ডিজিটাল দাওয়াহ: ইসলামী বার্তা প্রচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা
ইসলামে দাওয়াহ বা আল্লাহর পথে আহ্বান একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ কাজ, যার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সৎ পথে ডাকা এবং ইসলামি জীবনাদর্শ সম্পর্কে অবহিত করা। কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে এমন একদল থাকা উচিত, যারা সৎ কাজের আদেশ দেয়, অসৎ কাজে নিষেধ করে এবং আল্লাহর পথে আহ্বান করে” (সূরা আলে ইমরান, ১০৪)। ইতিহাসে দেখা যায়, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈগণ ভ্রমণ, চিঠিপত্র ও মুখোমুখি সাক্ষাৎ-এর মাধ্যমে দাওয়াহ কার্য পরিচালনা করেছেন। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির বিকাশ, বিশেষ করে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক—বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। এই মিডিয়া এখন শুধুমাত্র বিনোদন কিংবা যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং তা ইসলাম প্রচারের এক নতুন ও শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। এই পটভূমিতে "ডিজিটাল দাওয়াহ" একটি যুগোপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
ডিজিটাল দাওয়াহর ধারণা ও ইসলামী ভিত্তি
আযান ও আহ্বানের মাধ্যমে ধর্মীয় বার্তা প্রচারকে ইসলামে দাওয়াহ(دعوة) বলা হয়। কুরআনে ‘দাওয়াহ’ শব্দের অর্থ মানবজাতিকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করা হিসেবে উল্লেখ হয়েছে; ইসলামী প্রসঙ্গে এর অর্থ হল মানুষকে মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদতে আহ্বান করা, অর্থাৎ শুধু আল্লাহরই ইবাদত করা, তাঁর পথে চলা এবং সকল ধরনের মন্দ ও অবিশ্বাস থেকে বিরত থাকা। ইসলামে দাওয়াহকে মহান কর্তব্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে”। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা আমার পক্ষ হতে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও”। এছাড়াও কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, **“বলুন: ‘এটা আমার পথ; আমি সুস্পষ্ট বোধের সঙ্গে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও (আহ্বান করে); আর আল্লাহ পবিত্র, আমি কোনোভাবেই মুশরিকদের মধ্যে নই’”**। এই আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে পরিস্ফুট যে, ইসলামী বার্তা বিশ্বের মানুষজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের দ্বায়িত্ব।
ডিজিটাল দাওয়াহ বলতে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ইসলাম প্রচারকে বোঝায়। যেমন পত্র-পুস্তিকা, প্রচার সভা ও রেডিও–টেলিভিশনের পরবর্তীতে আজকের যুগে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি জনপ্রিয় মাধ্যম ইসলামী শিক্ষণ-প্রচারের কাজে লাগছে। ইসলামি চিন্তাবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী, আমাদের যুগে প্রতিটি আধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করেই ইসলামী বার্তা প্রচার করা উচিত। কারণ সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে পৃথিবীর শত কোটি মানুষের দোরগোড়ায় ইসলামের অমূল্য বাণী পৌঁছে দেয়া সম্ভবপর হয়। নতুন প্রযুক্তি ও সামাজিক নেটওয়ার্ক আল্লাহর এক বিরাট নি’মাত; তাই এই নি’মাতকে ইসলামের দাওয়াহের কাজে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ যুগের সকল প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করেছেন, ফলে আমাদেরও অনুসারী হিসেবে সময়ের প্রচার মাধ্যম যথাযথভাবে কাজে লাগানোর দাবি রয়েছে।
উপরিউক্ত নীতির আলোকে ডিজিটাল দাওয়াহের প্রাথমিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কুরআন–সুন্নাহর নির্দেশনা এবং ইসলামী বিধান। ইসলামে দাওয়াহকে শুধু ব্যক্তিগত দ্বায়িত্ব নয়, বরং সমগ্র উম্মতের কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন কুরআনুল কারীমের আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি জানি যে তোমরা মৃত্যুর সম্মুখীন হবে যেমনটি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া…” (সূরা আ‘নকাবূতঃ ৫৭), যা থেকে বোঝা যায় প্রতিটি যুগের মুসলমানের হৃদয়ে ইসলামী বার্তা প্রচারের প্রচেষ্টা চিরকাল চালিয়ে যেতে হবে। এই শাস্ত্রীয় নির্দেশনাগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞানের উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে ইসলামী আদর্শ বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করাই আমাদের কর্তব্য।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামী দাওয়াহের প্রভাব
সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমের উত্থান যোগাযোগের ধরনকে বৈপ্লবিক করে তুলেছে এবং ইসলামী শিক্ষণ-বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য অভূতপূর্ব সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখন সামাজিক মিডিয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, টিকটক ইত্যাদির মাধ্যমে মুহূর্তে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সীমারেখা ছাড়িয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৬% মানুষ বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারী। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশজুড়ে আনুমানিক ৬৩.৯৫ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিল, যার অধিকাংশ ১৮–২৪ বছর বয়সী তরুণ। ফেসবুকের পাশাপাশি অন্যান্য প্ল্যাটফর্মও ব্যাপক জনপ্রিয়; বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, পণ্ডিত ও ভিডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিতে সক্রিয়। এই পরিসরে তরুণ প্রজন্মকে নানারকম ইসলামিক বিষয় যেমন নামাজ, কোরআনের তাফসীর, নেক কাজের আদর্শ ইত্যাদি নিয়ে দ্রুত আলাপচারিতায় জড়াতে সুবিধে হয়।
সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে ইসলামি বার্তা দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অনলাইনে সংক্ষিপ্ত ইসলামিক বক্তৃতা বা ভিডিও পোস্ট করলে তা অল্প সময়েই লক্ষাধিক মানুষ দেখতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সফল ডিজিটাল দাওয়াহ কৌশল হিসেবে স্বচ্ছতা ও আন্তঃক্রিয়াশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। এতে দর্শকের সঙ্গে সরাসরি ও বন্ধুভাবাপন্ন আলাপ-আলোচনা সহজ হয়। এছাড়া পরিপ্রেক্ষিত বিষয় গ্রহণ ও বর্তমান সমস্যা-সমাধান আলোচনাও প্রভাব বাড়ায়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং, সংক্ষিপ্ত ভিডিও বিন্যাস এবং নিয়মিত পোস্টিং দাওয়াহ কার্যক্রমকে গতিশীল করে। এগুলো ব্যবহার করলে সাম্প্রতিক ইস্যু বা ঘটনা ভিত্তিক ইসলামিক মূল্যবোধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
অনলাইন দাওয়াহে অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগও দেখা গেছে। আধুনিক ডিজিটাল যুগে মুসলিম বিশ্বের এক নতুন প্রজন্মের ইসলামি চিন্তাবিদ ও আলেম উঠে এসেছেন, যাঁরা শুধু প্রথাগত ইসলামি জ্ঞানে দক্ষ নন, বরং সমসাময়িক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ ও প্রয়োজনকেও গভীরভাবে অনুধাবন করেন। এই আলেমদের মধ্যে অন্যতম হলেন শাইখ ড. ওমর সুলেইমান, যিনি তার বক্তব্য, গবেষণা ও অনলাইন উপস্থিতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে অনুপ্রাণিত করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইয়াকীন ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক রিসার্চ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। এ প্রতিষ্ঠানটি মুসলমানদের ঈমান সম্পর্কে যেকোনো সন্দেহ দূর করে গভীর আত্মবিশ্বাস ও চিন্তাশীলতা গড়ে তোলার কাজ করে থাকে। ইউটিউব, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে তাঁর ধারাবাহিক বক্তৃতা, যেমন “Angels in Your Presence” এবং রমজানের প্রতিরাতের তাফসির মানুষের মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছে। তাঁর পাশাপাশি এমন আরও অনেক প্রভাবশালী আলেম আছেন, যেমন মুফতি মেন্ক, ড. ইয়াসির কাদি, নোমান আলী খান এবং উস্তাধা ইয়াসমিন মুগাহেদ, যাঁরা ইসলামি শিক্ষা ও চেতনা ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মাঝে।
মুফতি মেন্ক তার হাস্যরসপূর্ণ অথচ গভীর জীবনমুখী ইসলামি আলোচনার মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করেন, ইয়াসির কাদি ইসলামের ইতিহাস ও বিশ্বাসগত বিষয়গুলো একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন, এবং নোমান আলী খান কুরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক বিশ্লেষণ করে শ্রোতাদের মনে গভীর উপলব্ধি সৃষ্টি করেন। উস্তাধা ইয়াসমিন মুগাহেদ একজন বিশেষ আলোচক, যিনি ইসলামি আত্মিকতা, মনস্তত্ত্ব ও ব্যক্তিগত চেতনার মিশ্রণে বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। এঁরা সবাই প্রথাগত জ্ঞানের সাথে আধুনিক প্রেক্ষাপটের সেতুবন্ধন ঘটিয়ে ইসলামকে সময়োপযোগী ও জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছেন। তাঁরা কেবল ধর্মীয় আলোচনা করেন না; বরং ইসলামভীতি, মানসিক স্বাস্থ্য, পরিচয় সংকট, নারী-পুরুষের ভূমিকা ও রাজনৈতিক অবিচারের মতো বিষয়েও খোলামেলা আলোচনা করে থাকেন। ইংরেজি ভাষায় সাবলীল এবং পাশ্চাত্যসহ বৈশ্বিক মুসলমানদের জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকার কারণে তাঁরা এই প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। ইউটিউব ভিডিও, শর্টস, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, অনলাইন লেকচার, পডকাস্ট এবং ওয়েবিনারের মাধ্যমে তাঁরা মসজিদের গণ্ডি পেরিয়ে কোটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন।
শুধু প্রচার নয়, তাঁরা মানবসেবা, গবেষণা, আন্তঃধর্ম সংলাপ ও কমিউনিটি বিল্ডিং-এর কাজেও জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, শাইখ ওমর সুলেইমান যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে কণ্ঠ দেন। এইভাবে তাঁরা ইসলামি শিক্ষার বাস্তব রূপ তুলে ধরেন—এমন একটি ইসলাম যা কেবল বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের পাশে থাকা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সেবার মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই আলেমগণ ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরছেন—যা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দৃঢ়, আত্মিকভাবে প্রশান্তিদায়ক এবং সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁদের প্রচেষ্টা আজকের প্রজন্মকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ, আত্মবিশ্বাসী ও ঈমানদার মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলছে। তাই বলা যায়, তাঁরা আধুনিক যুগে নববী দায়িত্ব পালনের একটি সফল রূপ।
বাংলাদেশের প্রতিবেশনায়ও ডিজিটাল দাওয়াহের উন্নতি লক্ষণীয়। ইসলামী অনলাইন মিডিয়া যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ইসলামিক টিভি এবং বিভিন্ন ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজিক প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়। বিপুল সংখ্যক অনুসারীর মধ্যে স্বতন্ত্র ইসলামিক ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ পরিচালনা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামিক ছাত্র-শিবিরের নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন, “সোশ্যাল মিডিয়া হোক দাওয়াত ও সত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম”। এসব প্রচেষ্টায় তরুণ সমাজের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান ও মূল্যবোধ সঞ্চার পাচ্ছে। এক কথায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইসলামী বার্তার প্রচারে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে বার্তাপ্রাপ্তির পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সঠিক কৌশলে এই ধরনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইসলামিক মূল্যবোধ প্রচারে সফল হওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক মাধ্যম ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকার কারণে যেকোন সময় যেকোন প্রান্ত থেকে মানুষ সহজেই ইসলামের শিক্ষার সংস্পর্শে আসতে পারে। এর ফলে ধর্মবিষয়ক জ্ঞানের প্রসার ঘটছে এবং পর্দায় আবৃত্তি, সেমিনার, ওয়েবিনার ইত্যাদির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন দর্শক দলে ইসলামি বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ডিজিটাল দাওয়াহে সুযোগ যতটা আছে, ততটা কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সামাজিক মাধ্যম একদিকে সুবিধার সাথে বার্তা ছড়ায়, অন্যদিকে এর অপব্যবহারও হতে পারে। একদিকে যেমন সঠিক ইসলামী জ্ঞান দ্রুত ছড়াতে পারে, অন্যদিকে অনভিজ্ঞ কেউ মাঝে মাঝে অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে অন্যকে বিভ্রান্ত করতে পারে। অনলাইনে হাদিস এবং কুরআনিক উদ্ধৃতি সহ অনেক বিভ্রান্তিকর বা গুজব মূলক বিষয় প্রচারিত হতে পারে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি যুবসমাজকে নৈতিক কাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে তিনবারের বেশি সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে; হতাশা ৭% এবং উদ্বেগজনিত সমস্যা ২০% বাড়ে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানো বাস্তবজীবনের সম্পর্ক ও ibadah পরিত্যাগে অবদান রাখতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে ডিজিটাল দাওয়াহ পরিচালনার সময় সামাজিক মাধ্যমে ইসলামের নৈতিকতা ও নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। দাওয়াহ পরিচালনা জ্ঞান ও প্রামাণিকতার উপর ভিত্তি করে হতে হবে, যাতে দর্শক বিভ্রান্ত না হন। যেমন একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে সফল প্রচারকারীর জন্য সততা, উদ্দেশ্যশুদ্ধি এবং সূর্য-রশ্মির মতো রূপক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। বিভ্রান্তিকারী পোস্ট বা উসকানিমূলক মন্তব্য এড়িয়ে চলা দরকার। তদুপরি, অনলাইন পরিমণ্ডলে বিরোধী মতও প্রচার পায়; ইসলামবিরোধী গুজব বা জঙ্গীবাদের প্রচার প্রতিহত করতে সচেতনতা জরুরি।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমের দিকে তাকালে অসংখ্য সম্ভাবনা দেখা যায়। ডিজিটাল দাওয়াহের মাধ্যমে পৃথিবীর কোন প্রান্তেই বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়। এটি সময়, খরচ ও দূরত্বের বাধা কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, করোনাকালের মতো সময়ে ধর্মীয় সমাবেশ বা জনসভা না হলেও অনলাইন ভিডিও ও লাইভ ব্রডকাস্টের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণ প্রজন্মকে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দেওয়া, আচরণগত দিক নির্দেশ ও নৈতিক আহবান সহজ হয়েছে। প্রযুক্তির বিকাশ এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (যেমন ই-হাদিস, অনলাইন তফসির) মুসলমানদের জন্য আল্লাহর বার্তা সহজলভ্য করেছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডিজিটাল দাওয়াহ প্রস্তুতিতে দৃশ্যমান গল্প এবং সংক্ষিপ্ত ভিডিওর মতো কৌশল অগ্রাধিকার পেয়েছে, কারণ এগুলো দর্শকদের আকৃষ্ট করে। সঠিক পরিকল্পনা ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা সহ ব্যবহার করলে সামাজিক মাধ্যম ইসলামের শিক্ষাকে ব্যাপক কাছে পৌঁছে দেওয়ার শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
উপসংহার
ডিজিটাল যুগে ইসলামী দাওয়াহ একটি নতুন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এক অপার সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পূর্ববর্তী আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব বা টেলিগ্রাম—এসব প্ল্যাটফর্মকে ইসলামি দাওয়াহর কাজে ব্যবহার করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের প্রতি আল্লাহর বাণী পৌঁছানো প্রতিটি মুসলমানের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। তবে এই দাওয়াহ কৌশলে সফল হতে হলে সততা, জ্ঞান ও শারঈ পরিপালন অপরিহার্য। সামাজিক মাধ্যমের অজস্র সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে বিভ্রান্তি, ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও নৈতিক অবক্ষয়ের ঝুঁকি। তাই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি, প্রামাণিক দলিল ও আদব বজায় রেখে প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করতে হবে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, যদি আমরা সত্যনিষ্ঠভাবে, কৌশলীভাবে এবং প্রযুক্তিবান্ধব চিন্তায় ইসলামী দাওয়াহ পরিচালনা করি, তাহলে ডিজিটাল মাধ্যম ইসলামের অমীয় বাণীকে সারা বিশ্বের দরবারে পোঁছানোর এক বিশাল সুযোগ হয়ে উঠবে। সেই লক্ষ্যে প্রযুক্তি হবে শুধু তথ্যের বাহন নয়, বরং হিদায়াতেরও আলো।