ইসলামী ও সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে অঙ্গদান: একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ
ভূমিকা:
অঙ্গদান আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা অঙ্গবিকল রোগীদের জন্য নতুন জীবনের আশা জাগায়। এর মাধ্যমে একজন দাতা অনেকগুলো জীবন রক্ষা করতে পারেন। তবে, অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নানান ধরনের নৈতিক, ধর্মীয় এবং আইনি প্রশ্ন উত্থাপন করে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মানবদেহের পবিত্রতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এটি ইসলামি আইন (শরিয়া) অনুসারে সম্মানিত। এই প্রবন্ধে সেক্যুলার এবং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি উভয়টিই বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং কিভাবে তারা একে অপরের সাথে একত্রিত অথবা ভিন্নমত পোষণ করে, তা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রবন্ধটি ইসলামী সমাজে বিদ্যমান মতপার্থক্য এবং সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির নৈতিক মানদণ্ডের মধ্যকার সম্পর্কও তুলে ধরবে।
সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ:
সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে অঙ্গদান একটি নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং তার শরীর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের ওপর ভিত্তি করে। সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে দুটি প্রধান নীতি গুরুত্বপূর্ণ:
- ব্যক্তিগত স্বাধীনতা:
সেক্যুলার পদ্ধতিতে, ব্যক্তিরা তাদের শরীর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ অধিকার রাখে। তারা চাইলে মৃত্যুর পর তাদের অঙ্গ দান করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সাধারণত, এটি 'অপ্ট-ইন' বা 'অপ্ট-আউট' পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। অপ্ট-ইন পদ্ধতিতে, ব্যক্তি জীবদ্দশায় সম্মতি প্রদান করতে পারেন, যা মৃত্যুর পর তার ইচ্ছার ভিত্তিতে কার্যকর হয়। অন্যদিকে, অপ্ট-আউট পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে অঙ্গদানে সম্মতি দেওয়ার পরিবর্তে অপারত থাকতে হয়। এই প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে চাইলে ব্যক্তি পূর্বে ঘোষণা দিতে পারে।
- উপযোগবাদী পদ্ধতি:
সেক্যুলার দর্শনে, বৃহত্তম সংখ্যার সর্বোচ্চ মঙ্গল সাধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেক্যুলার নীতিতে, একজন দাতার অঙ্গ দ্বারা একাধিক মানুষের জীবন রক্ষা করা যায়, যা সামাজিক উপকারের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। এখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে জনকল্যাণের ধারণা একীভূত হয়।
আইনগত কাঠামো ও নৈতিক মূল্যবোধ:
অনেক সেক্যুলার দেশে অঙ্গদানের জন্য বিশেষ আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, এবং কানাডার মতো দেশে অঙ্গদান আইনি কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হয়। এই কাঠামোতে চিকিৎসাগত ও আইনি প্রক্রিয়া নির্ধারিত থাকে। এছাড়া, ব্যক্তির অবহিত সম্মতি এবং তার ইচ্ছা প্রকাশের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ:
ইসলামে অঙ্গদান সম্পর্কে আলেমদের মতামত জটিল এবং বহুমুখী। ইসলামী আইনের প্রধান দুটি নীতি অঙ্গদান নিয়ে মতামতের ভিত্তি গড়ে তোলে:
- মানবদেহের পবিত্রতা ও সম্মান:
ইসলামে মানবদেহকে জীবিত বা মৃত উভয় অবস্থাতেই সম্মান দেওয়া আবশ্যক। এটি কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং হাদিসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, "মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙা জীবিত ব্যক্তির হাড় ভাঙার সমান।" এই নীতি মানবদেহের সম্মান ও পবিত্রতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। কিছু আলেম এই নীতির আলোকে অঙ্গদানকে নিষিদ্ধ করেছেন, কারণ এটি মৃতদেহের পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে।
- জীবন সংরক্ষণ:
পাশাপাশি ইসলামী শরিয়াহ জীবন সংরক্ষণকে এক অন্যতম উচ্চ আদর্শ হিসেবে মূল্যায়ন করে। কুরআনে বলা হয়েছে, "যে কেউ একটি জীবন রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করে" (কুরআন ৫:৩২)। যারা অঙ্গদান সমর্থন করেন, তারা যুক্তি দেন যে এই নীতিটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অঙ্গদানকে দানশীলতার একটি কাজ ও জীবন রক্ষার উপায় হিসেবে অনুমোদন করা উচিত।
উলামা দের মধ্যে বিভিন্ন মতামত
মুসলিম উলামারা অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্পর্কে দুটি প্রধান গ্রুপে বিভক্ত:
গ্রুপ ১: (মূলত ভারত এবং পাকিস্তান থেকে):
এই গ্রুপের মতে, সকল পরিস্থিতিতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও দান করা অনুমোদনযোগ্য নয় (হারাম)।
কুরআন এবং হাদিস থেকে প্রমাণ: (কুরআন থেকে প্রমাণ)
- সূরা আল-ইসরা (১৭:৭০):
"وَ لَقَدۡ كَرَّمۡنَا بَنِیۡۤ اٰدَمَ وَ حَمَلۡنٰهُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ رَزَقۡنٰهُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلۡنٰهُمۡ عَلٰی كَثِیۡرٍ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِیۡلًا ".
অর্থ: “আর অবশ্যই আমরা আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সাগরে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; এবং তাদেরকে উত্তম রিযক দান করেছি এবং আমরা যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্ৰেষ্ঠত্ব দিয়েছি”।
কুরআন আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছে, যা নির্দেশ করে যে মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গ কেটে ফেলা বা বিকৃত করা আল্লাহর সৃষ্টিকে অসম্মান করা।
- সূরা আল-বাকারা (২:১৭৩):
"اِنَّمَا حَرَّمَ عَلَیۡكُمُ الۡمَیۡتَۃَ وَ الدَّمَ وَ لَحۡمَ الۡخِنۡزِیۡرِ وَ مَاۤ اُهِلَّ بِهٖ لِغَیۡرِ اللّٰهِ فَمَنِ اضۡطُرَّ غَیۡرَ بَاغٍ وَّ لَا عَادٍ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡهِ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ".
অর্থ: “তিনি আল্লাহ তো কেবল তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত এবং যার উপর আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু যে নিরূপায় অথচ নাফরমান এবং সীমালংঘনকারী নয় তার কোন পাপ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”।
এই আয়াতে মানুষের ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত ও নিষিদ্ধ বস্তুগুলির বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে মানুষ মানুষকে ব্যবহার বা ভোগ করার জন্য নয়।
হাদিসের প্রমাণ:
- সহিহ বুখারি (খন্ড ৭, হাদিস ৫৯৪০):
"مُحَمَّدٌ حَدَّثَنَا عَبْدَةُ عَنْ عُبَيْدِ اللهِ عَنْ نَافِعٍ عَنْ ابْنِ عُمَرَ قَالَ لَعَنَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلمالْوَاصِلَةَ وَالْمُسْتَوْصِلَةَ وَالْوَاشِمَةَ وَالْمُسْتَوْشِمَةَ".
মুহাম্মদ (রহঃ) ... ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ “পরচুলা লাগাবার পেশা অবলম্বনকারী নারী, যে নিজের মাথায় পরচুলা লাগায় উল্কি উৎকীর্ণকারী নারী এবং যে উৎকীর্ণ করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অভিশাপ করেছেন”।
নবী (সা.) মানুষের চুল কৃত্রিমভাবে লম্বা করার জন্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। এই গ্রুপের উলামারা বলেন, যদি চুল ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হয়, তবে অন্যান্য অঙ্গগুলিও প্রতিস্থাপনের জন্য অনুমোদনযোগ্য নয়।
- সুনান আবি দাউদ: মৃতদেহের হাড় ভাঙ্গা জীবিত দেহের হাড় ভাঙ্গার সমান অপরাধ, যা নির্দেশ করে যে জীবিত এবং মৃত উভয় দেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক।
গ্রুপ ২: (মূলত আরব উলামা এবং কিছু ইন্দো-পাক উলামা ):
এই গ্রুপ নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও দান অনুমোদন করে।
কুরআন এবং হাদিস থেকে প্রমাণ:
- সূরা আল-মায়েদা (৫:৩২):
"مِنۡ اَجۡلِ ذٰلِكَ كَتَبۡنَا عَلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اَنَّهٗ مَنۡ قَتَلَ نَفۡسًۢا بِغَیۡرِ نَفۡسٍ اَوۡ فَسَادٍ فِی الۡاَرۡضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیۡعًا وَ مَنۡ اَحۡیَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحۡیَا النَّاسَ جَمِیۡعًا وَ لَقَدۡ جَآءَتۡهُمۡ رُسُلُنَا بِالۡبَیِّنٰتِ ۫ ثُمَّ اِنَّ كَثِیۡرًا مِّنۡهُمۡ بَعۡدَ ذٰلِكَ فِی الۡاَرۡضِ لَمُسۡرِفُوۡنَ".
অর্থ: “এ কারণেই বনী ইসরাঈলের উপর এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা বা যমীনে ধ্বংসাত্মক কাজ করার কারণ ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমার রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলেন, তারপর এদের অনেকে এর পরও যমীনে অবশ্যই সীমালংঘনকারী”।
এই আয়াতটি উল্লেখ করে যে, একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানবজাতির জীবন বাঁচানোর সমতুল্য। যদি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে জীবন রক্ষা করা যায়, তাহলে এই নীতির ভিত্তিতে এটি অনুমোদনযোগ্য।
- প্রয়োজনীয়তার নীতি: জীবন-হানিকর পরিস্থিতিতে (যেমন, শূকর মাংস বা মদ গ্রহণ) নিষিদ্ধ জিনিসসমূহ অনুমোদনযোগ্য হয়ে যায়। এই গ্রুপ জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য একই যুক্তি প্রয়োগ করে।
অনুমোদনের শর্তাবলী
দ্বিতীয় গ্রুপের উলামারা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য কিছু শর্ত নির্ধারণ করেছেন:
- জীবিত ব্যক্তির থেকে অঙ্গ:
দাতা ব্যক্তির জীবন ঝুঁকিতে পড়বে না এবং তার স্বাস্থ্যের বড় কোনো ক্ষতি হওয়া উচিত নয়।
উদাহরণ: রক্ত দান অনুমোদনযোগ্য কারণ এটি পুনরায় তৈরি হয়।
- মৃত ব্যক্তির থেকে অঙ্গ:
মৃত ব্যক্তির পূর্বানুমতি, তার উত্তরাধিকারী বা মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতার অনুমতি প্রয়োজন।
অঙ্গ লাভের জন্য বিক্রি করা যাবে না।
- ভ্রূণের ক্ষেত্রে:
শর্তগুলির মধ্যে রয়েছে গর্ভপাত, চিকিৎসাগত গর্ভপাত (MTP), এবং জরায়ুর বাইরের ভ্রূণ।
ইসলামিক ফিকাহ কাউন্সিলের রায়
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেদ্দায় (আরব) ইসলামিক ফিকাহ কাউন্সিলের অধিবেশনে উলামা ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে আলোচনা করেন। তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন অনুমোদনযোগ্য। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়:
- চিকিৎসা প্রক্রিয়াটি যথাযোগ্য সম্মানের সাথে পরিচালনা করতে হবে, তা জীবিত বা মৃত দেহের ক্ষেত্রেই হোক।
- দাতা ব্যক্তির পূর্বানুমতি থাকতে হবে বা তার উত্তরাধিকারী অনুমতি দিতে হবে।
- অঙ্গ অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা যাবে না; চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যয়ের ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলোচনা চলছে।
আলোচনা: প্রমাণের প্রয়োগ
দ্বিতীয় গ্রুপের উলামা রা বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে তাদের অবস্থানকে সমর্থন করেন:
- জীবন-রক্ষাকারী অপারেশন: উদাহরণস্বরূপ, মা এবং শিশুকে বাঁচানোর জন্য সিজারিয়ান অপারেশন অনুমোদনযোগ্য, যদিও এতে পেট কাটা লাগে। এটি দেখায় যে জীবন বাঁচানোর জন্য অঙ্গ কাটার অনুমোদন থাকতে পারে।
- রক্ত সঞ্চালন: রক্ত সঞ্চালন সব উলামাদের দ্বারা অনুমোদিত, এবং এটি দুধ দানের মতো বিবেচিত হয়, যা দেখায় যে সব ধরনের অঙ্গ বা শরীরের অংশ দান নিষিদ্ধ নয়।
উভয় দৃষ্টিকোণে নৈতিক বিবেচনা:
উভয় ইসলামিক ও সেক্যুলার দৃষ্টিকোণেই নৈতিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সম্মতি ও স্বাধীনতা:
উভয় কাঠামোতেই সম্মতির গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামিক দৃষ্টিকোণে আলেমরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্মতির গুরুত্ব দেন, যা সেক্যুলার দৃষ্টিকোণে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে পার্থক্য হল যে ইসলামে সম্মতিটি অবশ্যই ধর্মীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
- দানশীলতা ও সাদাকাহ:
অঙ্গদানের দানশীল দিকটি উভয় দৃষ্টিকোণেই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে দান (সাদাকাহ) অত্যন্ত পুরস্কৃত এবং কিছু আলেম অঙ্গদানকে একটি দানের রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যদি তা ধর্মীয় নীতির পরিপন্থী না হয়। সেক্যুলার দৃষ্টিকোণও দানশীলতাকে উৎসাহিত করে, যা সমাজের জন্য একটি উপকারী কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আইনগত ও চিকিৎসাগত দৃষ্টিকোণ:
সেক্যুলার দেশগুলো প্রায়শই মস্তিষ্কের মৃত্যু বা চিকিৎসাগত সংজ্ঞার ভিত্তিতে অঙ্গদানের জন্য আইনি কাঠামো স্থাপন করে। ইসলামিক আলেমরা এই চিকিৎসাগত মানদণ্ড নিয়ে বিতর্ক করেন। কিছু আলেম আধুনিক চিকিৎসাগত সংজ্ঞাকে গ্রহণ করেন, অন্যরা প্রচলিত নির্দেশক যেমন রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হওয়ার লক্ষণকে প্রয়োজনীয় মনে করেন।
আইনগত ও চিকিৎসাগত দৃষ্টিকোণ থেকেও সেক্যুলার এবং ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য এবং মিল রয়েছে। সেক্যুলার দেশগুলো সাধারণত মস্তিষ্কের মৃত্যুকে বৈধ এবং স্বীকৃত একটি মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে, এবং এটিকে ভিত্তি করে অঙ্গদানের প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। অন্যদিকে, ইসলামিক দৃষ্টিকোণে মস্তিষ্কের মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু আলেম আধুনিক চিকিৎসাগত সংজ্ঞা গ্রহণ করেন, তবে অন্যরা রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হওয়ার লক্ষণকে মৃত্যুর চূড়ান্ত নির্দেশক মনে করেন। তারা বলেন, মস্তিষ্কের মৃত্যু হতে পারে কিন্তু আত্মা তখনও দেহে থাকতে পারে।
উপসংহার:
যদিও কুরআন বা হাদিসে সরাসরি কোনো আয়াত বা হাদিস নেই যা স্পষ্টভাবে অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে অনুমোদন বা নিষিদ্ধ করে, তবে আধুনিক উলামা এবং ইসলামিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলে এর অনুমোদন দিয়েছেন। উভয় মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন গুরুত্বপূর্ণ। তবে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে প্রমাণগুলো সমর্থন করে যে ইসলামিক নৈতিক নীতিমালা মেনে চলা সাপেক্ষে অঙ্গ প্রতিস্থাপন অনুমোদনযোগ্য হতে পারে। অঙ্গদান এবং প্রতিস্থাপন ইসলামী ও সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি জটিল ও বহুমুখী বিষয়। যেখানে সেক্যুলার নৈতিকতা ব্যক্তি স্বাধীনতা, সমাজকল্যাণ এবং জনকল্যাণকে প্রাধান্য দেয়, সেখানে ইসলামিক নীতি মানবদেহের পবিত্রতা এবং জীবন সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। ইসলামী আলেমদের মধ্যে মতভেদের বৈচিত্র্য চলমান সংলাপ এবং ধর্মীয় নীতিমালা মেনে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে প্রতিফলিত করে।
উভয় দৃষ্টিকোণেই অবহিত সম্মতি, নৈতিক দায়িত্ব এবং মানবতার প্রতি করুণার অনুভূতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং জটিল বিষয়, যা ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক দায়িত্ব এবং আইনি কাঠামোর সংমিশ্রণ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, মৃত্যুর সংজ্ঞা পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর সঙ্গে অঙ্গদানের প্রক্রিয়া এবং এর নৈতিকতা নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। তাই, উভয় ধর্মীয় এবং সেক্যুলার কাঠামোর জন্য এটির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো অপরিহার্য হবে, যাতে নৈতিক, ধর্মীয় এবং আইনি মানদণ্ড পূরণ হয় এবং অঙ্গদান প্রক্রিয়ার মর্যাদা ও সততা বজায় থাকে।
ইসলামী এবং সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রবন্ধে উপস্থাপিত বিশ্লেষণ এবং বিতর্কগুলো থেকে বোঝা যায়, অঙ্গদান প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা একটি চলমান আলোচনা এবং বিভিন্ন মতের সমন্বয় প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে, অঙ্গদানের মাধ্যমে অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব, তবে এই বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত নৈতিক, ধর্মীয় এবং আইনি প্রশ্নগুলোর সঠিক সমাধান এবং সমন্বয় করার জন্য ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের এবং চিকিৎসকদের একত্রিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন।