ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাসাদ ও ভিলা নির্মাণ কতটা জায়েজ

ইসলাম হলো এক শান্তি ও শৃঙ্খলার  ধর্ম। এই ইসলামের  বিপক্ষে ছিল এক জাহেলী সভ্যতা। যে সভ্যতায়  বড়রা ছোটদের উপর অত্যাচার করত এবং সবল দুর্বলকে মারধর করত। খেল-তামাশা ও চরিত্রহীনতার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এবং পদ ও সম্পদ, ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের উপকরণ সংগ্রহের জন্য ছিল কঠিন প্রতিযোগিতা এবং তারা নিজেদের আরাম অর্থাৎ তারা নিজেদের শক্তির অহংকার দেখিয়ে ছোটোদের মারধর করত। এমনকি এর ফলে পৃথিবী একটি রণক্ষেত্রে এবং জীবন-যন্ত্রণায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এই সভ্যতাকে হার মানিয়ে প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর নির্দেশে ইসলাম এর প্রবর্তন করেন।  ক্রমে ইসলাম সর্বনিলীমা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে ইসলামি স্থাপত্য প্রচুর পরিমানে নির্মাণ করার করা হয়। অতএব ইসলাম এখন পরস্পর স্থাপত্য তৈরি করে এসেছে। 

স্থাপত্য শিল্পে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট প্রসর। অতএব  ইসলাম মুসলিমদের স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের অনুমোদন দেয়। তাতে শৈল্পিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর অনুমোদনও দেয়। বাড়িঘর এবং অট্টালিকা কারুকার্যময় করার অনুমতিও দেয়। তবে তা সবই হতে হবে  নিজের ধন সম্পদ প্রকাশ করে আল্লাহ তায়ালা কে খুশি করার নিমিত্তে। স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কুরআন মাজীদে বলেন, وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ এবংমহানবী মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন  “আল্লাহ তায়ালা নিজের বান্দার উপর দেওয়া নিয়ামতের ফলাফল  দেখতে পছন্দ করেন”  অতএব  অহংকার প্রকাশ না করার ও বিলাসিতা প্রকাশ না করার শর্তে এবং অপব্যয় ব্যতিরেকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। আল-কুরআনে ‘হুসুন’ বা কিল্লা, বুরুজ বা উচ্চ অট্টালিকা ও দুর্গ, “বিনা” বা দালান ঘর,জুদুর বা দেয়াল, র্সাহ বা প্রাসাদ, কুরা মুহাস্সানা বা ‘সুরক্ষিত জনপদ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যেমন এক আয়াতে আল্লা হতায়ালা বলেন “তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করো”। অর্থাৎ তোমরা সৃদুঢ় উচ্চ দুর্গেঅবস্থান করলেও তোমাদের মৃত্যু অবশ্যই আসবে।  তোমরা মৃত্যু থেকে কিছুতেই রেহাই পাবে না, পালাতে পারবে না। এ আয়াত থেকে প্রমাণ হয়,সুদৃঢ় উচ্চ দুর্গও অট্টালিকা নির্মাণ করা ও তাতে বসবাস করা বৈধ। 

আল্লাহতায়ালা অপর এক আয়াতে বলেন, তাকে বলা হলো, ‘প্রাসাদটিতে প্রবেশ কর’। অতঃপর যখন সে তা দেখল, সে তাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং তার পায়ের নলাদ্বয় অনাবৃত করল। সুলাইমান আলাহিসসালাম বললেন, ‘এটি আসলে স্বচ্ছ কাচ-নির্মিত প্রাসাদ। এ আয়াতটিও প্রমাণ করে যে, অতি উচ্চমানের শিল্পসম্মত সুরম্য বাড়ি ও প্রাসাদ নির্মাণ করা বৈধ। কারণ সুলাইমান (আ.) একটি স্বচ্ছ কাচের উচ্চমানের শিল্পসম্মত প্রাসাদ নির্মাণ করে তার তলদেশ দিয়ে পানি প্রবাহি ত করেন। তিনি এমন সুকৌশলে নির্মাণ করেন যে, যারা এর সম্পর্কে অবগত নয়, তারা মনে করে, তা পানি। অথচ পানি এবং পথচারীর মধ্যে স্বচ্ছ কাচের আবরণ রয়েছে। ফলে তার পায়ে পানি লাগার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ থেকে বোঝা যায় যে, সুলাইমান (আ.) নির্মিত এ প্রাসাদটিতে অতি উচ্চমানের শিল্প নৈপুণ্যের সমাবেশ ঘটেছিল এবং এ জাতীয় শিল্পমানের প্রাসাদ তৈরি করা এবং প্রাসাদকে কারুকার্যময় করা, তাতে বসবাস করা ইসলামে বৈধ।

সাহাবিদের পর তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিনের যুগে এবং তার পরবর্তী যুগেও মুসলিমরা পৃথিবীর সর্বত্র নির্দ্বিধায় অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। আমি মনে করি, কেবল নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসের জন্য বহুতল অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করা মাকরুহ থেকে মুক্ত নয়। তবে ব্যবসার মাধ্যম হিসাবে ভাড়া দিয়ে অর্থ রোজগার করার জন্য অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করা মাকরুহ নয়। বরং তা সাওয়াবের কাজও হতে পারে, যদি মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধানকল্পে তা তৈরি করা হয়। বিশেষত তা যদি বড় বড় শহরগুলোতে তৈরি করা হয়। 

বর্তমান যুগে আমাদের এ ঢাকা শহরের মতো শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ করা না হলে; আরও দু-চার দশটি ঢাকা শহরের মতো শহরের প্রয়োজন হবে। তখন দেখা দেবে তীব্র ভূমি সংকট। ইসলাম এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না, যা মানুষের সমস্যা বাড়ায়। ইসলাম এসেছে মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য, সমস্যা বাড়ানোর জন্য নয়। এ কারণেই ফকিহরা বলেছেন, ‘যেখানেই মানব কল্যাণ সেখানেই ইসলাম’। স্থাপত্য শিল্প তৈরি করার সময় তাতে উন্নত নির্মাণ শিল্প কৌশল ব্যবহার করে, মজবুতভাবে, শান্তিতে বসবাস করতে পারার মতো করে এবং ইবাদত-বন্দেগি, বিশেষত সালাত আদায়ের পরিবেশ তৈরি করে তা নির্মাণ করতে হবে। আরও খেয়াল রাখতে হবে, যাতে যেখানে দ্বীনের বিধান রক্ষা সহজতর হয়। আরও মনে রাখতে হবে, মানুষ এ পৃথিবীতে চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসেনি, তাকে তার রবের কাছে অবশ্যই একদিন আবার ফিরে যেতে হবে। অতএব, স্থাপত্য শিল্প নির্মাণকালে এ কথা মনে রেখেই তা তৈরি করতে হবে। তাতে বাড়াবাড়ি ও বিলাসিতা যাতে না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবেই স্থাপত্য শিল্প ইসলামসম্মত হবে। 

বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম দেশ। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম। তাই এ দেশের স্থাপত্য শিল্প অবশ্যই ইসলামি স্থাপত্য শিল্প-নীতিমালা অনুসরণ করে নির্মাণ করা বাঞ্ছনীয়। এ দেশে র সংখ্যাগরিষ্ঠ মা নুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণনয় এমন স্থাপত্য কর্মশিল্প বা সংস্কৃতির নামে তৈরি করা এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কখনোই কাম্য হতে পারে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশের অধিকাংশ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধকে ধারণ করে এমন একটি আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। উল্লেখ্য, এ দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ হলেও অমুসলিম জনগোষ্ঠীর শিল্প, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে। যা বিশ্বধর্ম ইসলামের উদারতার বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামি নির্দেশনা মতো স্থাপত্য শিল্প তৈরি করার তাওফিক দিন এবং হিংসা ও অহংকার থেকে বিরত থাকার তৌফিক দিন ।  (আমিন)

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter