নবী করীম (সা.)-এর আদর্শে ফিলিস্তিনের মুক্তির পথ: একটি নৈতিক ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি
নবী করীম (সা.)-এর আদর্শে ফিলিস্তিনের সংগ্রাম :
ফিলিস্তিনের বর্তমান সংগ্রাম এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যেখানে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ আমাদের জন্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। এই সংঘাত শুধুই একটি ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব নয়; বরং এটি একটি নৈতিক, ধর্মীয় ও মানবিক সংগ্রাম, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ইসলাম কীভাবে জুলুম ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
ফিলিস্তিন: একটি ইসলামি গুরুত্ববাহী ভূমি :
ফিলিস্তিনের ইস্যু শুধুই রাজনৈতিক নয়; এটি ইসলামী ইতিহাস, তাওহীদের বার্তা এবং নবুয়তের ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ভূমিতেই অবস্থিত মসজিদে আকসা—যা মুসলিম উম্মাহর তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। কেবলমাত্র ভূখণ্ড নয়, বরং এখানে মুসলিমদের নামায, স্বাধীনতা, ও সম্মান আজ ভয়াবহ হামলার শিকার। ইসরায়েলি দখলদারিত্ব একটি উপনিবেশবাদী, বর্ণবাদী কাঠামোর ভিত্তিতে পরিচালিত, যা মুসলিমদের কেবল বসতভূমি থেকে উচ্ছেদ করছেই না, বরং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকেও পদদলিত করছে।
মক্কায় জুলুমের যুগ এবং নবী করীম (সা.)-এর প্রতিক্রিয়া :
নবী করীম (সা.)-এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল মক্কার জুলুম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তিনি ও তাঁর সাহাবীরা যে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন—ঘর থেকে বিতাড়ন, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, উপাসনার স্বাধীনতা হরণ—তা অবিকল প্রতিফলিত হচ্ছে আজকের ফিলিস্তিনে। যেমনটা আল্লাহ বলেন:
“যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে তাদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কারণ তারা অত্যাচারিত হয়েছে”। (সূরা হজ্ব, ২২:৩৯-৪০)
নবী করীম (সা.) প্রথমে মক্কার অর্থনৈতিক রুটগুলোতে চাপ সৃষ্টি করেন, সরাসরি যুদ্ধ নয় বরং পরিকল্পিত কৌশলের মাধ্যমে। তিনি বুঝিয়ে দেন, প্রতিরোধ মানেই অন্ধ যুদ্ধ নয়, বরং বিচার, কৌশল ও আত্মরক্ষার ভিত্তিতে কাজ করা।
বদরের যুদ্ধ: প্রতিরোধের প্রতীক :
বদরের যুদ্ধ ছিল একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যেখানে মুসলিমরা কেবল অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেননি, বরং কুরায়েশদের সঙ্গে অর্থনৈতিক যুদ্ধেও লিপ্ত ছিলেন। তাদের বাণিজ্য পথের উপর আঘাত হানার মধ্য দিয়ে নবী (সা.) প্রমাণ করেন যে শত্রুর শক্তি ভাঙার জন্য অর্থনৈতিক চাপও কার্যকর হতে পারে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আজকের BDS (Boycott, Divestment, Sanctions) আন্দোলনের ন্যায়নীতি ব্যাখ্যা করা যায়—যেটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের একটি শান্তিপূর্ণ পন্থা।
হুদাইবিয়ার সন্ধি: আপাত অসফলতা থেকে কৌশলগত সাফল্য :
হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রথমে তা মুসলিমদের জন্য লজ্জাকর মনে হলেও তা পরবর্তীতে ইসলামের বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। এই সন্ধির মাধ্যমে কুরায়েশদেরকে মুসলমানদের অস্তিত্ব মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এখানেও নবী করীম (সা.) আমাদের শিক্ষা দেন যে কখন কঠোর হতে হবে, কখন ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আজকের ফিলিস্তিনি আন্দোলনের জন্য এই শিক্ষাগুলো গভীর প্রাসঙ্গিকতা বহন করে।
থুমামা ইবনে উথাল ও অর্থনৈতিক চাপ :
নবী করীম (সা.)-এর সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল থুমামা ইবনে উথালের পদক্ষেপ। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মক্কার দিকে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এই ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিরোধ আজকের মুসলিম সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। যারা ভাবেন, শুধু অস্ত্রই প্রতিরোধের উপায়—তারা ভুল করেন। বর্জন, অসহযোগ, ও শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধও বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে, যদি তা ঈমান ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে হয়।
ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি অর্থহীন :
ইসলামে শান্তির মানে কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোস নয়। তাই যারা আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে শান্তির কথা বলেন, কিন্তু তা ইসরায়েলি দখল ও দমননীতি মেনে নিয়ে বলেন, তারা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিকে অপমান করছেন। আল্লাহ বলেন:
“তোমরা কেন আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না? সেই সমস্ত দুর্বল, নির্যাতিত পুরুষ, নারী এবং শিশুদের জন্য যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের এই জালিম জনপদ থেকে উদ্ধার করো...’” (সূরা নিসা, ৪:৭৫)
এই আয়াত আমাদের প্ররোচিত করে শুধু সমবেদনায় নয়, বরং একতাবদ্ধভাবে কার্যকর প্রতিরোধে অংশ নিতে।
উম্মাহর ঐক্য ও ফিলিস্তিনের প্রেরণা :
ফিলিস্তিনি মুসলিমরা যেভাবে তাদের অধিকার ও সম্মান রক্ষায় আত্মত্যাগ করছে, তা গোটা উম্মাহর জন্য এক উদাহরণ। তারা আমাদেরকে শেখায় কীভাবে দুর্দশার মাঝেও ঈমানের শক্তিতে অটল থাকা যায়। নবী করীম (সা.) বলেন:
“মুমিনগণ এক দেহের মতো। যদি তার একটি অঙ্গ কষ্ট পায়, তবে সমস্ত দেহ জেগে উঠে ও জ্বরে ভোগে।” (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদীস আমাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়—আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ালে কেবল তাদের নয়, নিজেদের ঈমানকেই রক্ষা করি।
উপসংহার: আল্লাহর সাহায্য আসে ঈমানদারদের জন্য :
ফিলিস্তিনের সংগ্রাম কেবল একটি জাতিগোষ্ঠীর সংগ্রাম নয়, এটি উম্মাহর সংগ্রাম, এটি ঈমানদারদের ন্যায়ের পথে সংগ্রাম। নবী করীম (সা.)-এর আদর্শ আমাদের শেখায় কীভাবে কৌশল, ধৈর্য, অর্থনৈতিক চাপ ও একতাবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়। আল্লাহ বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ধরো, ধৈর্যে প্রতিযোগিতা করো, সীমান্তে অবিচল থেকো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হও।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:২০০)
আজ ফিলিস্তিনের জন্য আমাদের দোয়া যেমন দরকার, তেমনি দরকার কার্যকর পদক্ষেপ—বর্জন, জনমত গঠন, ঐক্য ও আলোচনার মাধ্যমে জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ। নবী করীম (সা.) আমাদের যে পথ দেখিয়েছেন, সেটিই আজও সত্য, ন্যায় এবং মুক্তির পথ।