যারা কুরবানি দিতে পারেন না: একটি ইসলামী ও সামাজিক বিশ্লেষণ

কুরবানি মুসলিম সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিধান। এটি ঈদুল আজহার মূল আচার এবং ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের স্মরণে পালন করা হয়। কুরবানি শুধুমাত্র একটি পশু জবাইয়ের নাম নয়; বরং এটি আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং সমাজে সহানুভূতির প্রসারে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা আর্থিক বা শারীরিক কারণে কুরবানি দিতে অপারগ, তাদের অবস্থান কী? এই প্রবন্ধে আমরা কুরবানির গুরুত্ব, উদ্দেশ্য, ইসলামী বিধান, আর্থসামাজিক দিক, এবং সমাধানমূলক পরামর্শ আলোচনা করব। ঈদুল আজহার এই সময়টাতে কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে মানুষ তাদের সবচেয়ে প্রিয় পোশাকটি গরীব ও অভাবী মানুষের জন্য কুরবানী করছেন। এই চর্চা আমাদের কুরআনের একটি গভীর আয়াতের কথা মনে করিয়ে দেয়— "لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّىٰ تُنْفِقُوا مِمّا تُحِبُّونَ" — “তোমরা কখনোই পূর্ণ ধার্মিকতা (বরর) লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা সেই জিনিস ব্যয় করো যা তোমাদের সবচেয়ে প্রিয়।” (সূরা আলে ইমরান: ৯২)।

এই আয়াত কেবল অর্থ ব্যয়ের কথা বলে না, বরং আত্মা ও হৃদয়ের সংযুক্তি থাকা জিনিসের কুরবানীর কথা বলে—চাই তা প্রিয় পোশাক হোক, প্রিয় বস্তু হোক কিংবা সময় ও ভালোবাসা হোক। ঈদের আসল চেতনা শুধু পশু কুরবানীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ভাগ করে নেওয়া এবং অন্তরের ভেতরকার অহংকারকে বিসর্জন দেওয়াই এর মূল শিক্ষা। ভাইরাল ভিডিওগুলো যদি আন্তরিকতার প্রতিফলন হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে আমাদের সমাজকে সহানুভূতির পথে এগিয়ে নিতে পারে। কারণ ঈদ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন উৎসবের আনন্দ শুধু ধনীদের ভেতর সীমাবদ্ধ না থেকে অভাবীদের ঘরেও পৌঁছে যায়।

আসুন আমরা কুরআনের এই মহান আহ্বানকে অন্তরে ধারণ করি—নিজের প্রিয় কিছু বিসর্জন দিয়ে, অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে সচেষ্ট হই। তবেই ঈদের আত্মা সত্যিকারের অর্থে জীবিত থাকবে।

কুরবানির ইসলামী ভিত্তি:

  • মহান আল্লাহ বলেন:

"لَنۡ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنۡ یَّنَالُهُ التَّقۡوٰی مِنۡكُمۡ ؕ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُوا اللّٰهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمۡ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

“তাদের মাংস এবং রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না; বরং তোমাদের তাকওয়া তাঁর নিকট পৌঁছে।”
— (সূরা হজ, ২২:৩৭)

এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে কুরবানির আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর প্রতি খালিস নিয়ত ও তাকওয়া। অর্থাৎ, কুরবানি মূলত আত্মিক ও নৈতিক একটি কাজ, যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগই মুখ্য।

  • রাসূলুল্লাহ বলেন:

"مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا"

“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকট না আসে।”
— (ইবন মাজাহ, হাদীস: ৩১২৩)

এই হাদীস প্রমাণ করে কুরবানি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ যা আর্থিকভাবে সক্ষম ব্যক্তির জন্য ওয়াজিবের পর্যায়ে পড়ে।

কুরবানির বিধান এবং আর্থিক অক্ষমতা:

কুরবানি ইসলামী শরীয়তে ওয়াজিব বিধান যেটি প্রাপ্তবয়স্ক, মুকিম এবং নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী মুসলমানের উপর আবশ্যক। নিসাবের মান অনুযায়ী যদি কারো কাছে অতিরিক্ত ৫২.৫ তোলা রুপা বা তার সমমূল্যের সম্পদ থাকে, তবে তার জন্য কুরবানি আবশ্যক।

তবে যারা নিসাবের মালিক নন, অথবা ঋণে জর্জরিত, অথবা আর্থিক সংকটে আছেন, তাদের জন্য কুরবানি আবশ্যক নয়। তারা শরীয়তের বিধান অনুযায়ী দায়মুক্ত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয় কিছু ত্যাগ করা ইসলামী আত্মশুদ্ধির একটি চর্চা। কুরবানি তার প্রতীক। কুরবানির মাংস বিতরণ করে সমাজের দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের মাঝে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়ানো হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ শিখে কিভাবে নিজেকে আল্লাহর জন্য বিলীন করতে হয়।

যারা কুরবানি দিতে পারেন না, তাদের করণীয়:

ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সামর্থ্য না থাকলে আল্লাহর কাছে নিয়তের গুরুত্ব বেশি। হাদীসে এসেছে: “যদি কোনো বান্দা খালিস নিয়তে কোনো নেক কাজ করার ইচ্ছা করে কিন্তু করতে না পারে, তাহলে আল্লাহ তা পূর্ণ কাজ হিসেবে লিখে দেন”(বুখারী, মুসলিম)। যারা কুরবানি করতে পারছেন না, তারা এই আমলগুলোতে মনোনিবেশ করতে পারেন: আরাফার দিন রোজা রাখা – যেটি এক বছরের পাপ মোচন করে (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২)। ঈদের নামাজ আদায় করা, তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা, সাদাকা করা: সামান্য হলেও দান করার মাধ্যমে অংশগ্রহণ অনুভব করা যায়। যদি নিজের একটি পশু কেনা সম্ভব না হয়, তবে গরুর ৭ ভাগের একটি অংশ ক্রয় করে কুরবানি করা যায়। অনেক মুসলমান যৌথভাবে এভাবে কুরবানি দিয়ে থাকেন। ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের খোঁজ নেওয়া, উপহার দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ঈদের প্রকৃত আনন্দ ভাগ করে নেওয়া যায়।

অনেক মানুষ আজ অভাব-অনটনে ভুগছে, যেখানে প্রতিদিনের খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানই দুর্লভ। তাদের জন্য কুরবানির পশু কেনা বাস্তবিক অর্থেই অসম্ভব। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য শরীয়ত কুরবানির বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। বরং এমন পরিস্থিতিতে নিজের আর্থিক ভারসাম্য গঠনে মনোযোগী হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। বর্তমানে পশু জবাই ও মাংস উৎপাদনের ফলে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন, পানি দূষণ, মাটি দুষণ ইত্যাদি পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাই বিজ্ঞানসম্মত ও সুশৃঙ্খল কুরবানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি। যারা কুরবানি দিতে পারেন না, তাদের দোষারোপ না করে সহানুভূতির মনোভাব গড়ে তোলাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।

ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন: “কুরবানি আল্লাহর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ। কিন্তু যদি মনোজগত থেকে সেই ভালবাসা অনুপস্থিত থাকে, তবে কুরবানি শুধুই এক নিষ্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতা”। অনেক মসজিদ, এনজিও ও চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান যৌথ কুরবানির আয়োজন করে থাকে, যেখানে স্বল্পমূল্যে অংশগ্রহণ সম্ভব। বর্তমানে অনেক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য কিস্তিতে বা গ্রুপ ভিত্তিতে কুরবানির ব্যবস্থা করে। ঈদে সামাজিক সেবা, প্রতিবেশী সহায়তা, দরিদ্র শিশুদের উপহার প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে ঈদ উদযাপনকে নতুন অর্থ দেওয়া যায়।

শেষকথা

কুরবানি শুধুমাত্র পশু জবাইয়ের নাম নয়, এটি আত্মিক ত্যাগ, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, সামাজিক সহমর্মিতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। যারা কুরবানি দিতে পারেন না, তারা ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন গুনাহগার নন যদি তাদের সদিচ্ছা থাকে। বরং বিকল্প উপায়ে ইবাদত, দান-সদকা এবং ভালো কাজের মাধ্যমে তারা ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্যে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো – আল্লাহ আমাদের অন্তরের তাকওয়া দেখেন, বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়।

অতএব, কুরবানির মৌলিক চেতনা শুধুমাত্র পশু জবাইয়ে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর গভীরে রয়েছে এক অন্তর্নিহিত আত্মিক শিক্ষা—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয়তম জিনিস ত্যাগ করার মানসিকতা অর্জন। প্রকৃত কুরবানি হলো এমন আত্মত্যাগ, যা আল্লাহর পথে নিবেদিত হয়। অনেক সময় এই কুরবানি হয় নীরবে, আড়ালে—যেমন কোনো ছাত্র ঈদের আনন্দ ও পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছাকে কুরবান করে আল্লাহর দীন শিখতে প্রতিষ্ঠানে থেকে যায়; কোনো সৈনিক (জওয়ান) সীমান্তে রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে আল্লাহর বান্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, পরিবার-পরিজনের ঈদ ভুলে দায়িত্বে অটল থাকে; আবার কেউ নিজের সময়, অর্থ কিংবা প্রশান্তিকে ত্যাগ করে মুমিনদের পাশে দাঁড়ায়, দুঃখী-অভাবীদের সেবা করে। এ সকল আত্মত্যাগ—যা বাহ্যিক চোখে গরু-ছাগল জবাইয়ের মতো দৃশ্যমান নয়—আসলে ঈদুল আজহার মর্মবাণীকে আরও গভীরভাবে বাস্তবায়ন করে।

"لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّىٰ تُنْفِقُوا مِمّا تُحِبُّونَ" — কুরআনের এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আল্লাহর নৈকট্য ও সত্যিকারের তাকওয়া অর্জনের জন্য হৃদয়ের গহীন থেকে কুরবানি আবশ্যক। ঈদের দিনে যদি আমরা কেবল পশু জবাই করে আত্মতৃপ্ত হই, অথচ গরীবের খোঁজ না রাখি, আত্মীয়তার সম্পর্ক না জাগাই, কিংবা নিজের স্বার্থকে অতিক্রম না করতে পারি—তবে সেই কুরবানি শুধুই একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়াবে।

আসুন, ঈদের এই পবিত্র মুহূর্তে আমরা পশু কুরবানির পাশাপাশি অন্তরের কুরবানিও করি—অহংকার, হিংসা, স্বার্থপরতা, এবং আরামপ্রিয়তার—আর আল্লাহর পথে তাঁর বান্দাদের জন্য আত্মত্যাগ করে নিজেদের কুরবানির ময়দানে উপস্থাপন করি। এটাই হবে ঈদের প্রকৃত শোকরিয়া ও আত্মনিবেদনের প্রমাণ।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter