবহুল জীবনযাত্রা তাঁকে ক্লান্ত করে তোলে। পরে তিনি মালদ্বীপে যান, সেখানেও বিচারপতি হিসেবে কাজ করেন এবং স্থানীয় রাজপরিবারের এক নারীকে বিয়ে করেন।

শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

ইবনে বতুতা মালদ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কা যান, যেখানে তিনি আদম পাহাড় (Adam’s Peak) পরিদর্শন করেন। পরে তিনি সুমাত্রা, মালয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলে পৌঁছান। এসব স্থানে ইসলাম কীভাবে বাণিজ্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করেছেন।

চীন সফর

১৪শ শতাব্দীতে চীন ছিল বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ। গুয়াংজু (Canton) শহরে পৌঁছে ইবনে বতুতা চীনের প্রযুক্তি, শৃঙ্খলা, স্থাপত্য ও কারুশিল্পে মুগ্ধ হন। তিনি লিখেছেন,চীনে মানুষ তাদের কাজের প্রতি এতটাই নিবেদিত যে, মনে হয় সময় তাদের দাস।চীনের আদালতব্যবস্থা, নারীদের ভূমিকা এবং বাজারের সংগঠন সম্পর্কেও তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।

পশ্চিম আফ্রিকা

শেষ জীবনে তিনি সাহারা মরুভূমি পেরিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্যে যান। টিম্বাকটু ও গাও শহরের মুসলিম শিক্ষা ও বাণিজ্যকেন্দ্র দেখে তিনি অবাক হন।

রচনা রিহলা  ভ্রমণকে ইতিহাসে রূপদান

ইবনে বতুতা নিজে কোনো বই লেখেননি, তাঁর ফেরার পর মরক্কোর রাজা আবু ইনান ফারিস এর অনুরোধে তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনী মুখে বর্ণনা করেন। এই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন সাহিত্যিক ইবনে জুযাই, এবং এর নামকরণ হয় রিহলা (العبر في خبر من عبر) রিহলা গ্রন্থটি আজ বিশ্বের ইতিহাসবিদদের কাছে এক অমূল্য দলিল। এটি কেবল ভ্রমণ নয় এটি একটি সময়ের ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, বাণিজ্য ও সভ্যতার প্রতিফলন।তাঁর লেখায় মিশরের প্রশাসন, ভারতের সামাজিক বৈচিত্র্য, চীনের বাণিজ্যনীতি, মালদ্বীপের সমাজে নারীর অবস্থান সবকিছুই বিশদভাবে পাওয়া যায়।

ইবনে বতুতার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা

ইবনে বতুতা ছিলেন এক মানবিক পর্যবেক্ষক। তিনি মুসলিম সমাজকে একটি বিশ্বজনীন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয় এটি একটি সাংস্কৃতিক বন্ধন, যা উত্তর আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত মানুষকে যুক্ত করেছে।তাঁর দৃষ্টিতে, ইসলামি বিশ্ব ছিল পারস্পরিক শিক্ষা, বাণিজ্য ও আধ্যাত্মিকতার এক অভিন্ন নেটওয়ার্ক। তিনি যে সব দেশ ভ্রমণ করেছেন, সেখানে মুসলমানরা স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও পোশাকের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, কিন্তু বিশ্বাসে ছিল ঐক্যবদ্ধ। এই পর্যবেক্ষণ আজও বৈশ্বিক সভ্যতার বোঝাপড়ায় মূল্যবান।

সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতির বিশ্লেষণ

ইবনে বতুতার লেখা থেকে বোঝা যায়, তিনি ধর্মীয় মানুষ হলেও বাস্তববাদী ছিলেন। তিনি স্বীকার করেছেন, ইসলামি সমাজ সর্বত্র একই নয় কোথাও এটি কঠোর শরিয়াভিত্তিক, কোথাও আবার সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের মিশ্রণে উদার।রাজনীতির বর্ণনায় তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন যেমন দিল্লির দরবারের বিলাসিতা ও দুর্নীতি, বা মালদ্বীপে নারীদের স্বাধীনতা। তিনি কখনো প্রশংসা করেছেন, কখনো সমালোচনা। যা তাঁর নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ।

ইবনে বতুতা বনাম ইউরোপীয় অভিযাত্রী

প্রায় এক শতাব্দী পরে ইউরোপীয় অভিযাত্রী মার্কো পোলো তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত রচনা করেন। কিন্তু ইবনে বতুতা সেই তুলনায় অনেক বেশি এলাকা ভ্রমণ করেছেন প্রায় ১,২০,০০০ কিমি, যা পৃথিবীর ব্যাসের তিনগুণের সমান।যেখানে ইউরোপীয়রা প্রধানত অর্থনৈতিক বা উপনিবেশিক আগ্রহে ভ্রমণ করত, ইবনে বতুতা ভ্রমণ করতেন জ্ঞান, ধর্মীয় সাধনা ও মানবসম্পর্ক জানার তাগিদে।

ইবনে বতুতার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি

তাঁর রচনায় আমরা দেখি। তিনি কেবল শাসক, সৈনিক বা পণ্ডিতদেরই উল্লেখ করেননি, বরং সাধারণ মানুষ, নারীরা, শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও যাত্রীদের কথাও তুলে ধরেছেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, সভ্যতার সত্যিকারের পরিচয় লুকিয়ে থাকে সাধারণ মানুষের জীবনে। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে আলাদা করেছে সমকালীন লেখকদের থেকে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও উত্তরাধিকার

ইবনে বতুতার ভ্রমণ মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগের প্রতিচ্ছবি। তাঁর রচনা থেকে ইতিহাসবিদরা জানতে পারেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্ব ছিল এক বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, যা আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপকে যুক্ত করেছিল।তিনি প্রমাণ করেছেন যে ইসলাম কেবল ধর্ম নয়—একটি সভ্যতাগত শক্তি, যা শিক্ষা, বাণিজ্য, স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে এক অনন্য ঐক্য সৃষ্টি করেছিল।
আজও ইউনেস্কো তাঁর নাম স্মরণ (Ibn Battuta Prize for Travel Literature)প্রদান করে।

সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা

ইবনে বতুতার লেখা নিঃসন্দেহে অনন্য, তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে

) কখনো কখনো তাঁর বর্ণনা অতিরঞ্জিত বা শ্রুতিনির্ভর বলে মনে হয়।

) কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, তিনি সব জায়গায় নিজে যাননি; কিছু তথ্য শুনে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

) তবুও, তাঁর লেখার নৈতিকতা ও মানবিক অন্তর্দৃষ্টি এটিকে বিশ্বঐতিহ্যের এক অমূল্য নথি করে তুলেছে।

উপসংহার

ইবনে বতুতা ছিলেন ভ্রমণকারী, বিচারপতি, চিন্তাবিদ ও মানবতার দূত। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় জ্ঞান ও কৌতূহল মানুষের প্রকৃত শক্তি।তাঁর “রিহলা” শুধু এক ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, এটি এক যুগের আত্মজীবনী, যেখানে ইসলামী সভ্যতা, মানব সম্পর্ক ও বিশ্বসংস্কৃতি একসঙ্গে মিশে গেছে।আজ, যখন পৃথিবী প্রযুক্তি ও সীমানার দৌড়ে ছুটছে, তখন ইবনে বতুতার জীবন যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়ভ্রমণ মানেই কেবল দূরত্ব মাপা নয়, বরং মানুষ ও পৃথিবীকে নতুন করে দেখা।তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে “বিশ্বনাগরিক” (Citizen of the World)। তাঁর চোখে পৃথিবী ছিল এক বিশাল মসজিদযেখানে প্রত্যেক মানুষ আলাদা হলেও, মানবতা ছিল এক ও অভিন্ন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter