ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম নারীদের ভূমিকা: একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যেমন বিপ্লবী পুরুষদের অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে সেই সব নারীর অবদান, যারা জাতির মুক্তির লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন। মুসলিম নারীরা এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ধর্মীয় বিধিনিষেধ, পারিবারিক সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত মুসলিম নারীরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ধাপে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। কেউ কেউ সরাসরি মঞ্চে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেমন—বেগম রোকেয়া (১৮৮০–১৯৩২), যিনি কেবল নারীশিক্ষার জন্য নয়, সমাজচেতনা জাগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আবার আবদুল গফ্ফার খানের মা ও স্ত্রী কিংবা আবুল কালাম আজাদের মা—তাঁরা আন্দোলনের পর্দার অন্তরালে থেকে সৈনিকদের আশ্রয়, রসদ, অনুপ্রেরণা ও রক্ষণাবেক্ষণে অবদান রাখেন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বিয়াম্মা (আবদুল্লাহ সাওরার মা) তাঁর দুই সন্তানকে জেল ও নির্বাসনের পথে ঠেলে দিয়েও স্বাধীনতার স্বপ্নে অটল ছিলেন। তাঁর ভাষণ ‘জেলে যাও, শহীদ হও!’ স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের মাঝে বিপুল প্রেরণা যুগিয়েছিল।
এই প্রবন্ধে আমরা সেইসব মুসলিম নারীর অবদানের একটি ঐতিহাসিক ও বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা উপস্থাপন করবো, যাঁরা জাতীয়তাবাদের আলো জ্বালাতে একটুও পিছপা হননি।
বিখ্যাত মুসলিম নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু সাহসী নারীর নাম উঠে এসেছে, কিন্তু মুসলিম নারীদের অবদান তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত। অথচ তাদের মধ্যেও কেউ ছিলেন সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, কেউ ছিলেন রাজনীতির মঞ্চে বক্তৃতাদানকারী, আবার কেউ ছিলেন আদর্শপ্রেরণার উৎস। নিচে চারজন উল্লেখযোগ্য মুসলিম নারী সংগ্রামীর কথা বলা হলো, যারা সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার পথে ইতিহাস গড়েছেন।
১. বেগম হজরত মহল (১৮২০–১৮৭৯)
লখনউয়ের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের স্ত্রী বেগম হজরত মহল ছিলেন ভারতের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম নারী যিনি সামরিকভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় নবাব নির্বাসিত হলে হজরত মহল আওধের প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা নিজ হাতে তুলে নেন। তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে লখনউ পুনরুদ্ধার করেন এবং স্থানীয় সৈন্য ও প্রজাদের নিয়ে এক দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
তিনি শুধু সামরিক দিকেই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও সচেতন ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠেন—হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে এক যৌথ স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর শাসনকাল যদিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবুও তাঁর সাহসিকতা, নেতৃত্ব ও দৃঢ়তা ব্রিটিশদের আতঙ্কিত করে তোলে। পরাজয়ের পর তিনি নেপালে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন এবং ১৮৭৯ সালে কাঠমাণ্ডুতে মৃত্যু বরণ করেন।
বিশেষত্ব: ভারতের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম নারী যিনি সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন।
২. আজিজান বাই (১৮৩০-এর দশক – ১৮৫৮)
আজিজান বাই ছিলেন কানপুরের মুসলিম নারী যোদ্ধা, যিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে নানাসাহেব বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি একজন দক্ষ তলোয়ারধারী ও ঘোড়সওয়ারা ছিলেন এবং তার দলকে নিয়ে সরাসরি ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। আজিজান বাই শুধু লড়াই করতেন না, বরং সেনা শিবিরে অন্যান্য নারীদেরও সংগঠিত করতেন, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতেন এবং নারীদের উৎসাহিত করতেন পুরুষের পাশাপাশি সংগ্রামে অংশ নিতে।
ব্রিটিশ বাহিনী বিদ্রোহ দমন করলে আজিজান বাইকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর জীবন আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব ও সংগ্রামের এক উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
বিশেষত্ব: প্রথম মুসলিম নারী ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা যিনি বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
৩. আবাদি বানো বেগম (বিয় আম্মান) (১৮৫০–১৯২৪)
বিয় আম্মান নামে পরিচিত আবাদি বানো বেগম ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী রাজনৈতিক বক্তা। তিনি খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দুই সন্তান—মাওলানা মোহাম্মদ আলি ও মাওলানা শওকত আলি—ভারতের মুসলিম রাজনীতির অগ্রদূত ছিলেন, আর তাদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও সাহসের মূল প্রেরণা ছিলেন এই মা।
পর্দার আড়াল থেকেও তিনি দিল্লি, লাহোর, কলকাতাসহ বহু শহরে রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দেন। তিনি মুসলিম নারীদের ঘরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান, যা সেই সময়ের জন্য ছিল অত্যন্ত বিপ্লবী চিন্তা।
বিশেষত্ব: উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী রাজনৈতিক বক্তা ও নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত।
৪. অরুণা আসাফ আলী (১৯০৯–১৯৯৬)
অরুণা আসাফ আলীর জন্ম হরিয়ানার এক বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে হলেও মুসলিম নেতা আসাফ আলীকে বিয়ে করে তিনি মুসলিম সমাজে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪২ সালের 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন'-এ তিনি অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনি বোম্বে গভর্নমেন্ট হাউসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন—যা ছিল এক প্রতীকী বিপ্লব। এরপর তিনি আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যান এবং বহু জায়গায় ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর তাঁকে ‘Grand Old Lady of the Indian Independence Movement’ উপাধিতে সম্মানিত করা হয়। তিনি ছিলেন আদর্শ, নেতৃত্ব ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক।
বিশেষত্ব: মুসলিম পরিচয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন প্রধান নারী মুখ।
মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণের প্রধান আন্দোলনসমূহ
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মুসলিম নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যদিও তাঁদের ভূমিকা দীর্ঘদিন অবমূল্যায়িত ছিল। তারা কখনও প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়েছেন, কখনও বা ছায়ার আড়াল থেকে আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। নিচে তিনটি প্রধান জাতীয় আন্দোলনে মুসলিম নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিবরণ দেওয়া হলো:
খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯–১৯২৪)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তুরস্কে খেলাফতের বিলুপ্তি মুসলিম বিশ্বজুড়ে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভারতেও খিলাফত আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, যাতে মুসলিম নারীদের ব্যতিক্রমী অংশগ্রহণ দেখা যায়। আবাদি বানো বেগম (বিয় আম্মা) ছিলেন এই আন্দোলনের অন্যতম নারী মুখ। নারীরা অলঙ্কার দান করেন, খিলাফত তহবিল গঠনে সাহায্য করেন, এবং সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে খিলাফত ও ব্রিটিশবিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দেন। নারীদের এই অংশগ্রহণ মুসলিম সমাজে নারী রাজনৈতিক চেতনার নবযুগ সূচিত করে।
অসহযোগ আন্দোলন( Non- Cooperation Movement) (১৯২০–১৯২২)
মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে মুসলিম নারীরাও গৃহবন্দিত্ব ভেঙে রাজপথে নেমে আসেন। তাঁরা ব্রিটিশ পণ্য বর্জন, স্বদেশি বস্ত্র ব্যবহার এবং ব্রিটিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনের মতো কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বিআম্মা, সাহিবা খাতুনসহ অনেকে বিভিন্ন সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে নারীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন। এই সময় নারী নেতৃত্বে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট পরিবর্তন ঘটে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)
যদিও এই সময়ে মুসলিম সমাজে নারীদের প্রকাশ্য অংশগ্রহণ কম ছিল, তবুও তাঁরা নীরব নায়িকা হিসেবে বিপ্লবীদের গোপনে সাহায্য করেন। অনেকেই গুপ্তচর, বার্তাবাহক ও আশ্রয়দাতা হিসেবে বিপ্লবীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করেন। কেউ কেউ আত্মগোপনে থেকেই ব্রিটিশবিরোধী প্রচার চালিয়ে যান। অরুণা আসাফ আলী এই সময়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে নারীদের প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন।