মোহম্মদ (ﷺ)-ই হলেন একজন প্রথম প্রকৃত নারীবাদী

কয়েকদিন পূর্বে প্রকাশিত নিবন্ধে ইসলাম ও নারীবাদ প্রসঙ্গে সবিশেষ বৃতান্ত দেওয়া হলেও এই নিবন্ধে একই বিষয়ের উপরে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তবে বিশেষ করে নারীবাদ ও মোহম্মদ ()এর প্রসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু এই শিরোনামটি বর্তমানে অত্যন্ত পর্যালোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। পূর্বের ন্যায় এই নিবন্ধটিকেও সম্পূর্ণ করতে লেখক বিভিন্ন গ্রহনযোগ্য গ্রন্থপঞ্জী ব্যবহার করেছেন।

ইসলামে নারী ও পুরুষ কখনোই এক হতে পারে না। আর এটিই বাস্তবেও চিরসত্য ও গ্রহনযোগ্য। যেহেতু দুটো লিঙ্গের দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্র আলাদা। দুটো মানুষের শারীরিক গঠন প্রকৃতি, শারীরিক শক্তি, ধরন ধারন, বুদ্ধিমত্তা আলাদা। তাহলে এই দুটি লিঙ্গের সমতা সর্বক্ষেত্রে একই হবে কী কারণে বা কোন হিসেবে? অথচ ইসলাম কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তাদের বঞ্চিত করেনি বরং তাদের মাঝে Equity-এর দ্বারা সমতাকে (Equality) প্রদান করেছে। অর্থাৎ, ইসলামে যদি কোনো ক্ষেত্রে তাদের অধিকার কম প্রদান করেছে তো আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরুপ, তারা ঋতুস্রাবের সময় নামাজ থেকে অব্যাহতি পান অথচ নামায ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি স্তম্ভ ও সবার উপর অহর্নিশি সর্বক্ষেত্রে ফরজ। এছাড়াও আল্লাহর পথে লড়াই করার প্রতিদানের জন্য পুরুষদের শারীরিক, আর্থিক, সামাজিকভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয় কিন্তু একজন নারী হজ্জ করেই জিহাদের সওয়াব অতি সহজেই অর্জন করে নিতে পারে। এমনি করেই ইসলাম দুই লিঙ্গের মাঝে সমতার এক সমন্বয় গড়ে তুলেছে। কিন্তু এই বিষয়টি ইসলাম বিরোধীরা বুঝেও অদ্য ইসলামকে এই অপবাদে নানাভাবে কটাক্ষ করে থাকে।

কিন্তু যদি এই বিষয়টি অন্য ধর্মের সহিত তুলনা করা হয় তবে সিদ্ধান্তে এটি বলা যায় যে, মোহম্মদ ()-ই হল ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত নারীবাদী। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, কনফুসীয়বাদ, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মসহ সকল মহান ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে মুহাম্মদ ছিলেন নারীদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মৌলিক ও ক্ষমতায়নকারী। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন ইতিহাসের প্রথম নারীবাদী। 

অন্যান্য ধর্মগুলির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে, কনফুসিয়াস খুব কমই মহিলাদের উল্লেখ করেছিলেন এবং তাঁর সমস্ত শিক্ষায় ধরে নিয়েছিলেন যে তারা পুরুষদের অধীনস্থ একটি পিতৃতান্ত্রিক শৃঙ্খলার মধ্যে। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন যে মহিলারা আলোকিত হতে পারে তবে মহিলাদের সন্ন্যাসিনী হওয়ার অনুমতি দেওয়ার আগে তিনবার চাপ দিতে হয়ে ছিল, এবং তারপরে কেবল এই শর্তে, যেমন তিনি বলেছিলেন, সর্বোচ্চ সন্ন্যাসিনী সর্বনিম্ন সন্ন্যাসীর চেয়ে কম হবে। সুসমাচারের বিবরণগুলোতে যীশু নারীদের অবস্থা সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে মন্তব্য করেননি, যদিও তিনি অখ্যাত মহিলাদের ও অইহুদি মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। মূসা পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক ছিলেন এবং তাওরাতে কার্যত এমন কিছুই নেই যা নারী অধিকার সম্পর্কে নির্দিষ্ট উদ্বেগকে নির্দেশ করে। মুহাম্মদ ছিলেন মৌলিকভাবে ভিন্ন। তিনি উভয়ই স্পষ্টভাবে সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতার মৌলিক নীতি হিসাবে নারী ও পুরুষের মৌলিক সমতা শিখিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর নিজের জীবদ্দশায় আরবে নারীদের অবস্থান ও ভূমিকাকে গভীরভাবে উন্নত করার জন্য অসংখ্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। 

মুহাম্মদ () নারীদের দুর্দশার প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন কারণ তিনি খুব অল্প বয়সেই দরিদ্র ও এতিম হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তিনিও ছিলেন নিরক্ষর। দারিদ্র্য ও সামাজিক বর্জনের অর্থ কী তা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। কনফুসিয়াস প্রাচীন চীনের ভদ্রলোক পণ্ডিত শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধদেব নেপালের এক ধনী রাজপুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। যিশু প্যালেস্টাইনের রাজকীয় বংশ এবং শক্তভাবে আবদ্ধ ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন ছুতোরের পুত্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করে ছিলেন। মূসা একটি হিব্রু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিশরের ফেরাউনের প্রাসাদে বেড়ে ওঠেন। মুহাম্মদের () এসব সুবিধার কোনোটিই ছিল না। এভাবে অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা যখন নারী নির্যাতনের ব্যাপারে অদ্ভুতভাবে নীরব ছিলেন, তখন মুহাম্মদ প্রকাশ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় নীতির বিষয় হিসেবে নারীর মর্যাদা তুলে ধরেন। নিম্নলিখিতগুলি বিবেচনা করুন:

ইসলাম পূর্ব যুগে নারী ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, লাঞ্চিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং অধিকার হারা জাতি। সে সময় নারীকে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বাজারের পণ্য হিসাবে গণ্য করা হতো সেই সময়ে নারীদেরকে মানুষ হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হতো না এবং তাদের কোন সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এমনকি মানব জাতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও ছিল না। তাদের প্রতি খুবই কঠোর আচরণ করা হতো। সে যুগে নারীদেরকে মনে করা হত দাসী এবং ভারবাহী পশু হিসাবে। যাদেরকে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। সে আমলে স্বামী যত খুশি স্ত্রী গ্রহণ করত এবং ইচ্ছা করলে তার স্ত্রীকে অপরের কাছে বিক্রি করে দিতে পারত কিংবা স্ত্রীকে দিয়েই কেউ ঋণ পরিশোধ করত। আবার কেউ উপহার হিসাবে কাউকে এমনিই দিয়ে দিত। তারা কন্যা সন্তান জন্মকে লজ্জাজনক মনে করে স্বীয় নিষ্পাপ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠিত হ’ত না। তাদের এমন বিবেক বর্জিত কর্ম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا الْمَوْؤُوْدَةُ سُئِلَتْ، بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ، ‘আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল’? (তাকভীর ৮-৯)। কিন্তু নবীজি আগমনের পর এই সকল কুসংস্কারকে সমাজ থেকে দূরীভূত করে এক সুষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। 

উদাহরণস্বরূপ তিনি যে বহুবিবাহ করেছিলেন সেই দিকে একটি ধ্যান দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, নবী নারীদের কীভাবে ক্ষমতায়ন করেছিলেন। প্রথমত তিনি বিবি খাদিজাকে বিবাহ করেন যিনি ছিলেন একজন বিধবা। তিনার সহিত দীর্ঘ ২৩ বছর এক দম্পত্তি হয়েই জীবন  অতিবাহিত করেছিলেন। পরিশেষে যখন তিনি মারা যান তৎপর তিনি বহুবিবাহ করেন যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল বিধবা। এছাড়াও লক্ষণীয় বিষয় হল যে, তিনি আল্লহর হুকুমকে সামনে রেখেই সকলকেই তাদের যা অধিকার তা সমান ও সম্পূর্ণরূপে প্রদান করেছিলেন । যার দ্বারা তিনি সমাজকে এমন এক অকল্পনীয় শিক্ষা দেয় যা নারীদের মর্যদাকে কখনোই খর্ব করেনা বরং ক্ষমতায়ন করেন। এমনকি তিনার এই শিক্ষার অনুসারে বর্তমানে একই সময়ে একজন পুরুষ চারজন নারীকে বিবাহ করতে পারে কিন্তু তারপূর্ব শর্ত হল তাদের চারজনের মাঝেই সমতা প্রতিষ্ঠিত করা নতুবা না। তাছাড়াও তিনি একটি হাদিশে বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমি হচ্ছি আমার স্ত্রীর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ। (তিরমিজা ৩৮৯৫)

এমনি করে তিনি নারীদের ক্ষমতায়ণ করতে গিয়ে অসংখ্য হাদিসের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন যে, ইসলামে নারী যখন মা তখন সন্তানের জন্য জান্নাত, মেয়ে হলে বাবার জন্যও জান্নাত এবং স্ত্রী হলে স্বামীর জন্য অর্ধেক-দ্বীন পূরণের সহধর্মিনী। মৌলিকতার দিক দিয়ে তিনি নারী পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখেনি। অর্থনৈতিক মর্যদা, ধর্মীয় মর্যদা, ব্যক্তিগত সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার, স্বামী নির্বাচন, বিবাহবিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ, মোহর, ভরন-পোষণ, সদাচরন, জীবনে নিরাপত্তা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা ও নাগরিক অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করেছেন ও নারীদের ক্ষমতায়ণ করেছেন।

সুতরাং, নারীদের সহিত সৎ আচরন ও ক্ষমতায়ণ, মর্যদা ও অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে অনান্য ধর্মপ্রচারকদের থেকে মোহম্মদ () ছিলেন একেবারেই ভিন্ন, অন্যতম ও অতুলনীয়। তিনি যে নারীদের চৌদ্দশো বৎসর পূর্বেই হরণকৃত অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ও বর্তমানের জন্য যে সুপন্থা বলে গিয়েছিলেন তা সত্যই আজ প্রশংসনীয় ও বরণীয়। একমাত্র তিনার এই শিক্ষাতেই রয়েছে বর্তমানের নারীদের পূণরায় ক্ষমতায়ণের উপায়। অতএব, তিনাকেই অনুসরণ করা সকলের একান্ত প্রয়োজন।

 









Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter