রইল পদচিহ্ন, রইল অনন্ত আলোর দিশা: অমরত্বের পথে ডাঃ মুনকির হুসাইন সাহেব
মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু মানুষ কেবল মরণশীল দেহ নয়, তার কর্মই তাকে অমর করে রাখে। দুনিয়ায় কেউ বেঁচে থাকে রক্ত-মাংসে, আবার কেউ বেঁচে থাকে তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার, জ্ঞান, শিক্ষা ও সৎকর্মের মাধ্যমে। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন – “নিশ্চয়ই আমরা মৃতদের জীবিত করি এবং তাদের কৃতকর্ম ও পদচিহ্নসমূহ লিখে রাখি।” (সূরা ইয়াসীন: ১২)।
এই আয়াত গভীর তাৎপর্য বহন করে, যা ইঙ্গিত দেয় যে একজন ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যু হলেও, তার প্রভাব ও কর্মফল আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকে। এই চিরন্তন চিহ্নগুলোই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষের প্রকৃত পরিচয় হয়ে ওঠে। অতএব, ব্যক্তি চলে গেলেও তার কাজ, তার অবদান কখনও হারিয়ে যায় না। মূল পাঠে উল্লিখিত ছবিটি এই চিরন্তন সত্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এই “সবুজ গম্বুজ ও সুউচ্চ মিনারবিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান” নিছক একটি ভবন নয়; এটি একজন মানুষের আজীবন ত্যাগ, স্বপ্ন ও অক্লান্ত পরিশ্রমের এক মূর্ত প্রতীক। সেই ব্যক্তি হয়তো আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞান ও শিক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে চলেছে। বাগানের একটি ছোট্ট ফলক, যেখানে “ডাঃ মুনকির হুসাইন সাহেব” নামটি খোদাই করা, এই ধারণাটিকে আরও দৃঢ় করে। এটি যেন স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই আলোকিত শিক্ষাঙ্গন এক নিবেদিতপ্রাণ মানুষের হাতে রোপিত একটি চারা, যা আজ মহীরুহ হয়ে হাজারো শিক্ষার্থীকে ছায়া দিচ্ছে। এর পাশেই দেখা যাচ্ছে এক দীর্ঘ পথ, যে পথে অগণিত শিক্ষার্থী এগিয়ে চলেছে, হাতে বই আর চোখে স্বপ্ন। তারা যেন সেই অদৃশ্য মানুষটির রোপণ করা আলোকেই ভবিষ্যতের পথে বহন করছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অমরত্ব:
জ্ঞানের উত্তরাধিকারই সম্ভবত মানুষের রেখে যাওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন – “যখন মানুষ মারা যায়, তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি কাজ চলতে থাকে: সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান এবং সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” (সহীহ মুসলিম)। এই মহিমান্বিত হাদীস স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, উপকারী জ্ঞান ও শিক্ষা এমন এক সম্পদ যা মৃত্যুর পরও মানুষকে জীবিত রাখে। ছবিতে চিত্রিত শিক্ষালয়টি এই হাদীসেরই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। একজন মানুষ তার অক্লান্ত পরিশ্রমে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তা শত শত শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করছে। এই জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রতিষ্ঠাতা অনবরত সওয়াব অর্জন করছেন। উপরন্তু, সমস্ত শিক্ষার্থীকে তাঁর নেক সন্তান গণ্য করা হয়, যারা তাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহর কাছে তাঁর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে, এবং এই দোয়ার সওয়াবও তিনি অনুভব করতে পারেন, যদিও তিনি আর এই পার্থিব জগতে নেই।
সদকায়ে জারিয়া (অবিচ্ছিন্ন দান) নামক এই ধারণাটি ইসলামিক চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এবং একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার ধারণার সাথে গভীরভাবে জড়িত। একটি মসজিদ, একটি কূপ, একটি বিদ্যালয় – এগুলো কেবল কাঠামো নয়, বরং চলমান কল্যাণের মাধ্যম, যার সওয়াব দানকারীর মৃত্যুর পরেও প্রবাহিত হতে থাকে। ছবির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এই নীতিকে পুরোপুরি মূর্ত করে তোলে। ডাঃ মুনকির হুসাইন সাহেবের দূরদৃষ্টি ও নিষ্ঠা জ্ঞানের এক স্ব-টেকসই ঝর্ণাধারা তৈরি করেছে। প্রতিটি শেখা পাঠ, প্রতিটি আলোকিত ছাত্র, প্রতিটি জীবন যা ঐ দেয়ালগুলির মধ্যে রূপান্তরিত হয়েছে, তা তাঁর অনন্ত পুণ্যের খাতায় যুক্ত হচ্ছে। এটি একটি শক্তিশালী অনুস্মারক যে, শিক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ কেবল বর্তমানের জন্য নয়, বরং এক অন্তহীন ভবিষ্যতের জন্য, যা পার্থিব উন্নতি এবং আধ্যাত্মিক উভয় পুরস্কারই নিশ্চিত করে।
কর্মের উত্তরাধিকার:
যখন একজন মানুষ মাটির নিচে চলে যায়, তখন তার অর্থ, তার সম্পদ, এমনকি তার দেহও মাটির সাথে মিশে যায়। কিন্তু যা থেকে যায়, তা হলো তার কর্মের প্রতিচ্ছবি। যেমন ছবিতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষার আলো অন্বেষণে এক দীর্ঘ পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে। হাতে বই, হৃদয়ে সুদৃঢ় স্বপ্ন এবং চোখে আলোর দিগন্ত – তারা মূলত প্রতিষ্ঠাতার কল্পিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করছে এবং তা করে যাবে। প্রকৃতপক্ষে, তারা সেই ব্যক্তির রেখে যাওয়া কর্মের উত্তরাধিকার বহন করছে।
এই “কর্মের উত্তরাধিকার” কেবল দৃশ্যমান বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সেই মূল্যবোধ, নীতি এবং মানসিকতাকে ধারণ করে যা একজন ব্যক্তি অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। ডাঃ মুনকির হুসাইন সাহেবের কাজ কেবল প্রতিষ্ঠানের ইট-পাথর নয়, বরং অনুসন্ধিৎসু মন, শ্রেষ্ঠত্বের সাধনা এবং সেবার প্রতি তাঁর যে অঙ্গীকার ছিল, তারই প্রতিচ্ছবি। শিক্ষার্থীরা এই আদর্শগুলো মূর্ত করে তোলার মাধ্যমে কেবল বই বহন করছে না; তারা একটি মশাল বহন করছে, যা নতুন মনকে আলোকিত করছে এবং ভবিষ্যৎকে shaping করছে। তাদের উপস্থিতি, শিক্ষার প্রতি তাদের নিষ্ঠা, সেই ব্যক্তির প্রতি একটি জীবন্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি যিনি তাদের যাত্রাকে সম্ভব করেছেন। সৎকার্যের এই অবিচ্ছিন্ন প্রভাব একটি স্থায়ী উত্তরাধিকারের প্রকৃত অর্থকে তুলে ধরে, যা যেকোনো জাগতিক সম্পদকে ছাড়িয়ে যায়।
ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া, চিরস্থায়ী আখিরাত:
এই ছবির বার্তা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে উন্মোচন করে যে – দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। একজন মানুষ যত বড় হোক না কেন, সে একদিন চলে যাবে। তবে, এই জীবনে তার কর্মই তার আখিরাতের পথ তৈরি করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বলেছিলেন – “তোমরা দুনিয়াতে এমনভাবে জীবনযাপন কর যেন তুমি একজন পথিক বা ভ্রমণকারী।” (সহীহ বুখারী)। এই হাদীসের অর্থ হলো, এই দুনিয়া একটি অস্থায়ী আবাস। একজন পথিক যেমন ভবিষ্যতের যাত্রীদের জন্য পথের ধারে কিছু রেখে যায়, তেমনি একজন মুমিনেরও উচিত দুনিয়ায় এমন কর্ম রেখে যাওয়া, যা তার মৃত্যুর পর অন্যদের উপকারে আসে। ছবির শিক্ষালয় ও শিক্ষার্থীরা এই মহৎ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পথিকের এই উপমা অত্যন্ত অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। এটি আমাদের পার্থিব অস্তিত্বকে একটি স্থায়ী বাসস্থান হিসেবে না দেখে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যসহ যাত্রা হিসেবে দেখতে উৎসাহিত করে। আমরা যা “রেখে যাই” তা কেবল আমাদের আখিরাতের সুবিধার জন্য নয়, বরং যারা আমাদের অনুসরণ করে, তাদের সুবিধার জন্যও। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, একটি কূপ, একটি গাছ, একটি বই – এগুলি সবই ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য “সামগ্রী”। এগুলি কেবল মানবতাতেই নয়, আমাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিক অগ্রগতিতেও একটি বিনিয়োগ। ছবিটি সূক্ষ্মভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমাদের পার্থিব প্রচেষ্টা, যখন পরোপকার এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন তা আমাদের নিজস্ব মরণশীলতার সীমানা অতিক্রম করতে পারে এবং আমাদের চলে যাওয়ার পরেও ফল প্রদান করতে পারে। এটি জোর দেয় যে এখানে আমাদের সময় একটি মূল্যবান সুযোগ, যা আখিরাতে ফলপ্রসূ হবে এমন সৎকার্য বীজ রোপণ করার জন্য।
আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিক:
ছবিটি শুধু একজন মহান ব্যক্তির স্মৃতি বহন করে না, বরং আমাদের জন্য একটি গভীর আহ্বানও বটে। আমরা কি আমাদের জীবনকে কেবল ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাসে নষ্ট করব? নাকি এমন কিছু সৃষ্টি করব, যা আমাদের মৃত্যুর পরও টিকে থাকবে? প্রতিটি ব্যক্তিই তার সামর্থ্য অনুযায়ী অমর চিহ্ন রেখে যেতে পারে। কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে, কেউ একটি বৃক্ষ রোপণ করে, কেউ একটি বই লিখে যায়, কেউ একজন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে সাহায্য করে। এসবই সদকায়ে জারিয়া হয়ে দাঁড়ায়। তাই, এই ছবির দিকে তাকালে হৃদয় আবেগে ভরে ওঠে। মনে হয় – আমরাও কি এমন কিছু রেখে যেতে পারি না, যা আগামী প্রজন্ম আমাদের স্মরণ করবে? চলে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কিভাবে চলে যাব, আর আমাদের পর কী রয়ে যাবে, সেটিই আসল প্রশ্ন।
এই আত্ম-নিরীক্ষণ সম্ভবত পাঠের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। এটি আমাদের স্বার্থপরতা ছাড়িয়ে বৃহত্তর অর্থে বিশ্বের উপর আমাদের প্রভাব বিবেচনা করতে বাধ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা, একটি গাছ লাগানো, একটি বই লেখা, একজন অভাবী শিক্ষার্থীকে সাহায্য করা – এগুলি সবই সম্মিলিত কল্যাণে অবদান রাখার অসংখ্য উপায়কে চিত্রিত করে। এটি জোর দেয় যে সদকায়ে জারিয়া কেবল মহৎ অঙ্গভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দৈনন্দিন দয়া এবং দূরদর্শিতার কাজেও প্রকাশ পেতে পারে। ছবিটি যে আবেগ জাগিয়ে তোলে, তা অর্থ এবং স্থায়ী তাৎপর্যের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের জীবন, যত সংক্ষিপ্তই হোক না কেন, যদি আমরা এমন কিছু তৈরি করার দিকে মনোনিবেশ করি যা আমাদের ছাড়িয়ে টিকে থাকে, তাহলে তা সত্যিই প্রভাবশালী হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জটি তাই কেবল বিদ্যমান থাকা নয়, বরং এমন একটি জীবন যাপন করা যা বিশ্বের উপর একটি স্থায়ী, ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উপসংহার:
ছবিটি যেন নিঃশব্দে ঘোষণা করছে: “মানুষ মরে যায়, কিন্তু তার পদচিহ্ন অমর হয়ে থাকে।” একদিন সবাই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু প্রশ্ন হলো – আমরা চলে গেলে কী রেখে যাব? কেবল কিছু স্মৃতি, নাকি প্রজন্মকে আলোকিত করার এক অমর উত্তরাধিকার? ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় – সৎকর্মই হলো মানুষের প্রকৃত উত্তরাধিকার। আজ যারা শিক্ষার আলোয় পথ চলছে, তারা আসলে বহন করছে এক মহৎ প্রাণের রেখে যাওয়া আলোর দিশা। তাই আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি – আমাদের জীবনও হবে এমন, যা শেষ হয়ে গেলেও রেখে যাবে অমলিন পদচিহ্ন। কারণ মানুষ চলে যায়, কিন্তু রয়ে যায় তার কর্মের আলো – যা আখিরাত পর্যন্ত জ্বলে, চিরকালীন পথপ্রদর্শক হয়ে। এই উপসংহারমূলক অনুচ্ছেদগুলি সুন্দরভাবে বিভিন্ন থিমগুলিকে একত্রিত করে, যা আত্ম-প্রতিফলন এবং কর্মের জন্য একটি শক্তিশালী আহ্বানের দিকে নিয়ে যায়। “পদচিহ্ন” রূপকটি বিশেষভাবে কার্যকর, যা পূর্ববর্তীদের দ্বারা হেঁটে যাওয়া একটি পথের চিত্র তুলে ধরে, যাদের প্রভাব অনুসারীদের পথ দেখাতে থাকে। কেবল “স্মৃতি” এবং একটি “অমর উত্তরাধিকার”-এর মধ্যে পার্থক্যটি সৎকার্যের প্রতি নিবেদিত জীবনের গভীর প্রভাবকে তুলে ধরে। এটি একটি শক্তিশালী অনুস্মারক যে এই পৃথিবীতে আমাদের কর্মগুলি আমাদের পার্থিব অস্তিত্বের মধ্যে।