মুসলিম জাতির অধঃপতনের কারণ ও তার উত্তরণের উপায়

আজ সারা বিশ্বে মুসলিমরা পদদলিত, অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিপিড়িত। মুসলিম জাতি যেন আজ অবক্ষয় ও অধঃপতনের পথে। কিন্তু কেন আজ ইসলামের এই দুর্বাস্থা ? যে ধর্ম পুরো বিশ্বে আলো, ন্যায় ও শান্তির পথ দেখিয়েছে এবং সহিংসতা, অন্যায় ও বিশৃঙ্খলাকে পুরোপুরিই বাধা দিয়েছে। যার জেরেই ইসলাম ধর্ম সারা পৃথিবীতে দ্রুততম ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বর্তমানেও পৃথীবির কোনোয় কোনায় পৌছে গিয়েছে। এমনকি এই ধর্ম আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় অবলম্বনকারী ধর্ম হিসেবে গন্য করা হয়। অথচ সেই ধর্মই আজ অবক্ষয়ের পথে। কিন্তু এই অধঃপতনের কারণ কী এবং উত্তরনের উপায় বা কী ও কোথায় ?

প্রথমতই, এই অধঃপতনের মূখ্য কারণটি হল নিজেদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অবক্ষয় এবং অনৈক্যের উত্থাপন ও উদয়। নিজেদের মাঝেই একেপরের সহিত দ্বন্দ বাদানুবাদ ও অকল্পনীয় বিরোধিতায় লিপ্ত হওয়া। এমনকি মনে হয় যেন আজ এক মুসলিম অন্য এক মুসলিমের রক্ত পিপাসু ও মৃত্যুর প্রত্যাশী হয়ে উঠেছে যা ভাবতেই একেবারে অবাক লাগে। কিন্তু কোন কারণে এই অনৈক্যর আবির্ভাব? বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গদের মতে এর মূখ্য কারণ হল ফিরকাবাজি। সুন্নি, শিয়া, বেরেলী, ওয়াহাবী, দেওবন্দি, আহলে হাদিস না জানি আর কতই না মাযহাব ও ফিরকার উদিত হয়েছে আজ। কিন্তু আদৌ কী এটিই মূল কারণ? না, প্রকৃতপক্ষে এতেও কোনো সমস্যা নেই বরং মূল বিষয়টি হচ্ছে একেপরের প্রতি হিংসা, বিভেদ, বিদ্বেষে লেগে পড়া। এটিই হচ্ছে সকল সমস্যার মূল। বর্তমানে অসংখ্য সুন্নি মুসলিম হিন্দুদের হোটেলে খাবার খেতে পারে অথচ সেই মুসলিমই অন্য এক ওয়াহাবী মুসলিমের ঘরে খাবার খেতে পারেনা। এমনই ভাবে সর্বক্ষেত্রে মুসলিমরা একেপরের সাথে দ্বন্দ, বাদানুবাদে প্রবিত্ত রয়েছে। যার কারণেই হয় তো বিজ্ঞানী জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন: "Islam is the best religion but Muslims are the worst followers"  অর্থাৎ: ইসলাম হল সর্ব শ্রেষ্ঠ ধর্ম কিন্তু মুসলিমরা হল নিকৃষ্ট অনুসরণকারী।

কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কী এবং উত্তরণের পথই বা কোথায়? এই সমস্যার সমাধান একটিই তা হল একতা ও ভাতৃত্ববোধ। আর এই এক্যকে গড়ে তুলতে সকল মুসলিমকে ইসলামের মূল কেন্দ্রকে আকড়ে ধরতে হবে অর্থাৎ কুরআন ও হাদিসকে আকড়ে ধরতে হবে। বিশেষ করে ইসলামের যে মূল ভিত্তিগুলি সেগুলিকে আগলে ধরতে হবে। 

আজ কোনো এক সুন্নি মুসলিম দাবি করে থাকে যে, আমি নবীর জন্য নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন করে দেব কিন্তু নবীর অবমাননাকারীদের মেনে নেব না। কিন্তু মসজিদে গেলে দেখা যায় খুব অল্পসংখ্যক মুসল্লি নামাজ আদায় করছে। মসজিদে আর সেই সব নবী প্রেমিকদের দেখা যায় না। সামর্থবান হওয়া সত্বেও হজ পালন করে না। সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করে না। এছাড়াও যে নানাবিধ ইসলামের মূল ভিত্তিগুলি সেগুলি থেকে সর্বদা তারা দূরে পলায়ন করে থাকে। অথচ সেই সব লোকেরাই নাকি কোনো এক ওহাবির নবী যে নুরের সৃষ্টি তা না বিশ্বাস করায় তার প্রতি উঠে পড়ে লেগে যায়।  

তার মানে কিন্তু আমি এটি বলতে চায় না যে, মূল ভিত্তিগুলি ব্যতীত বাকি সমগ্র জিনিসগুলি ত্যাগ করে দিতে হবে। বরং আমি এটিই বলব, তারা তাদের নিজস্ব মাযহাবের উপরেই অটল থাকুক। যেহেতু আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়, এই মাযহাব ও ফিরকাবাজি কোনোদিনই মিটানো সম্ভব নয় যেমনকি রসূল (সাঃ)ও হাদিসে বলে গিয়েছেন যে তিনার উম্মত ৭৩ ভাগে বিভক্ত হবে ঠিক যেমন বানি ঈসরাইলরাও বিভক্ত হয়েছিল এবং এটি বাস্তবেই যে হবেই হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু সকল মুসলিমের যেহেতু মূল ভিত্তিই হল আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই ও মুহম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল। তাই এই ভিত্তিটিকে যদি তারা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে তাগিত ও গুরুত্ব দেয় তবে এটিই হবে পূনর্ত্থানের উত্তরণের একমাত্র পন্থা। তবেই তারা পূণরায় মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে গর্বের সহিত এই ভূপৃষ্ঠে সহাবস্থান করতে পারবে। যেহেতু পৃথিবীর সমগ্র মুসলিম যে মাযহাব বা ফিরকারই অনুসরণকারীই হোক না কেন এই মূল ভিত্তিতে কিন্তু সবাই মুত্তাফিক বা ঐক্যবদ্ধ। তাছাড়া যদি আমরা মনোনিবেশ করি, তবে দৃষ্টিগোচর হবে যে, এই ভূপৃষ্ঠে এক লাখ চব্বিশ হাজার নবী ও রসূলগন আগমন করেছিলেন কেবল একটিই লক্ষ্য উদ্দ্যেশ্য নিয়ে যেটি হল আল্লহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই তার তাবলিগ করা। এছাড়াও ইসলামের শত্রুরা কিন্তু বিশেষ করে কোনো এক ফিরকা বা মাযহাবের প্রতি শত্রুতা করে না বরং তারা এই দুনিয়া থেকে ইসলাম ধর্মকে মিটিয়ে দিতে চায় অথচ যে ধর্মই আল্লহর নিকট গ্রহনযোগ্য। সুতরাং, মুসলিমদেরও এটি মাথার ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়া উচিত, তাদেরও একই ছাতার ছায়াতলে একত্রিত হতে হবে। যেহেতু ইসলাম বিরোধীরা মুসলিমদের এক ধর্ম বা এক উম্মত হিসেবেই দেখে এবং সেই অনুযায়ীই তারা তাদের কুকর্ম ও চক্রান্ত অব্যাহত রাখছে।

এছাড়াও বর্তমানের মুসলিমরা যেহেতু নবীকে নিয়েই বেশি দ্বন্দে ব্যাতিব্যাস্ত থাকে, সেহেতু তার সমাধানের উপায় হল মুসলিমদের কেবল রসূল ‘কে’ নয় বরং রসূল ‘এর’ মানতে হবে। অর্থাৎ, কেবল রসূলুল্লাহকে ভালোবাসলেই হবে না বরং তিনাকে ভালোবাসার সাথে সাথে তিনি যে সমস্ত কর্মগুলি করতে আদেশ দিয়েছেন সেগুলি অক্ষরে অক্ষরে মান্য ও পালন করতে হবে এবং যেগুলি হইতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবেই সমস্ত প্রকার দ্বন্দ মিটে যাবে ও নিজেকে এক খাঁটি মুসলিম বলেও দাবি করা যাবে। আর এমনটি যদি প্রত্যেক মুসলিম পালন করতে থাকে তবেই সেটিই হবে ইসলামের পূণর্জাগন ও উত্তরণের পথ। 

উপরের সমস্ত কিছুই কিন্তু পার্থিব দিক দিয়ে সমাধান করলাম কিন্তু এই প্রসঙ্গে কুরআন এবং হাদিশও বিভিন্ন জায়গায় তুলে ধরা হয়েছে যা আমি পূর্বেই অন্য এক নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। যেমনকি কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঐক্য বা একতার সর্ম্পকে তার বান্দাদের সজাগ করতে গিয়ে সূরা আল ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন:
واعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرقوا অর্থাৎ- তোমরা সকলে মিলে খোদার রজ্জুকে শক্ত করে ধারণ করো এবং দলাদলিতে পরিও না। এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্মানিত দীন তথা ইসলাম অবলম্বনকারীদের সংবদ্ধ হয়ে থাকতে আদেশ দিয়েছেন এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ বিচ্ছেদ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। কারণ যদি একটি সমাজ নিজেদের মধ্যে বিভেদ বিচ্ছেদে লিপ্ত হয়ে থাকে তাহলে, সেই সমাজের শক্তি হারিয়ে যায়। তারা কোনো দিনই সফল হতে পারবে না। তাই তো এই প্রসঙ্গে এক বিখ্যাত দার্শনিক বলেছেন যে:  "Where there is unity there is always victory"  এককথায়, একাত্মতাই শক্তি। অতএব, যদি মুসলিম সমাজ সম্মিলিতভাবে শুধুমাত্র ইসলামের জন্য নিজেকে অতিবাহিত করে তবে একদিন অবশ্যই মুসলিমরা পূনরায় উচ্চ শিখরে পৌছাবে। এছাড়াও হাদিশে বলা হয়ে যে প্রত্যেক মুসলিম একেপরের ভাই ভাই। তাই সমগ্র মুসলিমদের উচিত যে, নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বীজ রোপন করা। 

তাছাড়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য একটি হাদিসে বলেছেন যে-  تركتُ فيكم أمرين، لن تضلُّوا ما تمسكتم بهما: كِتاب الله، وسُنَّة نبيِّه  অর্থাৎ- আমি তোমাদের মধ্যে এমন দুটি জিনিস রেখে গেছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সেই দুটি কে আঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না সেই দুটি জিনিস হল আল্লাহর গ্রন্থ কুরআন এবং নবীর সুন্নত।

সর্বশেষে মোদ্দাকথায় বলা যায়, বর্তমানে লাঞ্চিত বঞ্চিত মুসলিম জাতিকে অধঃপতন থেকে উত্তরণের পথে নিয়ে আসতে হলে মুসলিমদের ঐক্য, ভাতৃত্ব ও সৌহার্দকে বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করতে হবে। কুরআন, হাদিস ও রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ঈমানী শক্তি বাড়াতে হবে এবং জিঞ্জিরের ন্যায় হাতে হাত রেখে এক হয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। তবেই মুসলমানের পূনর্ত্থান, নবজাগরণ ও উত্তরণ হবে এবং মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারবে ও গর্বের সহিত সারা পৃথিবীতে তারা সম্মানিত হয়ে পূণরায় পরিচয় দিবে।  

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter