ইদানীং আমরা কেন হুতিদের খবরের শিরোনামে দেখতে পাচ্ছি?
হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইয়েমেনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের মূল লক্ষ্য ইয়েমেন সরকারকে পতন করা এবং নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশটির উত্তরাঞ্চলে একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
হুথি বিদ্রোহের উদ্ভব ও ইতিহাস
হুথি গোষ্ঠীর উত্থান ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয়েছিল। মূলত এটি ইয়েমেনের সা'দাহ প্রদেশে শিয়া জাইদি গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল, তবে তা ধীরে ধীরে একটি সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। হুথিরা সৌদি আরব এবং ইয়েমেনের সরকারকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে। ২০১৪ সালে তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানায় দখল নেয় এবং পরবর্তী সময়ে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর হাদিকে গদি ছাড়তে বাধ্য করে।
হুথি গোষ্ঠীর কার্যক্রম:
গত কয়েক বছরে হুথি বিদ্রোহীরা সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা ড্রোন হামলা এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে আঘাত হেনেছে। ড্রোন হামলার এই ইতিহাস প্রায় এক দশক ধরে চলে আসছে। সম্প্রতি তারা লোহিত সাগরে জাহাজ আক্রমণ করেছে, যা আন্তর্জাতিক শিপিং নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
হুথিদের কার্যক্রমের ফলে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, যার কারণে ইয়েমেন বর্তমানে একটি বিধ্বস্ত দেশে পরিণত হয়েছে। এ সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, এবং লাখ লাখ মানুষ মানবিক সংকটে পতিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু হুথি গোষ্ঠীর শক্তি এবং তাদের সামরিক ক্ষমতা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
হুথি গোষ্ঠীর ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
হুথি বিদ্রোহীরা জাইদি শিয়া মতবাদের অনুসারী, যা ইসলামের শিয়া ধারার একটি শাখা। ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকায় এই মতবাদের অনুগামীদের সংখ্যা বেশি। তারা মূলত নিজেদের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে এটি একটি সামরিক প্রতিরোধে পরিণত হয়, বিশেষ করে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে, যাকে তারা তাদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শত্রু বলে মনে করে।
সামরিক কৌশল এবং ড্রোন হামলা
হুথিরা সামরিক কৌশলে বিশেষ করে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে বেশ দক্ষ। তারা বেশ কয়েক বছর ধরে ড্রোনের মাধ্যমে সৌদি আরবের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যেমন তেলক্ষেত্র এবং সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন তাদের সামরিক শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। ড্রোন হামলা এবং সাগরপথে আক্রমণ কৌশলগতভাবে তারা দক্ষ, যা আন্তর্জাতিক শিপিং রুটগুলিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
ইয়েমেনের মানবিক সংকট
হুথিদের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সংঘাত ইয়েমেনে একটি বিশাল মানবিক সংকট তৈরি করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। খাদ্য এবং চিকিৎসা সরবরাহের অভাবে ইয়েমেনের জনগণের অবস্থা ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো ইয়েমেনে কাজ করছে, কিন্তু সংঘাতের তীব্রতা এবং হুথি গোষ্ঠীর প্রতিরোধের কারণে এই সহায়তা প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি এবং হুথিদের ভবিষ্যৎ
হুথি বিদ্রোহীদের সামরিক সাফল্য মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যকার আঞ্চলিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হুথিদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। ইরান হুথিদের সামরিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যা এই সংঘাতকে আরও জটিল করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালালেও হুথি গোষ্ঠীর আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তির কারণে এই প্রক্রিয়া এখনও সফল হয়নি।
হুথি বিদ্রোহীদের সমসাময়িক কার্যক্রম এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গেলে কয়েকটি বিশেষ দিক তুলে ধরতে হবে। নিচে বিস্তারিতভাবে হুথি গোষ্ঠীর বর্তমান কার্যক্রম এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
হুথি বিদ্রোহীরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠেছে। তারা বিশেষত সৌদি আরবের তেল স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের বৃহত্তম তেল স্থাপনা আরামকোতে তাদের ড্রোন হামলা ছিল বিশ্বব্যাপী আলোচিত একটি ঘটনা, যা আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। হুথিদের এই ড্রোন হামলা প্রায় এক দশকের ইতিহাস বহন করছে, এবং তারা ক্রমাগত তাদের সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
২. লোহিত সাগরের শিপিং আক্রমণ
হুথিরা লোহিত সাগরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা সামুদ্রিক জাহাজ আক্রমণ এবং জলদস্যুতা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়েছে। এসব আক্রমণ বিশ্বব্যাপী শিপিং রুটগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুথিদের এই আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং ইয়েমেনের ভূখণ্ডে তাদের সামরিক শক্তির প্রভাব বাড়ানো।
৩. সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ
হুথি বিদ্রোহীদের প্রধান প্রতিপক্ষ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। সৌদি আরব ইয়েমেনের বৈধ সরকারকে সমর্থন করে আসছে, এবং হুথিদের সামরিক কার্যক্রম থামাতে ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে সরাসরি সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। সৌদি আরবের সাথে হুথিদের সংঘর্ষে ইয়েমেনে মানবিক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়েছে।
৪. আন্তর্জাতিক সংলাপ ও শান্তি প্রচেষ্টা
ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি, বিশেষ করে জাতিসংঘ, বহুবার সংলাপের আয়োজন করেছে। তবে হুথি বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সামরিক শক্তি এই প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলেছে। তারা বারবার অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করেছে এবং শান্তি আলোচনাকে ব্যাহত করেছে। অন্যদিকে, ইরানের মতো শক্তি হুথিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যা এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।
৫. ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও হুথিদের প্রভাব
ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হুথিরা বর্তমানে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত। তারা শুধু সামরিক শক্তি নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করেছে। ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলে হুথিরা একটি কার্যকর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেখানে তাদের আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। তারা শিয়া মতবাদের অনুসারী হলেও, রাজনৈতিকভাবে তারা ইয়েমেনের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে চায়।