মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও ইসলামের আধ্যাত্মিক সমাধান দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন দূরীকরণে ইসলামিক উপায়
ভূমিকা
মানসিক রোগের সংজ্ঞা গবেষক এবং সেইসাথে পরিষেবা প্রদানকারীর জন্য মূল বিষয় যারা এই রোগ নির্ণয় করবে । মানসিক অবস্থায় একে ব্যাধি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা অনেক সময় ব্যাহত হতে পারে । বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক ক্লিনিকালের ডকুমেন্টগুলি মানসিক “ব্যাধি” শব্দটি ব্যবহার করে যদি “অসুস্থতা “ সাধারণ মানের হয় । আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে শব্দটি “মানসিক” (যেমন, মন) ব্যবহার করা মানেই মস্তিষ্ক বা দেহ থেকে বিচ্ছিন্নতা বোঝানো নয় ।
মানসিক ব্যাধি একটি মানসিক সিনড্রোম বা প্যাটার্ন যা মর্মপীড়ার সাথে সম্পর্কিত (যেমন বেদনাদায়ক উপসর্গের মাধ্যমে), অক্ষমতা (কার্যক্ষমতার এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশে দুর্বলতা), মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাওয়া । প্রিয় কোন ব্যক্তিকে হাড়ানো থেকে প্রাপ্ত দুঃখ, এবং রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অথবা সামাজিক কারণে যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে ভয়ানক আচরণ লক্ষ করা যায় তাহলে তাকে মানসিক রোগ বলা যাবেনা ।
যে চিকিৎসা বিজ্ঞানে মানসিক ব্যাধি হিসাবে যা বুঝানো হয় তার জন্য কোন কার্যোপযোগী কোন সংজ্ঞা নেই যার মাধ্যমে সমস্ত বিষয় বুঝানো যাবে । এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে মানসিক রোগের সংজ্ঞাগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে, মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও ইসলামের আধ্যাত্মিক সমাধান ।
২০১৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) । তাদের মতে মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতা এটি একটি সিনড্রোম যা একজন ব্যক্তির চেতনা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, বা আচরণ যা মানসিক, জৈবিক বা মানসিক কার্যকারিতার মধ্যে প্রতিফলিত হয় ।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও আধ্যাত্মিক সমাধান
সময়ের সাথে সাথে আধ্যাত্মিকতার অর্থ বিকশিত এবং প্রসারিত হয়েছে, এবং একে অপরের পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। ঐতিহ্যগতভাবে, আধ্যাত্মিকতা পুনর্গঠনের একটি ধর্মীয় প্রক্রিয়াকে বোঝায় যা “মানুষের আসল আকৃতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে । ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে কেন্দ্রীভূত, যেমনটি বিশ্বের ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং পবিত্র গ্রন্থগুলি দ্বারা উদাহরণিত। প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মের মধ্যে এই শব্দটি পবিত্র আত্মার দিকে মনোনিবেশিত জীবনকে বোঝাতে ব্যবহৃত হত এবং মধ্যযুগের শেষের দিকে জীবনের মানসিক দিকগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটি বিস্তৃত হয়েছিল ।
আধুনিক সময়ে, এই শব্দটি অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এটি বিস্তৃত পরিসরের অভিজ্ঞতা বোঝাতে বিস্তৃত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের রহস্যময় এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য। আধুনিক ব্যবহারগুলি সাধারণত একটি পবিত্র মাত্রার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা , এবং “মানুষের গভীরতম মূল্যবোধ এবং অর্থ”, প্রায়শই সংগঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক প্রেক্ষাপটে বোঝায় । এর মধ্যে সাধারণত পর্যবেক্ষণযোগ্য জগতের বাইরে একটি অতিপ্রাকৃত জগতে বিশ্বাস , ব্যক্তিগত বৃদ্ধি , একটি চূড়ান্ত বা পবিত্র অর্থের সন্ধান , ধর্মীয় অভিজ্ঞতা , অথবা নিজের “অভ্যন্তরীণ মাত্রা” বা আত্মার সাথে সাক্ষাৎ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে ।
আধ্যাত্মিকতার অর্থের বিকাশ
প্রাচীন রোমে, আধ্যাত্মিকতার ধারণাটি মূলত প্যাক্স ডিওরাম (দেবতাদের শান্তি) দ্বারা গঠিত ছিল; এটি এমন আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎসবের মাধ্যমে অর্জিত হত যা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ এবং মহাজাগতিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে। যদিও রোমান আধ্যাত্মিকতা ছিল সাম্প্রদায়িক, তবুও এতে পৌরাণিক কাহিনী এবং দর্শন অধ্যয়নের মাধ্যমে ঐশ্বরিকতার সাথে ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততাও জড়িত ছিল । পৌরাণিক কাহিনীগুলি নৈতিক শিক্ষার রূপক এবং ব্যক্তিগত আচরণের মডেল হিসেবে কাজ করত, যা ব্যক্তিদের দেবতাদের সাথে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিত। পিথাগোরিয়ান দর্শনের প্রভাব , বিশেষ করে গোল্ডেন ভার্সেস , আত্মদর্শন, আত্ম-শৃঙ্খলা এবং নীতিগত জীবনযাপনকে উৎসাহিত করেছিল। পৌরাণিক কাহিনী, দর্শন এবং আচার-অনুষ্ঠানের এই মিশ্রণ সামাজিক সম্প্রীতি এবং ঐশ্বরিকতার সাথে ব্যক্তিগত সংযোগ উভয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি আধ্যাত্মিকতা তৈরি করেছিল।
“আধ্যাত্মিকতা” হিসেবে অনুবাদযোগ্য শব্দগুলি প্রথম ৫ম শতাব্দীতে উদ্ভূত হতে শুরু করে এবং মধ্যযুগের শেষের দিকে এটি সাধারণ ব্যবহারে প্রবেশ করে ।বাইবেলের প্রেক্ষাপটে এই শব্দটির অর্থ ঈশ্বর দ্বারা সঞ্চারিত হওয়া। নতুন নিয়মে পবিত্র আত্মার দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ধারণাটি দেওয়া হয়েছে, যেখানে এই প্রভাবকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এমন জীবনযাপনের বিপরীতে ।
একাদশ শতাব্দীতে, “আধ্যাত্মিকতা” এর এই অর্থ পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তে, শব্দটি জীবনের মানসিক দিককে বোঝাতে শুরু করে, জীবনের বস্তুগত এবং ইন্দ্রিয়গত দিকগুলির বিপরীতে, “বস্তুর অন্ধকার জগতের বিরুদ্ধে আলোর ধর্মীয় বলয়”। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে “আধ্যাত্মিকতা” একটি সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক অর্থ অর্জন করে। সামাজিকভাবে এটি পুরোহিতদের অঞ্চলকে বোঝায় “অস্থায়ী সম্পত্তির বিরুদ্ধে ধর্মীয়, ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ধর্মীয়, ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় শ্রেণী”।মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এটি অভ্যন্তরীণ জীবনের ক্ষেত্রকে বোঝায় “উদ্দেশ্য, স্নেহ, অভিপ্রায়, অভ্যন্তরীণ স্বভাবের বিশুদ্ধতা, আধ্যাত্মিক জীবনের মনোবিজ্ঞান, অনুভূতির বিশ্লেষণ”।
উনিশ শতক এবং বিংশ শতাব্দী জুড়ে আধ্যাত্মিকতার আধুনিক ধারণাগুলি বিকশিত হয়েছিল, খ্রিস্টীয় ধারণাগুলিকে পশ্চিমা রহস্যময় ঐতিহ্য এবং এশীয়, বিশেষ করে ভারতীয় ধর্মের উপাদানগুলির সাথে মিশ্রিত করে। আধ্যাত্মিকতা ক্রমশ ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আজকাল এটি কখনও কখনও দার্শনিক, সামাজিক, বা রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন উদারনীতি, নারীবাদী ধর্মতত্ত্ব এবং সবুজ রাজনীতির সাথে যুক্ত।
বিষন্নতা রোধে ইসলামের শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক সমাধান
মানুষ যখন মানসিক চাপের সম্মুখিন হয়- তখন এক ধরনের নেতিবাচকতা তাকে পেয়ে বসে। নিজের সম্পর্কে বা নিজের দিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করে দেয়। যার ফলে আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে ওঠে, বিষন্নতা অবসাদ পেয়ে বসে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মানসিক অবস্থার কুপ্রভাব ব্যক্তি আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে সে অশালীন ও অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করে, অযথা উত্তেজিত হয়ে যায়। অতএব মানসিক চাপ কীভাবে প্রতিহত করা যায়, কী করে তা মোকাবেলা করা যায়; তা জানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্মীয় বোধ ও বিশ্বাস উত্তেজনা মোকাবেলায় মানুষকে হেফাজত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। আধুনিক চিকিৎসাবিদরা মানসিক কষ্ট বা মর্মযাতনা দূর করার জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে ব্যক্তি মনে দৃঢ়ভাবে স্থাপনের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব লোক নিয়মিতভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেয় সেসব লোকের সুস্থতার পরিমাণ যারা নিয়মিতভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেয় না তাদের তুলনায় অনেক বেশি।
এই গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রমাণ হয় যে, শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। আর ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণগুলোই প্রকৃত সুস্থতার কার্যকরী উপাদান।
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। ওই সব আলোচনার সারমর্ম হলো- যাদের অন্তর ইমানের নূরে আলোকিত, তারা সমগ্র পৃথিবীতে সুন্দর, কল্যাণ আর ভালো ছাড়া অন্য কিছুই চোখে দেখেন না। তারা বিশ্বব্যবস্থাকে সবোর্ত্তম ব্যবস্থা বলে মনে করেন। তারা মহাপ্রজ্ঞাবান সেই স্রষ্টা ও প্রতিপালক খোদার প্রার্থনা করেন যিনি এই বিশ্ব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি সুন্দর ও কল্যাণ ছাড়া তার সৃষ্টিকূলের জন্য অন্য কোনো কিছুই পছন্দ করেন না। এক্ষেত্রে যদি কোনো কিছুতে ঘাটতি থাকে কিংবা জটিলতা থাকে তাহলে সেসব অসংগতি সহনীয় এবং সমাধানের পর্যায়ে পড়ে।
সূরা বাকারার ১৫৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাসী তারা যেকোনো বিপদ আপদের সময় এই সত্য ও বাস্তবতার প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট করে বলে যে, আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।’
বলা হয়, ভয় মানসিক চাপের অন্যতম কারণ। আর ভয় কাটিয়ে ওঠার জন্য যত রকম উপায়ের কথা বলা হয়েছে, সেসবের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ভয়ের উৎপত্তি যেখান থেকে ধর্মীয় বিশ্বাস সেই উৎপত্তিস্থলটাকেই ধ্বংস করে দেয়।
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, যেসব মানুষ ইসলামি শিক্ষার ছায়াতলে লালিত পালিত হয়, পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে তারা মানসিক চাপ থেকে নিরাপদ। কারণ, শক্তির মূল যে উৎস তার সঙ্গে যে মানুষের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় পৃথিবীর অন্য কোনো শক্তি তাকে আর প্রভাবিত করতে পারে না। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে মানে শক্তির উৎসের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী মানুষ আর কোনো কিছুকেই ভয় করে না।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে এক আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে নিসন্দেহে তার কোনো ভয় বা মর্ম বেদনার কারণ নেই।’
মনে রাখবেন, আপনি একজন বিশেষ মানুষ এবং নিজের সঙ্গে সবোর্ত্তম আচরণ করার যোগ্যতা রাখেন। ধর্মীয় শিক্ষাও তাই। তাই বিপদ-আপদে আল্লাহর স্মরণ, ধৈর্যধারণ, খোদাভীতি বা তাকওয়াবান হওয়া, বিপদাপদে ভেঙে না পড়ে সুস্থির থাকা, বিষন্নতা পরিহারে জন্য সৎকাজ করা এবং অপরের কল্যাণ ও সেবায় এগিয়ে যাওয়া ইসলামের শিক্ষা। কোনো মানুষ এসব অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস দিয়ে মানসিক চাপ ও আঘাতকে সুন্দরভাবে রোধ করে দূরন্ত ঝড়ের মুখেও স্থির থাকতে পারেন।
আল্লাহতায়ালার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর উপায় হচ্ছে- দোয়া এবং নামাজ। এগুলো মানসিক অস্থিরতাকে কমিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে ব্যক্তি মনে দৃঢ় আশার সঞ্চার করে। কারণ কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘একমাত্র আল্লাহর জিকির বা স্মরণের মাধ্যমেই অন্তরগুলো প্রশান্তি পায়।’
মানসিক রোগ বা মনোরোগ (Mental disorder) একপ্রকারের ব্যবহারিক বা মানসিক দুর্দশা যা সাধারণ সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত নয়। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতি, মানসিক সুস্থতার সংজ্ঞা ও গ্রহণযোগ্যতার পরিধি পরিবর্তন করে আসছে। যদিও কিছু সাধারণ গড়মাপ সকল সমাজেই স্বীকৃত
বর্তমান ধারণা অনুযায়ী, জিন এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জটিল পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও কর্মক্ষমতার বিপর্যয় ঘটলে মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। অন্যভাষায়, মানসিক রোগের জিনতত্ত্ব ও সম্ভাব্য ফলাফল সেই ব্যক্তির জৈবিক ও পারিপার্শিক পরিকাঠামোর সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। মানসিক রোগের কারণগুলি প্রায়ই অস্পষ্ট । তত্ত্বগুলি একটি ক্ষেত্র থেকে ফলাফল অন্তর্ভুক্ত করতে পারে । মানসিক রোগ সাধারণত একজন ব্যক্তির আচরণ, মতানৈক্য, অনুভূতি বা মতানৈক্যের সমন্বয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়। এটি মস্তিষ্কের বিশেষ অঞ্চল বা ফাংশনগুলির সাথে যুক্ত হতে পারে, প্রায়ই একটি সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে তার সংযুক্তি থাকে । মানসিক ব্যাধি মানসিক স্বাস্থ্যের একটি দিক। সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সেইসাথে সামাজিক নিয়মগুলি মাথায় রেখে এই রোগ নির্ণয় করা উচিত।
সেবা মূলত মানসিক হাসপাতাল বা সম্প্রদায়কে ভিত্তি করে দেয়া হয়। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবৈজ্ঞানিক, এবং ক্লিনিকাল সামাজিক কর্মীদের দ্বারা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে মূল্যায়ন করা হয় যা প্রায়ই পর্যবেক্ষণ এবং প্রশ্নের উপর নির্ভর করে । বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের দ্বারা চিকিৎসা প্রদান করা হয় । মনোবিজ্ঞান এবং মানসিক ঔষধ দুটি প্রধান চিকিৎসা ব্যবস্থা । অন্যান্য চিকিৎসাগুলিতে সামাজিক হস্তক্ষেপ, সহকর্মী সমর্থন এবং আত্মনির্ভরতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। খুব কম ক্ষেত্রেই অনাকাঙ্ক্ষিত আটক বা চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ হতে পারে । বিষণ্ণতা কমানোর জন্য প্রতিরোধমূলক প্রোগ্রাম ব্যবহার করা যায় ।
প্রচলিত মনস্তাত্ত্বিক সংক্রমণ যেমন বিষণ্ণতা দ্বারা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন, ডিমেনশিয়া দ্বারা প্রায় ৩৫ মিলিয়ন এবং সিজোফ্রেনিয়া দ্বারা বিশ্বব্যাপী ২১ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে । পাংশু এবং বৈষম্য মানসিক রোগের সাথে সম্পর্কিত সহিংসতা ও অক্ষমতা যোগ করতে পারে, যা সামাজিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যার ফলে জানাশোনা বৃদ্ধি পাবে এবং সামাজিক বর্জনকে চ্যালেঞ্জ করবে ।
দুশ্চিন্তা হলো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়, উৎকণ্ঠা বা অস্থিরতা। এর লক্ষণগুলো হচ্ছে অজানা ভয় বা আশঙ্কায় বিচলিত হওয়া, ঘুম না আসা, সামান্য সমস্যাকে বিশাল আকারে দেখা, বুক ধড়ফড় করা, ঘাম হওয়া বা কাঁপুনি ইত্যাদি।
দুশ্চিন্তা যদি সামান্য হয়, তবে তা মানুষকে সচেতন ও কর্মতৎপর হতে সাহায্য করে; কিন্তু যখন তা অতিরিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তা রোগে পরিণত হয়, যাকে anxiety disorder বলা হয়।
আর ডিপ্রেশন হলো মানসিক অবসাদ, হতাশা ও জীবনের প্রতি আগ্রহ হারানো। এর লক্ষণগুলো হচ্ছে সব কিছুর প্রতি অনাগ্রহ, আনন্দের অভাব, অতীত নিয়ে আফসোস, ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা, ক্ষুধা ও ঘুমের ব্যাঘাত, আত্মহননের চিন্তা, নিজেকে মূল্যহীন মনে হওয়া ইত্যাদি। ডিপ্রেশন দুশ্চিন্তার তুলনায় অনেক গভীর মানসিক অসুখ, যা চিকিৎসা ছাড়া দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে।
ডিপ্রেশন আর দুশ্চিন্তার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে—দুশ্চিন্তায় ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়।
ডিপ্রেশনে বর্তমান ও অতীত নিয়ে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়। তবে অনেক সময় দুশ্চিন্তা ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আবার ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যেও প্রবল দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে।
ডিপ্রেশন ও দুশ্চিন্তার কারণ
অতিরিক্ত বস্তুবাদী জীবনধারা ও প্রতিযোগিতা, পারিবারিক অশান্তি ও সামাজিক চাপ, আর্থিক অনিশ্চয়তা, মানসিক আঘাত বা ব্যর্থতা, আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ভরসার ঘাটতি। ইসলাম মানুষকে মানসিক প্রশান্তি ও অন্তরের শান্তির পথে পরিচালিত করে। কোরআন ও হাদিসে বারবার বলা হয়েছে, আল্লাহর স্মরণে ও ভরসায় অন্তর শান্ত হয়।
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন— ‘যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর শান্ত হয়, জেনে রাখো আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রা ‘দ, আয়াত ২৮) অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোনো বিপদ আসে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া, আর যে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে, তিনি তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।’ (সুরা আত-তাগাবুন, আয়াত ১১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) দুশ্চিন্তা ও মানসিক অশান্তি দূর করার জন্য বিশেষ দোয়া শিখিয়েছেন— ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি, ওয়াল আজজি ওয়াল কাসালি, ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া দালা ‘ইদ দ্বাইনে ওয়া গালাবাতির রিজা-লি।’
অর্থ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও কাপুরুষতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষের অত্যাচার থেকে। (বুখারি, হাদিস ৫৪২৫)
তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) জীবনের সব বিষয়ই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। যখন মানুষ হৃদয়ে গভীরভাবে এ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করে যে কোনো কিছু আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ঘটে না, তখন তার মনের মধ্যে গভীর প্রশান্তি আসে। যে ব্যক্তি প্রতিটি পরিস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে, সে হতাশা ও অস্থিরতার সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তাদের জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা আত-তালাক, আয়াত ৩)
নামাজ ও দোয়া নামাজ অন্তরের প্রশান্তি ও আত্মার শান্তির অন্যতম মাধ্যম। নিয়মিত নামাজে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, চিন্তা-ভাবনাকে আল্লাহর স্মরণে কেন্দ্রীভূত করা যায়। একইভাবে দোয়া হলো অন্তরে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন, যা মানসিক চাপ কমাতে বিশেষ কার্যকর। হাদিসের ভাষ্য মতে, যে ব্যক্তি দুশ্চিন্তা ও কষ্টে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার অন্তরে আলো ঢেলে দেন। (বুখারি, হাদিস ৫৪২৫)
কোরআন তিলাওয়াত কোরআনের শব্দ ও অর্থের গভীরতা মনকে প্রশান্ত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোরআন তিলাওয়াতের ধ্বনি মানসিক চাপ কমায় এবং হৃদয়কে স্থিতিশীল রাখে। মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহর স্মরণে অন্তর শান্তি পায়।’ (সুরা রাদ, আয়াত ২৮)
সদকা ও সৎকর্ম দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সৎকর্ম ও সদকারও আলাদা ভূমিকা আছে। এটি শুধু অন্যকে উপকার করে না, বরং মানুষের অন্তরেও আনন্দ ও পরিতৃপ্তি আনে। কোরআনের ভাষ্য মতে, ‘যারা অর্থ ও সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, আল্লাহ তা বৃদ্ধি করে দেন এবং তাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।’ এতে স্পষ্ট হয় যে সদকা ও নেককর্ম মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আনে, দুশ্চিন্তা হ্রাস করে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো দুশ্চিন্তা বা বিপদে ভোগে, সে যদি আল্লাহর পথে কিছু সদকা করে, আল্লাহ তা তার জন্য লাঘব করে দেন।’ (তিরমিজি, হাদিস ৬১৬; ইবন মাজাহ, হাদিস ১৮২৫)
সদকা শুধু দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি অর্থ, সময়, ক্ষমতা বা ভালো আমলের যেকোনো কিছু প্রয়োগ করেই হতে পারে।
সুস্থ জীবনযাপন মানসিক সুস্থতার জন্য শারীরিক সুস্থতাও অপরিহার্য। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম শরীর ও মনকে শক্তিশালী করে। আল্লাহর বিধান অনুসারে সুষম জীবনযাপন মানুষকে মানসিক চাপ ও অবসাদ থেকে দূরে রাখে।
সুসম্পর্ক বজায় রাখা পরিবার, বন্ধু এবং মুমিন ভাই-বোনদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ভালো সম্পর্ক অন্তরে নিরাপত্তা ও আশ্বাসের অনুভূতি জাগিয়ে দেয়। ইসলামে পারস্পরিক সাহায্য, দোয়া এবং পরস্পরের জন্য শুভকামনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন মানুষ এমন ইতিবাচক পরিবেশে থাকে, দুশ্চিন্তা ও হতাশার প্রকোপ কমে যায়।
দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন আজকের যুগের এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। আধুনিক চিকিৎসা যেমন এর প্রতিকার দেয়, তেমনি ইসলামী শিক্ষা এর মূল ভিত্তিতে শান্তি স্থাপন করে। যে অন্তর আল্লাহর ওপর ভরসা করে, সে কখনো হতাশ হয় না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা হতাশ হয়ো না, নিরাশ হয়ো না। যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে তোমরাই শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৯) মহান আল্লার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের সবার অন্তরকে প্রশান্ত করে দেন এবং দুশ্চিন্তা ও হতাশার চক্র থেকে মুক্তি দান করেন। আমাদের মন ও হৃদয়কে তাঁরই প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী ও শান্তিময় করেন। আমিন।