যাকাত: মানবজাতির জন্য আল্লাহর এক অতুলনীয় সমাজব্যবস্থা

 ইসলাম ধর্ম হল মহাবিশ্বের পালনকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালার কর্তৃক মনোনীত এক মহান ধর্ম, যার অগুণিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে ও যার সমস্ত নিয়ম-কানুন ও আদেশ, মানব প্রকৃতি ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী। ইসলামের সমস্ত শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতের মধ্যে অগণিত হিকমত এবং অগণিত উপকারিতা নিহত রয়েছে,  যার পূর্ণ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ জানেন। তবে আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে দ্বীনের বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে এসব জ্ঞান ও উপকারের কিছু জ্ঞান দান করেন, যা তারা তাদের জ্ঞান ও বোধগম্যতা অনুযায়ী তা বিশদ  ও ব্যাখ্যা করে।

 

 সকল ইবাদতের  উপকারিতা বা  ফল কখনো শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির সাথে আবার কখনো ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, কখনো কখনো কোনো ইবাদতের ফায়দা কেবলমাত্র সেই ব্যক্তির কাছেই পৌঁছায় যে  ইবাদত করছে, এবং কখনো কখনো ইবাদতকারীর সাথে অন্যদেরও উপকার হয়।  উদাহরণস্বরূপ, নামায যেহেতু শারীরিক ইবাদত, তাই এর ধর্মীয় ও পার্থিব ফায়দা কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই পায়। কিন্তু যাকাত হল এমন একটি ইবাদত, যা যাকাত প্রদানকারী এবং এর গ্রহণকারী উভয়েরই উপকার হয়।

 

যাকাত হল একটি আরবি শব্দ যার অভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘পবিত্রতা’ ‘বরকত’ বা ‘বৃদ্ধি’ । শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত শব্দের অর্থ হল নিজের সম্পদের শরীয়ত নির্ধারিত অংশের মালিক কোন এক হকদারকে বানিয়ে দেওয়া। যাকাত মালের অবশিষ্ট অংশকে পবিত্র করে দেয় এবং তাতে আল্লাহর বরকত ও কল্যাণ বর্ধিত হয়। ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা হল অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময় একটি বিষয়। যাকাত ইসলামের পঞ্চ বিধানের একটি, যেটি প্রত্যেক নিসাবের মালিক ব্যক্তিদের উপর অপরিহার্য। যাকাত হিজরী সন দ্বিতীয় সালে ফরজ হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন,

'তোমরা নামায কায়িম কর, যাকাত দাও এবং রুকূ‘কারীদের সঙ্গে রুকূ‘ কর'। (আল-কুরআন 2:43)

 

ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত নিসাবের মালিক অর্থাৎ ৭.৫ ভরি সোনা বা ৮৭.৪৭৯ গ্রাম সোনা অথবা সাড়ে ৫২ ভরি রুপো বা ৬১২.৩৫ গ্রাম রূপো, বা ব্যাবসার মাল ও নগদ অর্থের সমপরিমাণ পূর্ণ এক বছরের মালিক না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপরে যাকাত ফরজ হবেনা।

 

 

এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে যাকাত প্রদানের সুবিধাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।

 

আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ

 

এর উপকারিতার মধ্যে হচ্ছে বান্দা যেমন ভাবে নামাজে দণ্ডায়মান হয়ে আল্লাহ তায়ালার সামনে নিজের দাসত্ব ও আনুগত্য প্রকাশ করে যাতে সে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে, অনুরূপভাবে যাকাত প্রদান আল্লাহর জন্য নিজের অর্থ সম্পদ উৎসর্গ করে নজরানা পরিবেশন করা যেটি প্রমাণ করে যে  সেইগুলি তার নিজের নয় বরং আল্লাহর।

 

তাকওয়ার মূল্যায়ন

 

 আমাদের এটা জানা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তাদের তাকওয়া মূল্যায়ন এবং পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। কিছু মানুষকে ধনসম্পদ দিয়ে তাদের ধন্য করা হয়েছে এবং কিছু মানুষকে তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শরীয়তের নির্দেশানুসারে ধনী ব্যক্তিদের উপর যাকাত ফরয করা হয়েছে যে, সে যেন তার ধন-সম্পদ থেকে নির্ধারিত ফরজ পরিমাণ আল্লাহর পথে বের করে নেয়, যাতে ধন-সম্পদ থেকে বঞ্চিত লোকেরাও তা থেকে কিছু অংশ পায় এবং জীবনে কিছুটা স্বস্তি পায়।

 

অভাবী মানুষের দারিদ্র্যের অবসান

 

যাকাত হল অভাবী মানুষ ও তাদের দারিদ্র্য দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমরা দেখেছি এমন অনেক দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষ আছে যাদের চাহিদা মেটানোর উপায় নেই। অথবা যদিও থাকে, তবে সেইটি অনেক কষ্টে  তাদের চাহিদা পূরণ হয়। এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা ধনী মুসলমানের উপর ফরয করেছেন যে, তারা যেন দরিদ্র লোকদের জীবনকে সহজ করার জন্য যাকাত দিয়ে সাহায্য করে, যাতে তারা তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে।

 

  এখানে একটি বিষয়ের স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন যে, আমাদের মানব জীবনের প্রয়োজনীয়তা অনেক। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আছে যা বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক, যেমন পেটে দুমুঠো খাওয়ার জন্য খাবার, নিজের সতর ঢেকে রাখার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ কাপড় এবং মাথা লুকানোর জন্য একটি ঘর। এগুলি এমন জিনিস যা প্রতিটি মানুষের জন্য মৌলিক এবং প্রয়োজনীয়, যা ছাড়া মানুষের জীবন অস্থীর এবং কষ্টকর হয়ে যায়। অপরপক্ষে, কিছু প্রয়োজন এমন আছে যেগুলি মানব জীবনের পরিপূর্ণতার সাথে সম্পর্কিত। যেমন সমাজে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন এবং সুখী জীবনযাপনের জন্য পেশা ও ব্যবসা গ্রহণ করা। উভয়ের দুটিই মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ  যা যাকাত দ্বারা কিছুটা হলেও পূরণ হয়।

 

বেআইনি কাজ থেকে সুরক্ষা

 

যাকাত ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ মুসলমান তাদের সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করে না, এবং তারা লোভের বশবর্তী হয়ে নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে। চারপাশে দরিদ্রদের দেখেও তারা তাদের দান-খয়রাত করে না। তখন সমাজে চুরি, ডাকাতি, জুয়া খেলা ইত্যাদি শরীয়ত বিরোধী কাজের জন্ম হয়। যার কারণে সমাজের স্থিতিশীলতা ও শান্তিশৃঙ্খলা হ্রাস পায়। তখন, না ধনীরা শান্তিতে ঘুমাতে পারে, না মধ্যবিত্তের ঘর নিরাপদ থাকে। গোটা সমাজ এক ধরনের উদ্বেগ ও অস্থিরতায় ভুগে । যার প্রধান কারণ হল দারিদ্র্য ও কষ্ট। ধনীরা যদি তাদের সম্পদ থেকে যাকাত বের করে এবং অভাবগ্রস্তদের প্রয়োজনের জোগান দেয় তাহলে সমাজকে এ ধরনের অনিষ্ট থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যায়।

 

সম্পদের ভালোবাসার বিষাক্ত প্রভাব থেকে অন্তরের পরিশোধন

 

যখন ধন-সম্পদের প্রাচুর্য হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের অন্তরে সম্পদের প্রতি ভালোবাসা জাগে। গুরুত্বপূর্ণ ভাবে সম্পদের ভালোবাসা, লোভ এবং মায়া মমতা ঈমানকে দুর্বল করে দেয় যেটি আত্মার একটি মারাত্মক অসুখ। এর ভালোবাসা বান্দাদের মারাত্মক ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্পদ ব্যয় করা তাদের কাছে কঠিন হয়ে পড়ে। তারা এগুলিকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে এবং আরও বেশি করে সঞ্চয় করে রাখার কথা ভাবতে শুরু করে। যার কু-প্রভাব সমাজের অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায় পড়ে। কিন্তু যাকাত প্রদান তার বিষাক্ত প্রভাব থেকে অন্তরকে পবিত্র করে দেয়। সম্পদের প্রাচুর্যের আরেকটি বড় অসুবিধা হল ধনীরা তাদের বিলাসী বাসনা পূরণের জন্য অবাধে তাদের সম্পদ ব্যয় করে। তারা আল্লাহর প্রদত্ত সম্পদ অযথা ব্যবহার করে এবং আল্লাহর রাগ ও অসন্তুষ্টির পাত্র হয়ে ওঠে। এগুলো হল সেই নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কুফল যা ইসলাম তার যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করেছে।

 

 অনুরূপভাবে, সমাজের বেশির ভাগ মানুষ আজ দারিদ্রে ভুগছে, আর সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়ে গেছে মাত্র গুটিকয়েক পুঁজিপতির দখলে। এইজন্য যাকাত প্রদানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো , যাতে সম্পদ কোনো একজন বা বিশেষ কিছু ব্যক্তির কুক্ষিগত হয়ে না থাকে বা সমাজে এমন এক শ্রেণী তৈরি না হয়ে যায় যারা সম্পদের খাজনা বানিয়ে জমা করে রাখবে। ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা হল, যাতে সম্পদ সর্বদা আবর্তিত অবস্থায় থাকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট বন্টন হয়। এই জন্যে কুরআন যাকাতের হিকমত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে, ‘যাতে তোমাদের মধ্যে যারা ধনবান শুধু তাদের মধ্যেই ধন-মাল আবর্তন না করে’। (আল- কুরআন 59:7)

 

 

প্রথম ধাপে ইসলামের প্রচার কিছু দুর্বল অসহায় ব্যক্তিদের নিয়ে শুরু হয়, যারা একদম নিঃস্ব এবং দরিদ্র ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু, পরবর্তীতে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তাদের ইসলামের আদেশ অনুসরণ তাদেরকে ধনী এবং শক্তিশালী ব্যক্তিতে রুপান্তরিত করে। এর একটি উত্তম উদাহরণ হল খলিফা হযরত উমার বিন আব্দুল আজিজ এর খেলাফত কালের অর্থনৈতিক অবস্থা। তিনার খেলাফত সম্পূর্ণ ভাবে ইসলাম নিয়ম কানুন ভিত্তি অনুসারে হওয়ার কারণে এমন কোন দরিদ্র মানুষ ছিল না যারা যাকাত অথবা সদকা গ্রহণ করবে।

 

ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার প্রচার

 

আমরা অনেকেই জানি যে যাকাত প্রদানের সর্বোত্তম পন্থা হল প্রথমে আমাদের পরিবারের এবং আমাদের প্রতিবেশীদের দরিদ্রদের বিবেচনা করা, এবং যাকাতের সম্পদ দিয়ে তাদের সাহায্য করা, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাদের একটি সুন্দর জীবন লাভ করতে সক্ষম করা।  তাই যখন একটি পরিবারের চাহিদাগুলি আমরা পূরণ করি এবং তাদের জীবনের অসুবিধা এবং সমস্যাগুলিকে সহজ করে তুলি, তখন তাদের সাথে আমাদের একটি হৃদয় সংযোগ এবং ভালবাসা তৈরি হয়। আর এই ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা ইসলাম ধর্মের একটি মহান ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী, যাকে উপেক্ষা করে একটি ভালো জাতির ধারণা একটি কঠিন বিষয় থেকে যায়। যেমন, হিজরতের সময় মদিনা বাসীরা মক্কা থেকে আগমন নিঃস্ব অসহায় হিজরতকারীদের নিজের ধন দৌলতের অর্ধেক অংশীদার বানায় যেটি তাদের এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করে। ইসলামে এইটি একটি অমূল্য ভ্রাতৃত্বের পরিচয়।

 

উপসংহার

 

ইসলামে দারিদ্র দূরীকরণের সমাধান ও ব্যবস্থাপনা মানুষ তৈরি আইন সমূহ থেকে অতুলনীয় ও বেনজির। ইসলাম সমাজ ব্যবস্থার যে ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করেছে ও পথের দিশা দিয়েছে, পৃথিবীর অপরাপর আইনসমূহে সেইটি পাওয়া যায় না।  আজও আমি বিশ্বাস করি যে যদি মানুষ ইসলামের তৈরী অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থার বাস্তবায়ন করে তাহলে দারিদ্রতার মুখ থেকে অসহায় মানুষরা পরিত্রাণ পাবে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter