সন্তানের উপর তালাকের প্রভাব: ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিকারমূলক কৌশল

সূচনা

তালাক, যদিও ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত, এটি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও জটিল সামাজিক প্রক্রিয়া। তালাক কেবল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতাই নয়, বরং এটি একটি পরিবারের কাঠামোকে ভেঙে দিতে পারে, যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয় সন্তানেরা। অনেক সময় বাবা-মায়ের মধ্যকার দাম্পত্য কলহ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে, যার ফলে পারিবারিক পরিবেশ বিষণ্ন ও অস্থির হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন ও পরবর্তীতে শিশুরা আবেগগতভাবে বিপর্যস্ত হয়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। ইসলাম, মানব জীবনের প্রতিটি স্তরে দিকনির্দেশনা প্রদান করে, তালাকের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলাম তালাকপ্রাপ্ত পরিবার ও বিশেষ করে সন্তানদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে কিছু নীতিমালা প্রদান করেছে, যা এই সংকটকালীন সময়ে আশীর্বাদস্বরূপ হতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা তালাকের কারণে সন্তানের উপর সৃষ্ট বিভিন্ন প্রভাব বিশ্লেষণ করব এবং ইসলাম কীভাবে সেই প্রভাবগুলো কমাতে পারে, তা বর্ণনা করব। এতে পবিত্র কুরআনের আয়াত, বিশ্বস্ত হাদীস এবং খ্যাতনামা ইসলামি পণ্ডিতদের মতামত অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে পাঠকরা জানতে পারবেন যে, তালাকের প্রভাব কীভাবে ন্যূনতম করা যায় এবং কীভাবে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ, ভারসাম্যপূর্ণ, ও মানবিক কাঠামো প্রদান করে সন্তানের কল্যাণ নিশ্চিত করে।

আবেগগত ও মানসিক প্রভাব

তালাকপ্রাপ্ত পিতামাতার সন্তানদের জীবনে প্রথম যে প্রভাবটি লক্ষ্য করা যায়, তা হলো আবেগগত ও মানসিক স্থিতির ভাঙন। সন্তান যখন দেখে তার বাবা-মা, যারা তার কাছে নিরাপত্তা, ভালোবাসা ও স্থিতিশীলতার প্রতীক, তারা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তখন তার মনোজগতে এক ধরনের গভীর অস্থিরতা তৈরি হয়। এই সময় শিশুরা নানা রকম আবেগের মধ্য দিয়ে যায়—দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা, একাকিত্ব, এমনকি আত্মবিশ্বাসের অভাবও তৈরি হয়। ছোট শিশুদের মধ্যে এটা আচরণগত সমস্যার মাধ্যমে প্রকাশ পায়—যেমন অতিরিক্ত কান্নাকাটি, রাগান্বিত ব্যবহার, ঘুমে সমস্যা, বা খাওয়ার অস্বাভাবিকতা। বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করা শিশুদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ, সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া এবং আত্মঘাতী চিন্তার মতো ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, তালাকপ্রাপ্ত পিতামাতার সন্তানরা মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। আমাটো ও কিথ-এর একটি বিশ্লেষণী গবেষণায় বলা হয়েছে, তালাকপ্রাপ্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা, স্কুলে খারাপ পারফরম্যান্স, এবং ভবিষ্যতে সম্পর্ক গঠনে জটিলতা—এই সব সমস্যা অন্যান্য শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যায়। এসব মানসিক সমস্যা যদি সময়মতো চিহ্নিত না করা যায় ও সহায়তা না দেওয়া হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। ইসলাম শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের কথা বলে এবং দয়া, স্নেহ ও সহযোগিতামূলক পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তোলার নির্দেশ দেয়, যাতে তারা জীবনের এই কঠিন অধ্যায় সহজে অতিক্রম করতে পারে।

শিক্ষা ও সামাজিক পরিণতি

তালাক শিশুর শুধু মানসিক অবস্থাকেই প্রভাবিত করে না, এটি তার শিক্ষা ও সামাজিক জীবনেও গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পারিবারিক ভাঙনের সময় শিশুরা এমন এক ধরণের মানসিক চাপে পড়ে, যা তাদের একাগ্রতা, আত্মপ্রত্যয় ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হ্রাস করে। তারা বিদ্যালয়ে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারে না, পাঠ্যবইয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এমনকি অনেক সময় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে কিংবা পাঠ্যক্রম থেকে ছিটকে পড়ে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে তালাকপ্রাপ্ত পিতামাতার সন্তানদের পরীক্ষার ফলাফল অনেক সময় খারাপ হয় এবং তারা উচ্চশিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে পড়ে। এটি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে নয়, বরং পারিবারিক অস্থিরতা ও অভিভাবকদের পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাবও এর অন্যতম কারণ।

সামাজিক ক্ষেত্রেও এই সন্তানেরা সমস্যার সম্মুখীন হয়। বন্ধু বা সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমস্যা হয়, আত্মনির্ভরশীলতা কমে যায় এবং আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। তারা কখনও কখনও নিজেদের দোষারোপ করে, মনে করে যে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের জন্য তারা দায়ী। এতে তাদের মধ্যে অপরাধবোধ জন্ম নেয় এবং আত্মমর্যাদাবোধ ভেঙে পড়ে। এই অনুভূতি থেকে অনেক সময় তারা সহপাঠীদের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করে অথবা নিজেকে একেবারে গুটিয়ে রাখে। অনেক সময় শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, কিংবা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কও নেতিবাচক হয়ে পড়ে।

ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং শিশুদের উপযুক্ত পরিবেশে বড় করে তুলতে, যাতে তারা ভবিষ্যতে শিক্ষিত ও সদাচরণসম্পন্ন নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। তালাক হলেও শিশু যেন শিক্ষা ও সামাজিক জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সচেতন পদক্ষেপ নেওয়া প্রত্যেক অভিভাবকের কর্তব্য।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিকারমূলক কৌশল

ইসলাম ধর্ম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের পারিবারিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিটি দিকের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তালাকের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রেও ইসলাম বাস্তবভিত্তিক সমাধান ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে সন্তানদের কল্যাণের বিষয়টি ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। পবিত্র কুরআন এবং রাসূল (সা.)-এর হাদীসসমূহে দেখা যায়, বিচ্ছেদের পরেও সন্তান যেন অবহেলিত না হয়, সেই বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামি শিক্ষায় বারবার বলা হয়েছে, সন্তান আল্লাহর দেয়া আমানত, এবং তাদের লালন-পালন, শিক্ষাদান ও মানসিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা বাবা-মা উভয়ের দায়িত্ব।

তালাকের পর পারিবারিক পরিবেশ ভিন্ন রূপ নিলেও, সন্তানের প্রতি উভয় অভিভাবকের দায়িত্ব ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনও কমতি হওয়া উচিত নয়। ইসলাম শূরা বা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর গুরুত্ব দেয়। কুরআনে বলা হয়েছে, “তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো” (সূরা আলে ইমরান ৩:১৫৯)—এই আয়াতটি আমাদের শেখায় যে, তালাকের পরও সন্তানের বিষয়ে মা-বাবার মধ্যে সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। মনে রাখবেন 

أَبْغَضُ الْحَلالِ إِلَى اللَّهِ الطَّلَاقُرواه أبو داود (2178)

“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য বৈধ জিনিস হলো তালাক”। আবু দাউদ (২১৭৮) থেকে বর্ণিত।

ইসলামি পণ্ডিতগণ, যেমন ইমাম ইবন কুদামা, ব্যাখ্যা করেছেন যে, সন্তানদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য বাবা-মা উভয়ের উচিত তাদের আবেগ ও বিরোধিতা পাশে রেখে সন্তানের মঙ্গলের দিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া।

সুতরাং, ইসলাম শুধু তালাককে বৈধ ঘোষণা করে থেমে যায় না, বরং তালাকপ্রাপ্ত পরিবার যেন ন্যায়, দয়া ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রদান করে।

আর্থিক সহায়তা ও হেফাজতের অধিকার

তালাকের পর সন্তানের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে ইসলাম স্পষ্টভাবে পিতার আর্থিক দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “ধনবান ব্যক্তি যেন তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করে, আর যার সামর্থ্য সীমিত, সে যেন আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন, তা থেকেই ব্যয় করে” (সূরা আত-তালাক, ৬৫:৭)। এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে, তালাকের পরও সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পিতার ওপরই বর্তায়, তা সে ধনী হোক বা মধ্যবিত্ত—তাকে নিজের সাধ্য অনুযায়ী সন্তানদের প্রয়োজন মেটাতে হবে। সন্তান যেন খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা একটি ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।

হেফাজত বা হিদানাহর ক্ষেত্রেও ইসলাম মানবিকতা ও সন্তানের সর্বোত্তম কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়। প্রখ্যাত ইসলামি ফিকহবিদ ইমাম মালিক মত দিয়েছেন, শিশুর প্রাথমিক বয়সে মাতার হেফাজতে থাকাই সর্বোত্তম, কারণ একজন মা স্বাভাবিকভাবে স্নেহশীল ও যত্নশীল। তবে হেফাজতের সিদ্ধান্ত একপাক্ষিক নয়—শিশুর শারীরিক ও মানসিক চাহিদা, বাবার-মায়ের চরিত্র, এবং কার পক্ষে সন্তান নিরাপদ থাকবে, তা বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যদি মায়ের পক্ষে সন্তানের যত্নে ব্যর্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে হেফাজতের অধিকার পিতা বা অন্য বিশ্বস্ত অভিভাবকের হাতেও যেতে পারে।

সার্বিকভাবে, ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি প্রস্তাব করে, যেখানে সন্তানের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। এই নীতিমালাগুলোর সঠিক বাস্তবায়নই তালাকের পর শিশুর জীবনে স্থিতি ও সুস্থতা আনতে পারে।

আবেগগত ও আধ্যাত্মিক সহায়তা

তালাকের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক পরিবর্তনের সময় শিশুদের শুধু বস্তুগত সহায়তা নয়, বরং আবেগগত ও আধ্যাত্মিক সহায়তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশুর হৃদয় তখন ভেঙে যায় যখন সে দেখে যে তার বাবা-মা, যারা তার জীবনের মূল ভরসা, একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তনের সময় শিশুদের মনে অসংখ্য প্রশ্ন ও উদ্বেগ জন্ম নেয়—“কেন এমন হলো?”, “আমি কি এর জন্য দায়ী?”, “আমার ভবিষ্যৎ কী?” ইত্যাদি। এই সব প্রশ্নের উত্তর যদি সময়মতো স্নেহ ও ভালোবাসার মাধ্যমে না দেওয়া হয়, তবে শিশুর মনোবিকাশে চিরস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

ইসলাম এই দিকটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, “সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না” (সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৪৯২৩)। এই হাদীস শিশুদের প্রতি স্নেহ, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধের গুরুত্ব তুলে ধরে। তালাকের পর বাবা-মা উভয়ের উচিত সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের অনুভূতি বোঝা এবং তাদের নিরাপত্তার অনুভব করানো।

একই সঙ্গে, আধ্যাত্মিক সহায়তাও শিশুদের মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারে। নামাজে অংশগ্রহণ, কুরআন পাঠ, আল্লাহর উপর ভরসা করা—এসব অভ্যাস শিশুর মনে শান্তি এনে দেয় ও তাকে মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলে। ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন তারা জীবনের কঠিন সময়েও আত্মবিশ্বাস হারায় না এবং এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে।

মধ্যস্থতা ও কাউন্সেলিং

ইসলামে বিবাদ মীমাংসার জন্য মধ্যস্থতা ও পরামর্শ গ্রহণের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। তালাকের পরিস্থিতিতে শুধু স্বামী-স্ত্রীর নয়, বরং সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, 

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَٱبْعَثُوا۟ حَكَمًۭا مِّنْ أَهْلِهِۦ وَحَكَمًۭا مِّنْ أَهْلِهَآ إِن يُرِيدَآ إِصْلَـٰحًۭا يُوَفِّقِ ٱللَّهُ بَيْنَهُمَآ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًۭا

“তোমরা যদি তাদের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করো, তাহলে পুরুষের পক্ষ থেকে একজন এবং নারীর পক্ষ থেকে একজন মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত করো। তারা উভয়ে মীমাংসা করতে চাইলেই, আল্লাহ তাদের মধ্যে মিল ঘটাবেন” (সূরা নিসা, ৪:৩৫)।

এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, ইসলাম দ্বন্দ্ব নিরসনে পারিবারিক ও সমাজভিত্তিক সমাধানকে উৎসাহিত করে। আধুনিক যুগে পারিবারিক কাউন্সেলিং ও মনোচিকিৎসা এই হাদীসিক দৃষ্টিভঙ্গিরই আধুনিক রূপ। বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতারা বাবা-মা ও শিশুদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারেন। এতে পরিবারের সদস্যরা আবেগ নিয়ন্ত্রণ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনে একসঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হয়।

সমাজের সহায়তা

তালাকপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর জন্য সমাজের সহানুভূতি ও সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম সমাজকে একটি সংহত ও সহানুভূতিশীল কাঠামো হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। মহানবী (সা.) বলেন, “ঈমানদারগণ পারস্পরিক দয়া, সহানুভূতি ও ভালোবাসায় একটি দেহের মতো। দেহের এক অঙ্গ কষ্ট পেলে, সমস্ত দেহ সেই কষ্টে সাড়া দেয় জ্বর ও নিদ্রাহীনতার মাধ্যমে” (সহীহ মুসলিম)।

এই হাদীস সমাজে পারস্পরিক দায়িত্ববোধের উপর জোর দেয়। তালাকের ফলে যেসব শিশু মানসিক বা আর্থিক সংকটে পড়ে, তাদের পাশে দাঁড়ানো সমাজের দায়িত্ব। মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম, পরামর্শ সেবা, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং ধর্মীয় গাইডলাইন দিয়ে এমন পরিবারকে সমর্থন দেওয়া উচিত। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের উচিত এমন পরিবারকে উপেক্ষা না করে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করা।

সামাজিক সহায়তার এই পদ্ধতি কেবল পরিবারকে নয়, পুরো সমাজকে আরও মজবুত ও সহানুভূতিশীল করে তোলে।

আইনি সুরক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

ইসলামী সমাজব্যবস্থায় শিশুদের অধিকার রক্ষায় আইনি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। তালাকের পর অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মা উভয়ে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করেন, কিংবা হেফাজত ও ভরণপোষণ নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী শিক্ষার আলোকে একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। বহু মুসলিমপ্রধান দেশে শারিয়াহ-ভিত্তিক পারিবারিক আইন প্রণীত হয়েছে, যা শিশুদের নিরাপত্তা, অভিভাবকত্ব, খরচ এবং শিক্ষার বিষয়গুলো তদারকি করে।

উদাহরণস্বরূপ, মালয়েশিয়ার Islamic Family Law (Federal Territory) Act 1984 একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো প্রদান করে যা তালাক পরবর্তী সময়ে শিশুদের হেফাজত, ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এই আইনে আদালতের মাধ্যমে মায়ের বা বাবার অভিভাবকত্ব নির্ধারণ করা হয়, এবং উভয় পক্ষকে শিশুর কল্যাণের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয়।

ইসলামে ন্যায়বিচার ও কল্যাণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে নিপীড়িতদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে। তাই রাষ্ট্রীয় আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ইসলামি মূল্যবোধের বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে তালাকপ্রাপ্ত পরিবারগুলো, বিশেষ করে শিশুরা, একটি নিরাপদ, সহানুভূতিশীল ও স্থিতিশীল জীবনের সুযোগ পায়, যা তাদের সুস্থ মানসিক বিকাশ ও ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সমাপনী বক্তব্য 

তালাক নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক ও পারিবারিক পরিবর্তনের ঘটনা, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুদের উপর। তাদের মানসিক, আবেগগত, সামাজিক ও শিক্ষা জীবনে এই পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শক্তিশালী ও ভারসাম্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। পবিত্র কুরআন, হাদীস এবং ইসলামী ফিকহে তালাকপ্রাপ্ত বাবা-মায়ের দায়িত্ব, সন্তানের কল্যাণ, এবং সমাজের ভূমিকা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

সহযোগিতাপূর্ণ সহঅভিভাবকত্ব, আর্থিক দায়িত্ব পালন, আবেগগত সহায়তা, ধর্মীয় শিক্ষা, মধ্যস্থতা, সমাজের সহানুভূতি ও রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামো—এসব একত্রে একটি সুসংগঠিত কাঠামো গড়ে তোলে যা শিশুদের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। ইসলাম কেবল তালাককে বৈধতা দেয়নি, বরং তার পরবর্তী সময়ে ন্যায়বিচার ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে শিশুর অধিকার রক্ষার ওপর জোর দিয়েছে।

তাই, আজকের সমাজে যেখানে তালাকের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঠিক ইসলামী জ্ঞান, সহমর্মিতা ও আইনি কাঠামোর সমন্বয়ে তালাকপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। এটাই ইসলামের মূল লক্ষ্য—অবিচার রোধ করে, মমতা ও ন্যায়বিচারের আলোকে মানব জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করা।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter