জাতীয় শিক্ষা দিবসে মৌলানা আজাদের শিক্ষা-দর্শন

শিক্ষার আলোকবর্তিকা দিবসের প্রেক্ষিতে আমরা স্মরণ করছি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে, যিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী এবং একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছিলেন। এই দিবস কেবল একটি বছরের স্মরণযজ্ঞ নয়, এটি শিক্ষার ইসলামী ও মানবিক মূল্যের প্রতি পুনর্মূল্যায়ন ও প্রত্যবর্তনের আহ্বান।

আবাদী শাসন ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা বহু দিক থেকে শিক্ষাকে মাত্র চাকরিপ্রদানকের নিমিত্তে পরিণত করেছিল। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই ধারা ভাঙতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি শিক্ষাকে শুধু জ্ঞানের সংস্পর্শ বা শিক্ষাগত অর্জনের বিষয় হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে দেশ­ সমাজ ও মানবতার মুক্তি-উন্মুক্ত এক শক্তি হিসেবে গণ্য করেছিলেন। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা মানে শুধু সিলেবাস পড়া নয়, তা হলো ‘আল-ইলম’-এর সেই নিরন্তর যাত্রা, যেখানে জ্ঞান হয় হৃদয়ে আলো, মনে সচেতনতা ও কৃতজ্ঞতায় পরিণত হয়। আজাদ এই ধারণাকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে রূপায়িত করেছিলেন,তিনি বলেছিলেন, “এক জন শিক্ষিত মানুষ ছাড়া কোনো জাতি স্বাধীনতা ও জাত-উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না।” আজ আমরা যখন শিক্ষার ভূমিকা, উদ্দেশ্য ও মান নিয়ে দিবসটি পালন করছি, তখন আজাদের শিক্ষাদর্শ আমাদের সামনে এক সুস্পষ্ট চিত্র উন্মোচন করে, একটি শিক্ষা যা শুধু ব্যাকরণী বা পাঠ্যপুস্তকসংবলিত নয়, বরং নৈতিকতা, সামাজিক সংহতি, সাংস্কৃতিক সচেতনতা ও মানবিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে জড়িত। 

তিনার অবদান

১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণকারী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন প্রবল স্বাধীনতা সংগ্রামী, একজন প্রভাবশালী পণ্ডিত এবং শিক্ষার একজন উৎসাহী সমর্থক। তরুণ বয়সে, আজাদ স্বাধীনতা এবং সামাজিক সংস্কারের ধারণা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং অবশেষে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। তিনি ভারতের শিক্ষা কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, শিক্ষাকে ব্যক্তিগত বিকাশ এবং জাতীয় অগ্রগতি উভয়ের জন্যই একটি হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।

স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে, আজাদের নীতি ও কর্মসূচি দেশের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে ভারতীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান (IIT) এর মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল , যা তখন থেকে শিক্ষাগত উৎকর্ষতার বিশ্বব্যাপী প্রতীক হয়ে উঠেছে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) , যা ভারত জুড়ে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ এবং প্রচার করে চলেছে। তাঁর প্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠান তৈরির বাইরেও বিস্তৃত ছিল; আজাদ প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষার গুরুত্বকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বিশ্বাস করতেন। গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং মেয়েদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়নের উপর তাঁর মনোনিবেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।

তিনার শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণা

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত মানুষ হিসেবে তিনি মনে করতেন, খাদ্য-বস্ত্রের পরেই শিক্ষার স্থান। স্বাধীনতার পরে নেহরু মন্ত্রীসভায় শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব তিনি দীর্ঘ দু-দশকের বেশি সময় জুড়ে আমৃত্যু পালন করে গেছেন। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের শিক্ষার উন্নতি ও সংস্কারের জন্য যেসব কর্মসূচি ও পদক্ষেপ মৌলানা আজাদ নিয়েছিলেন, তা এককথায় যুগান্তকারী। মৌলানা আজাদের শিক্ষা কর্মসূচি ও নীতির উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল-

১)শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ মৌলানা আজাদ ভারতীয় সমাজের জাতপাতভিত্তিক কুসংস্কার, বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদ ব্যবস্থার অস্তিত্ব দেখে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অসাম্যের শিকড় অনেক গভীরে থেকে গেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র শিক্ষাই পারে এসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এজন্য তিনি প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগসুবিধার মধ্যে একটা সমতা আনতে চেয়েছিলেন।

বয়স্ক শিক্ষা (Adult Education)-এর ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন। বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমে তিনটি উদ্দেশ্যকে রূপায়িত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল-(i) নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও সাক্ষরতার প্রসারণ, (ii) নাগরিক সচেতনতা বিশেষ করে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানের সঞ্চার (iii) শিক্ষিত মানসিকতার বিকাশ।

২) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপরে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল উচ্চতর প্রযুক্তিগত শিক্ষায় ভারতকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা, যাতে কারিগরি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কোনো দেশের উপরে আমাদের নির্ভর না করতে হয়। সেই সঙ্গে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক দিনের যখন বিদেশের মানুষরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে ছুটে আসবে। ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব টেকনোলজি (আই আই টি) খড়গপুরের উদ্বোধনে (1951 খ্রিস্টাব্দে, আগস্ট) তাঁর এই প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছিলেন মৌলানা আজাদ।

৩) জাতীয় সংহতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা মৌলানা আজাদ মনে করতেন শিক্ষার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হবে ভারতের জাতীয় সংহতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। এজন্য ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সাহিত্যের পাঠ্যবইগুলিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বিষয়টিকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এতে ছাত্রছাত্রীদের মনে প্রথম থেকেই নিজেদের দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি প্রগতিশীল মানসিকতা গড়ে উঠবে।

৪) পাঠক্রম ও শিক্ষা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের অভিমত ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষার পাঠক্রম থেকে স্বাধীন ভারতের শিক্ষার পাঠক্রম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির হবে। এজন্য স্বাধীন ভারতে প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব হাতে নিয়ে তিনি ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শিক্ষার পুরানো পাঠক্রমকে বর্জন করেছিলেন। মৌলানা আজাদ শিক্ষা পাঠক্রমকে নতুনভাবে যে রূপ দিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল-

i . প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে ‘কাজের মাধ্যমে শিখি’ বা ‘Learning by doing’-এর নীতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল, যাতে করে ছাত্রছাত্রীরা হাতেকলমে বাস্তব শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।

  1. মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম স্বাধীনতার পরে শিক্ষামন্ত্রী আজাদের নির্দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (1952) স্বাধীন ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে নতুনভাবে সাজিয়েছিল।

iii. উচ্চ শিক্ষার পাঠক্রম উচ্চ শিক্ষার পাঠক্রমকে বাস্তবসম্মত করে গড়ে তোলার জন্য বিশেষীকরণের ক্ষেত্রগুলিকে (specialized fields) জোর দেওয়া হয়।

  1. বয়স্ক শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার পাঠক্রম বয়স্ক শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার পাঠক্রমকে এমনভাবে সাজানো হয় যাতে বয়স্ক শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জাতীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে দেশের সামাজিক উন্নয়নে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখা যায়।
  2. গ্রামীণ শিক্ষার পাঠক্রম মৌলানা আবুল কালাম আজাদ গ্রামীণ ক্ষেত্রে কৃষি ও অন্যান্য বিষয়-সহ বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
  3. শারীরিক শিক্ষার পাঠক্রম শারীরিক শিক্ষায় (Physical education) বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, শরীরচর্চা ইত্যাদি বিষয়কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে ছাত্রছাত্রীরা সুস্থ ও সবল দেহ- মনের অধিকারী হতে পারে। এভাবে নিছক জ্ঞান অর্জনের মধ্যে শিক্ষার পাঠক্রমকে সীমিত করে না রেখে তার মধ্যে বৈচিত্র্যের প্রসার ঘটানো হয়।

এই দিবসের তাৎপর্য

জাতীয় শিক্ষা দিবস জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষার তাৎপর্য স্বীকৃতি এবং পুনরাবৃত্তি করার একটি সুযোগ। শিক্ষা ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বিকাশ এবং সক্রিয় নাগরিকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধ দিয়ে সজ্জিত করে। এই দিনটি একটি প্রগতিশীল জাতি এবং সামাজিকভাবে সুসংহত সমাজ গঠনে শিক্ষার ভূমিকার স্মারক হিসেবে কাজ করে। আজাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটি ন্যায়সঙ্গত শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত করে যা সমাজের সকল স্তরের ব্যক্তিদের অর্থপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম করে।

জাতীয় শিক্ষা দিবস শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ, শিক্ষার মান উন্নত করা এবং গ্রামীণ এলাকায় আঞ্চলিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য এবং সম্পদের অভাবের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার গুরুত্বকেও তুলে ধরে। মৌলানা আজাদের আদর্শ শিক্ষাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়, যাতে প্রতিটি শিশু, তাদের পটভূমি নির্বিশেষে, শেখার এবং সফল হওয়ার সুযোগ পায়। আজ ভারতে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ধরণের স্কুল রয়েছে।

উপসংহার

জাতীয় শিক্ষা দিবস কেবল স্মরণের দিন নয়; এটি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান। স্বাধীনতা, সাম্য এবং অগ্রগতির পথ হিসেবে শিক্ষার প্রতি তাঁর নিবেদন এখনও প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়। শিক্ষার সুযোগ এবং মান বৃদ্ধির জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, আমরা কেবল আজাদের উত্তরাধিকারকে সম্মান করি না বরং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, জ্ঞানী এবং ক্ষমতায়িত ভারতের ভিত্তিও স্থাপন করি।এই দিনে, যখন আমরা শিক্ষার গভীর প্রভাব উদযাপন করছি, আসুন আমরা শিক্ষাকে সুযোগের সেতু এবং সামাজিক রূপান্তরের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি পুনর্নবীকরণ করি। সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে, শিক্ষাগত সংস্কারের পক্ষে, অথবা আমাদের স্থানীয় স্কুলগুলিতে উদ্যোগগুলিকে সমর্থন করার মাধ্যমে, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কল্পনার ভবিষ্যত গঠনে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে।




Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter