ইসলামের দৃষ্টিতে জুয়ার বিধি বিধান এবং এর প্রচলিত রূপ

আধুনিক প্রযুক্তি এবং নিত্যনতুন আবিষ্কার মানবজীবনে অসংখ্য সুবিধা নিয়ে এসেছে। তবে, এই সুবিধাগুলো থেকে লাভ বা ক্ষতি পাওয়া সম্পূর্ণরূপে মানুষের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। কারণ, অনেক আবিষ্কার এমন আছে যার মাধ্যমে ধর্ম প্রচার এবং নেক কাজ সহজেই সম্পন্ন করা যেতে পারে। অন্যদিকে, কিছু ডিজিটাল মাধ্যমও রয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষ সহজেই পাপের লিপ্ত হতে পারে। এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে, জুয়া নানা রূপ ও উপায়ে নতুন প্রজন্মকে তাদের হিংস্র চৌকাঠে আবদ্ধ করে রেখেছে এবং এর অনুসারীদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমে কিছু জুয়াড়ি ও সাট্টাবাজ তাদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে খেলার অংশ হিসেবে এই বিপজ্জনক পথে পা বাড়ায়। ফলস্বরূপ, ধীরে ধীরে তারা নিজেদেরই খনন করে গভীর গর্তে ডুবে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত জীবনের সৎ পথ হারিয়ে সর্বনাশের দিকে ধাবিত হয়। এমনকি যদি কোনো জুয়াড়ির হাতে কিছু টাকা-পয়সা আসে, সেটি নিষিদ্ধ এবং হারাম হিসেবে গণ্য হয়। এবং যদি সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সে গুনাহের সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আলাদা করে লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়। মোট কথায় , জুয়া সবসময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

জুয়ার সংজ্ঞা: জুয়া হলো এমন এক চুক্তি, যেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে শর্ত থাকে এবং পরাজয়ের ক্ষেত্রে নিজের টাকা হারানোর ঝুঁকি থাকে এবং জয়ের ক্ষেত্রে অন্যের টাকা পাওয়ার আশা থাকে। দারুল মুখতার এবং রদ্দুল মুখতারে আছে: "পুরস্কার বৈধ, যদি শর্ত এক পক্ষের পক্ষ থেকে থাকে। কিন্তু উভয় পক্ষ থেকে শর্ত থাকলে তা হারাম, কারণ তখন এটি জুয়া হয়ে যায়। হ্যাঁ, যদি তারা তাদের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে একজন বৈধকারীকে অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে তা বৈধ হবে।

হযরত মীর সিদ শরীফ জুরজানী (রহ.) জুয়ার সংজ্ঞায় লিখেছেন: 

كل لعب يشترط فيه غالبًا من المتغالبين شيء من المغلوبمعجم التعريفات، ص١٥٠"  

প্রত্যেক সেই খেলা যেখানে এই শর্ত থাকে যে পরাজিতের (অর্থাৎ যে হেরে যাবে) কিছু জিনিস বিজয়ী (অর্থাৎ যে জিতবে) পাবে।

কুরআন ও হাদীসে জুয়ার নিন্দা: আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন: 

یَسۡـَٔلُوۡنَكَ عَنِ الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِؕ قُلۡ فِیۡهِمَاۤ اِثۡمٌ كَبِیۡرٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ ۫ وَ اِثۡمُهُمَاۤ اَكۡبَرُ مِنۡ نَّفۡعِهِمَا ؕ وَ یَسۡـَٔلُوۡنَكَ مَا ذَا یُنۡفِقُوۡنَ ۬ؕ قُلِ الۡعَفۡوَؕ كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَكُمُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّكُمۡ تَتَفَكَّرُوۡنَ (সুরা আল-বাকারা- ২১৯)

কানজুল ঈমান অনুবাদ: তোমার কাছে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি বলে দাও যে এ দুটিতে বড় গুনাহ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু দুনিয়াবি লাভও রয়েছে, কিন্তু এ দুটির গুনাহ তাদের লাভের চেয়ে অনেক বড়।

মদ ও জুয়ার কিছু দুনিয়াবি সুবিধা আছে: মদ্যপানে কিছু সময়ের জন্য আনন্দ ও সুখ পাওয়া যায় এবং জুয়া থেকে কখনো কখনো বিনামূল্যে অর্থ লাভ করা যায়। কিন্তু ক্ষতি ও গুনাহের কোনো সীমা নেই: বুদ্ধি ও সচেতনতার হারানো, মর্যাদা ও লজ্জার অভাব, ঘৃণা ও শত্রুতার শিকার হওয়া, ইবাদতে অলসতা, এবং সময় ও সম্পদের অপচয়।

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

 يٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡہُ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ (সুরা আল-মায়েদা- ৯০)

কানজুল ঈমান অনুবাদ: হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।

হাদিসে শরীফেও বহু স্থানে জুয়ার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। যেমন, জুয়ার একটি খেলার প্রসঙ্গে হযরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন: "যে ব্যক্তি নর্দশীর (জুয়ার একটি খেলা) খেলেছে, সে যেন নিজের হাত শূকরের মাংসে ও রক্তে ডুবিয়েছে।" (মুসলিম শরীফ)

 অন্য একটি হাদিসে আছে: وَمَنْ قَالَ لِصَاحِبِهِ تَعَالَ أُقَامِرْكَ فَلْيَتَصَدَّقْ" “- যে ব্যক্তি তার সঙ্গীকে বলে ‘চল, আমরা জুয়া খেলি’, তাকে উচিত যে সে (কাফ্ফারা হিসেবে) দান করবে। (বুখারি শরীফ)

অর্থাৎ, জুয়া খেলা তো দূরের কথা, জুয়া খেলার আমন্ত্রণ জানানোও এমন পাপ যা থেকে পরিত্রাণ পেতে দান করা উচিত।

জুয়ার কিছু প্রচলিত রূপ: 

জুয়ার কিছু রূপ একেবারে স্পষ্ট ও প্রকাশিত, যার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এবং জ্ঞানীরা সবাই সচেতন। বরং যিনি আল্লাহর তাওফিক লাভ করেছেন, তিনি এ থেকে বিরত থাকেন। অপরপক্ষে, বর্তমান যুগে যখন সাট্টাবাজি, শর্তবাজি এবং জুয়া খেলা সর্বোচ্চ শিখরে, তখন এগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য নানান পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। তখন সহজ-সরল মানুষ জুয়ার আকর্ষণীয় এবং মনোরম রূপের প্রলোভনে পড়ে যায় এবং তার অজ্ঞতার কারণে বড় গুনাহের শিকার হয়। এ কারণে জুয়ার আধুনিক পদ্ধতিগুলোর বিশদ বর্ণনা প্রয়োজন।

আরও কিছু জুয়ার পদ্ধতি একেবারে প্রকাশ্য এবং প্রচলিত, যা মানুষ চলতে চলতে বা কথার ছলে করে বসে। যেমন: দৌড় বা খাওয়া-দাওয়ার প্রতিযোগিতায়, যেমন কেউ দাবি করে যে সে এক বারে এক কেজি লাড্ডু খেয়ে ফেলবে, বা এক কাপ গরম চা বা এক বোতল ঠান্ডা পানীয় এক নিঃশ্বাসে পান করে ফেলবে। যদি না করতে পারে, তাহলে সে এক হাজার টাকা দেবে, আর যদি করে ফেলে, তাহলে সে এক হাজার টাকা পাবে। তেমনই ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল বা অন্যান্য খেলায়ও এমন হয় যে, নির্দিষ্ট একটি দল জিতলে এক পক্ষ অন্য পক্ষের কাছ থেকে টাকা নেবে, আর দল হারলে উল্টোটি হবে। এগুলো সবই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত, কারণ এতে জয়ী হলে অন্যের টাকা পাওয়া যায় এবং পরাজিত হলে নিজের টাকা হারানোর ঝুঁকি থাকে।

কখনো কখনো পশুর মধ্যে প্রতিযোগিতা করানো হয় এই শর্তে যে, যদি আমার পশু জিতে যায়, তাহলে আপনি আমাকে টাকা বা কোনো সামগ্রী দেবেন, আর যদি আপনার পশু জিতে এবং আমারটি হারায়, তাহলে আমি দেব। এটিও জুয়ার একটি রূপ। তাছাড়া পশুদের মধ্যে মারামারি করানো একটি আলাদা অপরাধ ও পাপ।

লটারী (Lottery):

কিছু দোকানে এক ধরনের বিশেষ লটারী বিক্রি করা হয়, যা একটি টিকিট আকারে হয় এবং অনলাইনেও বিক্রি ও কেনা হয়। এই ক্ষেত্রে, ক্রেতার কখনো কখনো পুরো টাকাই ডুবে যায়, আবার কখনো কিছু টাকা বেশি বা কম পাওয়া যায়। এটিও জুয়ার একটি ধরন।

ড্রিম ইলেভেন (Dream11):

এতে ফি দিয়ে দল তৈরি করা হয়, তারপর যদি আপনার তৈরি করা দল ভালো খেলে, তাহলে দলের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে টাকা পাওয়া যায়, অন্যথায় নিজের টাকাও হারিয়ে যায়। এটিও জুয়ার একটি রূপ।

মাই ইলেভেন সার্কেল (My11 Circle):

এতে ড্রিম ইলেভেনের মতোই দল তৈরি করতে হলে প্রথমে টাকা দিতে হয়। যদি নিজের দল ভালো করে, তাহলে লাভ হয়, অন্যথায় ক্ষতি। তাই এর বিধানও ড্রিম ইলেভেনের মতোই হবে।

অনলাইন লুডো গেম (Online Ludo Game):

বিভিন্ন নামে অনেক লুডো গেম প্লে স্টোরে পাওয়া যায়, যেখানে টাকা দিয়ে খেলাও হয়। জিতলে অন্যের টাকা পাওয়া যায় এবং হারলে নিজের টাকা নষ্ট হয়। তাই এটিও জুয়ার আওতায় পড়বে।

A23 রামি, রামি সার্কেল, জাঙ্গলি রামি ইত্যাদি:

এই সমস্ত প্ল্যাটফর্মে তাস অনলাইনে খেলা হয়। এখানেও টাকা দিয়ে খেলা হয়। পরাজিত হলে নিজের টাকা হারাতে হয় এবং বিজয়ী হলে পরাজিতের টাকা পাওয়া যায়। তাই এটিও জুয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে।

কালার ট্রেডিং গেম (Coluor Trading Game):

কালার ট্রেডিং গেম বা কালার প্রেডিকশন গেমের (Coluor Prediction Game) অধীনে বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে যেখানে টাকা দিয়ে রংয়ের পূর্বানুমান করতে হয়। যদি আপনার অনুমান সঠিক হয়, তবে প্রায় দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যায়, আর যদি ভুল হয়, তবে পুরো টাকা হারাতে হয়। এটিও জুয়ার শ্রেণিতে পড়বে।

উপরোক্ত পংক্তিগুলিতে যুবকদের মধ্যে প্রচলিত এবং বিখ্যাত জুয়ার কয়েকটি রূপ উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে যেসব রূপ বর্তমানে বিদ্যমান অথবা ভবিষ্যতে আসবে, যদি তা উল্লেখিত পদ্ধতির মতো হয়, তবে সেগুলোও জুয়ার আওতায় পড়বে।

জুয়ার উপার্জনের বিধান:

আলা হযরত (রহ.) বলেন: "সুদ, চুরি, গাস্ব এবং জুয়ার টাকা সম্পূর্ণ হারাম।" (ফতোয়া রিজভিয়া, খণ্ড-১৯)

সুতরাং, যারা জুয়ার অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ যে, যদি আপনি এমন বড় অপরাধ করেছেন, তবে আল্লাহর দরবারে আন্তরিকভাবে তওবা করুন এবং সর্বদা তা থেকে বেঁচে থাকার দৃঢ় সংকল্প করুন। জুয়া থেকে উপার্জিত অর্থ প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিন, যদি তাকে না পাওয়া যায়, তবে তার উত্তরাধিকারীদের কাছে দিন। যদি তাদেরও খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে প্রাপ্ত অর্থ ও সম্পদ ফকিরদের মধ্যে বিতরণ করুন।

আল্লাহ আমাদের সকলকে হারাম সম্পদ থেকে বাঁচার এবং হালাল রিজিক উপার্জনের তাওফিক দান করুন।



Translated from (islamonweburdu)

 جوئے (Gambling) کی رائج صورتوں کی تباہ کاریاں اور ان کے احکامات (– Muhammad Ashraf Raza Alimi

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter