ইন্টারনেটের যুগে ইসলাম শেখার ভয়াবহতা ও মুক্তির পথ
আজ থেকে মাত্র কয়েক দশক আগের কথা চিন্তা করুন, যখন ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে মানুষকে স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যেতে হতো, মাদ্রাসার শিক্ষকের শরণাপন্ন হতে হতো, কিংবা ঘরে বসে পুরনো পান্ডুলিপি বা বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে হতো। তখন জ্ঞানের উৎস ছিল সীমিত, তবে নির্ভরযোগ্যতার মাপকাঠি ছিল স্পষ্ট। তবে আজ ইন্টারনেটের এই যুগে সেই চিত্রটাই সম্পূর্ণ বদলে গেছে। একটি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগই এখন এক বিশাল লাইব্রেরি, এক অনন্ত শিক্ষাক্ষেত্র। কিন্তু এই সহজলভ্যতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর সংকট, যেইটা আমরা জেনেও অজানার ভান করি। যখন যার ইচ্ছা, যে কেউ ইসলাম নিয়ে কথা বলতে পারে, লিখতে পারে এবং ভিডিও তৈরি করতে পারে, এমনকি ফতওয়া জারি করতে পারে। এই অবস্থাই সত্য-মিথ্যা ও সঠিক-ভুল আলাদা করা সাধারণ মানুষের পক্ষে কতটা সম্ভব? এটি আজকের সময়ের একটি বড় প্রশ্ন বলে আমার মনে হয় ।
ইন্টারনেট আমাদের জন্য কত বড় নেয়ামত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন বাঙ্গালি ছেলে এখন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত প্রফেসরের লেকচার সরাসরি শুনতে পারে। একজন সাধারণ শিক্ষার্থীও শাইখ হামযা ইয়ুসুফ, মিযানুর রাহমান আযহারি কিংবা ড. জাকির নায়েকের বক্তব্য বাংলা সাবটাইটেল সহ উপভোগ করতে পারে। বিভিন্ন ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠানের শত শত গুরুত্বপূর্ণ বই এখন অনলাইনে পিডিএফ আকারে উন্মুক্ত এবং সহজেই উপলব্ধ। এই দিকটি বিবেচনায় নিলে বলা যায়, জ্ঞানার্জনের এই সুযোগ মানব ইতিহাসে এর আগে কখনো ছিল না। এটি আল্লাহর একটি মহান নিয়ামত, যা আমরা অনেকেই সঠিকভাবে মূল্যায়ন করি না।
কিন্তু এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে। ইন্টারনেট হলো একটি মুক্ত মঞ্চ, যেখানে জ্ঞানী-মূর্খ, সৎ-দুশ্চরিত্র সবাইকে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং তারা নিজ নিজ ক্ষমতা ও কলা দেখাতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, খুব আকর্ষণীয় উপস্থাপনা আর জোরালো বাক্যের মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় শেখানো হচ্ছে, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। কিছু স্ব-শিক্ষিত ব্যক্তি, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষার পটভূমি খুবই দুর্বল, তারা নিজেদের ‘ইসলামী বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তারা কুরআনের আয়াত ও হাদীসের এমন সব ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। এতে করে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। তারা ভাবে, হয়তো এত বছর তারা যা জেনে এসেছে, তা সবই ভুল, আর এই নতুন বক্তাই তাদেরকে ‘আসল ইসলাম’ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এই বিভ্রান্তি একটি খুব বিপজ্জনক চিহ্ন। এবং এর রূপ ও উদাহরণ আমাদের সমাজে অনেক।
তাই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কীভাবে চিনবো কে সঠিক আলেম আর কে নয়? আজকের যুগে বিচক্ষণতা অর্জন করা সত্যিই একটি মহান কর্তব্য। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় আমাদের জন্য ইঙ্গিত স্বরূপ কাজ করতে পারে। প্রথমত, দেখতে হবে বক্তার শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড এবং যোগ্যতা কী। তিনি কি দীর্ঘদিন কোন স্বীকৃত ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসার উচ্চতর স্তর, কিংবা আল-আজহার এর মতো বা বিশ্বস্ত বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে ইসলামিক ধার্মিক ধর্মীয় শিক্ষার একটি দৃঢ় ও মজবুত ভিত্তি দেয়, যা তাকে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান থেকে রক্ষা করে। তিনি শুধু কুরআন-হাদীসেরই বই পড়েননি, বরং তার পিছনে তাফসিরের নিয়ম, ফিকহের জটিলতা এবং ইজতিহাদের পদ্ধতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন। বিশেষ ভাবে সে একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ লাভ করে।
দ্বিতীয়ত, একজন প্রকৃত আলেমের মধ্যে বিনয় ও নম্রতা প্রকট থাকে। তিনি কখনই নিজেকে ‘একমাত্র সঠিক ব্যক্তি’ হিসেবে দাবি করেন না। অন্য আলেমদেরকে, যাদের মতামত তার থেকে ভিন্ন, তাদেরকে তিনি কাফের, মুশরিক বা গোমরাহ বলার বদলে, তাদের মতামতকে সম্মান করেন এবং বিদ্বৎসমাজের মতভেদ কে উম্মতের জন্য রহমত হিসেবে দেখেন। ফিরকাবন্দি নিয়ে মাতামাতি করেন না। নিজেকে সর্বদা সঠিক এবং অন্যকে সর্বদা ভুল বলার প্রবণতা রাখেন না। তিনি মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পরিবর্তে, তাদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। তার বক্তব্যের লক্ষ্য হয় মানুষকে সত্যের দিকে ডাকা, না নিজের ভক্তদের দল তৈরি করা।
তৃতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘সনদ’ বা জ্ঞান শৃঙ্খল-এর গুরুত্ব। পরম্পরাগত ইসলামী শিক্ষায়, একজন শিক্ষক তার শিক্ষক থেকে, তিনি তার শিক্ষক থেকে... এভাবে একটি ধারাবাহিক শৃঙ্খল-এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) পর্যন্ত জ্ঞান পৌঁছে। এই সনদ জ্ঞানের অসংশ্লিষ্টতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করে। ইন্টারনেটের থেকে শিক্ষিত বক্তা এই সনদ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তারা সরাসরি বই না পড়ে বা ভিডিও দেখে জ্ঞান অর্জন করেন, তারপর সেই জ্ঞান জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এটি একটি অত্যন্ত নাজুক পদ্ধতি, কারণ এই প্রক্রিয়ায় সামান্য ভুল বা ভুলবোঝাবুঝিও খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে।
ইন্টারনেটের আরেকটি বড় সমস্যা হলো তথাকথিত ‘ইনস্ট্যান্ট স্কলার’ সিন্ড্রোম — অর্থাৎ, অল্প কিছু ভিডিও দেখা বা কয়েকটি প্রবন্ধ পড়েই কেউ নিজেকে কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মনে করে ফেলে। এতে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের গভীরতা হারিয়ে যায়, আর ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ খুব দ্রুত, খুব অল্প সময়ে ইসলামের গভীর জ্ঞান লাভ করতে চায়। তারা জটিল ফিকহী মাসায়িল এর উপর একঘণ্টার ভিডিও দেখেই বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতে চায়। কিন্তু ইসলামী জ্ঞান সবসময়ই একটি বিশাল মহাসাগর — যার গভীরে প্রবেশ করতে হলে বছরের পর বছর সাধনা, অধ্যবসায় ও গভীর অধ্যয়নের প্রয়োজন। হযরত আলী (রা.) বলেছেন, “জ্ঞান হলো বিন্দু বিন্দু সঞ্চয়ের ফল।” তাই, TikTok-এর একটি ছোট ভিডিও বা Facebook-এর কোনো স্ট্যাটাস কখনোই ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের বিকল্প হতে পারে না।
তাহলে সমাধান কী? ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণ বর্জন করা নয়, বরং একে একটি শক্তিশালী শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে হতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা অ্যাপ্রোচটি হওয়া উচিত ভারসাম্যপূর্ণ। আমরা ইন্টারনেটকে প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের একটি উপকারী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারি — অর্থাৎ, এটি থেকে প্রাথমিক ধারণা ও অনুপ্রেরণা নেওয়া যেতে পারে। তবে গভীর ও নির্ভুল ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য অবশ্যই প্রথাগত পদ্ধতি, যোগ্য আলেমদের সান্নিধ্য, এবং নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ অধ্যয়ন অপরিহার্য। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের তৈরি কনটেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তাকফির, জিহাদ, খিলাফত, ব্যাংকিং বা ইনশুরেন্সের মতো জটিল ও বিতর্কিত বিষয়ে পৌঁছালে অত্যন্ত সতর্ক থাকা জরুরি। এসময় স্থানীয়, যোগ্য ও বিনয়ী আলেমের পরামর্শ নেওয়া এবং তাঁর দিকনির্দেশনাকেই চূড়ান্ত হিসেবে মানা উচিত।
মনে রাখতে হবে, ইসলাম আমাদেরকে ‘বুদ্ধি’ নামক নেয়ামতটি দিয়েছে যুক্তি-বিচার-বিবেকের জন্য। কুরআন বারবার মানুষকে চিন্তা-ভাবনা করতে, যুক্তি দিয়ে বিচার করতে বলেছে। তাই, ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্যকেই আমরা অন্ধভাবে গ্রহণ করব না। আমরা তার উৎস খতিয়ে দেখব, বক্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করব, দেখব সে প্রতিষ্ঠিত আলেমদের দ্বারা গৃহীত কিনা, এবং যাচাই করা উচিত তা কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।
শেষে বলা যায়, ইন্টারনেট আল্লাহ তায়ালার দেওয়া একটি অসাধারণ উপহার।কিন্তু এটি একটি দ্বিধাধারী তলোয়ার—অর্থাৎ এর সুবিধা যেমন আছে, তেমনই বিপদও আছে। । এর সঠিক ব্যবহার আমাদেরকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে পারে, আবার এর ভুল ব্যবহার আমাদেরকে গভীর অন্ধকার ও বিভ্রান্তির দিকেও নিয়ে যেতে পারে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই মাধ্যমটিকে সতর্কতা ও দূরদর্শিতার সাথে কাজে লাগানো। আমাদের লক্ষ্য শুধু তথ্য সংগ্রহ করা নয়, বরং প্রকৃত ইলম অর্জন করা, যা আল্লাহর নিকট নিয়ে যাবে, আমাদের চরিত্র উন্নত করবে এবং একজন সৎ মুসলিম হিসেবে গড়বে। ইন্টারনেট কেবল সেই লক্ষ্য অর্জনের একটি মাধ্যম মাত্র , চূড়ান্ত নয় —এই সত্য আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে।