ইমাম গাজ্জালীর নৈতিক দর্শন ও আজকের সংকট: আমরা কোথায় ব্যর্থ?

প্রস্তাবনা

মধ্যযুগীয় মুসলিম দার্শনিক ও সুফি ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালী (৪৫০ হিজরি/১০৫৮ খ্রিঃ – ৫০০ হিজরি/১১০২ খ্রিঃ)–কে ইসলামী ঐতিহ্যে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ (ইসলামের রক্ষক) খেতাব দিয়ে ভূষিত করা হয়। তাঁর প্রধান রচনা ইহ্যাউ উলুমুদ্দীন (ধর্মবিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন) গ্রন্থে মুসলিম সমাজের নৈতিক-আধ্যাত্মিক চেতনা ও জীবনের প্রতিটি দিক শৃঙ্খলাবদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে। গাজ্জালী এ গ্রন্থে মুসলিমদের নৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে ইসলামের নিখুঁত নৈতিক মানদণ্ড উপস্থাপন করেছেন। অথচ আজকের বিশ্বে নৈতিক অবক্ষয় ও আত্মিক শূন্যতা সাধারণ দৃষ্টিতে প্রকট। আমাদের আধুনিক জীবনযাপনে যে মানসিক সংকট ও উপন্যাসবাদ প্রকট, তার প্রেক্ষিতে গাজ্জালীর শিক্ষাগুলো বর্তমান যুগেও কতটা প্রাসঙ্গিক তা বিশ্লেষণ এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।

গাজ্জালীর নৈতিক দর্শনের মূলমন্ত্র

ইমাম গাজ্জালী নৈতিক শিক্ষার কেন্দ্রে মানব অন্তরকে রাখেন। তিনি হৃদয়ের পরিশুদ্ধি (তাজকিয়া-উন-নফস) ও ইখলাস (পবিত্র অন্তঃসততা) কে নৈতিকতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি মনে করেন। মক্কির হাদিস অনুযায়ী, “নিঃসন্দেহে শরীরের একটি ছোটো টুকরা রয়েছে; যখন তা সুস্থ থাকে তখন গোটা শরীর সুস্থ হয়, আর তা ব্যর্থ হলে গোটা শরীরই অসুস্থ হয়। সেটি হলো অন্তর”। গাজ্জালী এই হাদিসের আলোকেই অন্তরের মর্যাদা তুলে ধরেছেন। তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেন যে আল্লাহ তাআলা মানুষের বাহ্যিক অবস্থার দিকে নয়, অন্তরের বিশ্বাস ও ইবাদতের দিকে তাকান। সত্যিকারের নৈতিকতা অর্জনে নিয়্যাতের বিশুদ্ধি অপরিহার্য। “নিয়্যতের ওপর আমল” হাদিসটি (আল্লাহের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইঙ্গিত দেয় যে সমস্ত কাজের ফল পুরস্কার সঠিক নিয়্যতের ভিত্তিতে নির্ধারিত। গাজ্জালী তাঁর তত্ত্বে ইখলাসকে তিন স্তম্ভে ভাগ করেছেন: অন্তরে খাঁটি উদ্দেশ্য, সম্ভাব্য দূষণ থেকে মুক্তি, এবং পরিপূর্ণ সত্যনিষ্ঠা। এর ভিত্তিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে কোনও নেক-কর্ম তখনই মহান, যখন তার আসল উদ্দেশ্যে অন্য কাউকে শরীক না করা হয়।

তিনি নৈতিক প্রশিক্ষণে বিবেক ও অনুভূতির বিশেষ গুরুত্ব দেন। গাজ্জালী লোভ, হিংসা ও অহংকারকে তিনটি মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে বর্ণনা করেন যা মানুষের ক্ষতি করে। এ বিপরীতে তিনি তিনটি দায়বদ্ধ অভ্যাসের প্রশংসা করেন যা কল্যাণ বয়ে আনে: আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকা, বিপদের সময় দ্বোয়া করে সাহায্য প্রার্থনা করা, এবং প্রতিকূলতায় ধৈর্য ধারণ করা। গাজ্জালী জীবনকে সাম্য ও ভারসাম্যে রাখার পক্ষে ছিলেন; অতিরিক্ত ভোগবাদ বা চরম সমরিপন্থা উভয়কেই বিপজ্জনক মনে করেন। তাঁর নৈতিক দর্শনে মন ও জবান নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বও অপরিসীম – উদাহরণস্বরূপ “সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হল নিজের মন ও জবানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সামর্থ্য”। এসব শিক্ষায় প্রতিফলিত হয় শুদ্ধ অন্তর ও খাঁটি নফসের প্রতি গভীর একাগ্রতা।

ইমাম গাজ্জালীর নৈতিকতা উপলব্ধিতে ধর্ম, যুক্তিবাদ ও আধ্যাত্মিকতাকে একত্রিত করা হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে সহস্রাব্দ আগের ইসলামী শিক্ষার্থীদের মতোই মুসলিম উম্মাহ আজও সত্যিকার জ্ঞান ও নৈতিকতার সমন্বয় ধারণায় পিছিয়ে নয়। গ্রিক ও পাশ্চাত্য দর্শন-মতের হানা সামাল দেওয়ার পাশাপাশি গাজ্জালীর মন্ত্র ছিল অন্তরের পরিশুদ্ধি ও আন্তরিকতা। তাঁর দৃষ্টিতে কাযাক্ত উভয় জ্ঞান (ধর্মীয় ও সাধারণ) ধর্মীয় আদর্শের নীচে না দাঁড়িয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলতে হবে।

আধুনিক নৈতিক সংকটের চিত্র

আজকের যুগকে প্রযুক্তি, ভোগবাদ ও স্বনির্ভরতার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বহুত্ববাদী ও ভৌতিকতা-কেন্দ্রিক প্রবণতার কারণে বহু লোক আধ্যাত্মিক অন্বেষণ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল যুগে জ্ঞানের পোলারাইজেশন এবং নৈতিক অবক্ষয় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ তথ্য ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনে প্রবল ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও তার সঙ্গে সাথে জ্ঞানের বিচ্ছিন্নতা এবং আধ্যাত্মিক বিভ্রাটও বাড়িয়েছে। আধুনিক মানুষ ক্লান্ত, অনিশ্চিত, আত্ম-বন্ধনশীল এবং মানসিক চাপগ্রস্ত; তার বেশিরভাগ অন্বেষণই হয় বস্তুগত সম্পদ ও সুবিধায়। এ আবেগশূন্য জীবনধারা প্রাচীন নৈতিক মূল্যবোধের বিপরীতে সরাসরি বিরোধ সৃষ্টি করেছে।

শব্দার্থে, আমরা "অব্যক্তিকরণ" বা আত্মিক শূন্যতা এর সময়ে দাঁড়িয়েছি। বিশ্বব্যাংকসহ বেশ কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত মেলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উন্নতির যুগেও মানুষের আধ্যাত্মিক অসুখের মাত্রা কমেনি। বরং অনেকে নিজেকে একাকীত্ব ও লক্ষ্যহীনতার কবলে পড়ে দেখছে। সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষয়, হিংসা-দাঙ্গা, দুর্নীতি প্রভৃতি নানা বিপন্নতা আজ নিত্যদিনের সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমা সমাজে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে নৈতিক আরাধনা ও ইসলামী চেতনা থেকে বিচ্যুত তরুণদের মধ্যে হতাশা এবং আত্মঘাতী প্রবণতা বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা বারবার প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হই: অবশেষে কোন জায়গায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি? একটি কারণ স্পষ্ট: আধুনিক উপভোগবাদী সংস্কৃতি এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে সেতুবন্ধন গড়তে পারে নি আমরা। যেমন প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বর্তমানে অনেক মুসলিম তরুণ যুক্তিবাদ ও প্রযুক্তির বশবর্তী হয়ে দায়িত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুশীলন থেকে বিব্রতিত্ববোধ করছে।

গাজ্জালীর নীতিমালা এবং সমাধান

গাজ্জালীর শিক্ষা আধুনিক সংকটের মোকাবেলায় আজও আলোকের দিশারি হতে পারে। তাঁর দীক্ষনিতে আত্মপরিশুদ্ধি (তাজকিয়া-উন-নফস) নৈতিক পুনর্জীবনের প্রধানমন্ত্রীরূপে বিবেচিত হয়। কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন: ‘নিঃসন্দেহে সফল সে, যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে…’। অর্থাৎ জীবন-যাপনে শান্তি ও তৃপ্তির আসল মূল আত্মার পরিশুদ্ধি। গাজ্জালীও বারবার নির্দেশ দিয়েছেন নিজেকে মন্দবুদ্ধি ও কলুষতা থেকে রক্ষা করে পবিত্র কাজ সাধনের দিকে। হাদিস জানায়, আল্লাহ মানুষকে তার চেহারা বা ধনসম্পদ দেখে না, বরং অন্তর ও আমল দেখে। এ ভূমিকা বুঝেই গাজ্জালী বলেছিলেন, একজন ব্যক্তি যতই নেক-কাজ করুক, যদি সে রিয়া বা দেখানার জন্য করে, তাহ’লে সমস্ত সওয়াব হারাবে। একদিক থেকে তিনি কঠোর মন্তব্যও করেছেন: শিরক বা দেখানোর কোনো গুণ নেই – “যে ব্যক্তি কোন আমলে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে শরীক করে, আমি তাকে এবং তার শিরককে রেখে দেব”। এ শিক্ষা স্পষ্ট: নৈতিক–আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সেইসময়ই অর্জিত হয় যখন কর্মের উদ্দেশ্যে আমাদের মধ্যে একমাত্র আল্লাহর প্রতি খাঁটি বিশ্বাস ও ইখলাস জাগ্রত হয়।

গাজ্জালী আমাদের অনুপ্রাণিত করেন ব্রতী মধ্যপন্থায় জীবনযাপনে। অতিমাত্রায় পৃথিবীবাদ থেকে বিরত হয়ে পরিমিত পরিশ্রম, সাদাসিধে উপহার এবং সৃষ্টিজগতের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে সত্যপথে থাকা তার মূলমন্ত্র। গাজ্জালী এরই মধ্যে বলেছেন, “কোন পরিস্থিতিতেই হৃদয়ে অভিযোগের ভাষা উচ্চারিত হওয়া উচিত নয়” – অর্থাৎ সব সময় সন্তোষ ও ধৈর্য ধরার পরামর্শ। তাঁর নৈতিক শিক্ষায় মানবকল্যাণের জন্য দরিদ্রের সঙ্গে সহানুভূতি ও দান-দক্ষিণা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, তাঁর সন্তুষ্টিতেই আসল আস্থার মর্যাদা। এ কারণেই তিনি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, সময়ের শাসক ও আমীরদেরকেও ধর্মসম্মত নৈতিক অনুশাসন দিয়ে সতর্ক করতেন। তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকত্বের পুরসার্ধ জীবন ছেড়ে দিয়ে পরম বিশ্বাস-ভক্তির দিকে ঝুঁকেছিলেন, এটাই ব্যাখ্যা করে যে তার কাছে জ্ঞানের মূল লক্ষ্য ছিল আত্মোন্নতি।

আধুনিক যুগে গাজ্জালীর পরামর্শ হল – হৃদয় থেকে আল্লাহর খাঁটি প্রেম ও ভয় জাগান, অতিশয় ভোগবিলাস ও অহমিকা পরিহার করুন; বস্তুগত সাম্রাজ্য নয়, নৈতিক গভীরতার রাজত্ব কায়েম করতে হয়। তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও ধর্মকে পৃথক দেখার বিভ্রান্তি শুধুমাত্র সমস্যাই বাড়ায়। তাই এই যুগেও শিক্ষার মূলে নৈতিকতা-শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিকতা বজায় রাখার কল্যাণাংশ গর্জে ওঠে। গাজ্জালীর শিক্ষা অনুসরণ করলে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বদলে সেবামূলক চেতনা জাগ্রত হয়, অন্তরের কলুষতা কমে যায় এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের নৈতিক পুঁজি বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

গাজ্জালীর নৈতিক দর্শন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়: উন্নত জীবনের মাপকাঠি বিলাসিতা নয়, অন্তরের উৎকর্ষ ও সৎ আমলের সঙ্গতি। তিনি দেখিয়েছেন যে পবিত্র অন্তর আর পবিত্র কাজ একত্রে না থাকলে নৈতিক অগ্রগতি অসম্ভব। বর্তমান সংকটের মূল কারণ, মৌলিকভাবে, এই সমন্বয়হীনতায় নিহিত: আমরা অনেক সময় বাহ্যিক জ্ঞানে নিমগ্ন হয়ে অন্তরের চাহিদা উপেক্ষা করি। গাজ্জালীর শিক্ষা অনুযায়ী ঐ পেরেকই ভাঙ্গতে হয় যাতে হূমায়ূনের মতো প্রতিটি নেক-কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যায়। যে সমাজ এই চেতনা গ্রহণ করে না, তা অবলম্বনে নৈতিক সংকট ও মানসিক খালি সৃষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক।

অতএব আমাদের ব্যর্থতার জবাব গাজ্জালীর তত্ত্বে পাওয়া যেতে পারে: তিনি চেয়েছিলেন যে মুসলিম উম্মাহ নিজেদের অন্তরকে পবিত্র করে আসল ইবাদত শুরু করুক। সময়ের চাহিদায় আমরা যা করতে পারি তা হল গাজ্জালীর নৈতিক–আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করে জীবনযাপনে পালন করা – অন্তর পরিশুদ্ধির সাধনা, পরিপূর্ণ ইখলাসের চর্চা এবং দ্বীন-দুনিয়ার ভারসাম্য রক্ষা। এই মাধ্যমেই আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক খামতি দূর করে সত্যিকারের উন্নতি অর্জন করতে পারব। এতদ্বারা গাজ্জালীর প্রবর্তিত আদর্শ নৈতিক জীবন আজকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের চরম দরকার।

উৎস: আবু হামিদ আল-গাজ্জালীর বিভিন্ন রচনাসমূহ (বিশেষ করে ইহ্যাউ উলুমুদ্দীন), কোরআন ও হাদিসের মৌলিক বাণী, সমসাময়িক গবেষণা ও প্রবন্ধের বিশ্লেষণ।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter