সুমাইয়্যা (রাঃ): অত্যাচারের সামনে নত না হওয়া এক সাহসিনী
কখনো কখনো ইতিহাস এমন মানুষের কথা তুলে ধরে, যারা কখনও রাজা বা সেনাপতি ছিলেন না, যাদের কাছে কোনো ধন-সম্পত্তি ছিল না তবুও তারা মানুষের হৃদয়ে সর্বদা জ্বলজ্বল করে। এর একটাই কারণ, তারা কখনও অন্যায়ের প্রতি মাথা নত করেনি। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। নিজের ওপর থেকে কখনও বিশ্বাস ছাড়েননি। ঠিক তেমনি এক সাহসী নারী ছিলেন হযরত সুমাইয়্যা (রাঃ)। তিনি কোনো রাজপ্রাসাদের রানী ছিলেন না, কোনো বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন সাধারণ নারী এবং একজন সাধারণ দাসী। তিনি এমনই এক নারী ছিলেন ,যিনি শুধুমাত্র বিশ্বাসের কারণে অসহ্য নির্যাতন কে সহ্য করেছেন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এটা বলেননি যে “আমি ভয় পেয়েছি”।
মক্কার কাফিররা যখন শুধুমাত্র মুসলমানদের ইসলাম গ্রহণের জন্য তাদের উপর নির্যাতন চালাত, তখন সুমাইয়্যা (রাঃ) ছিলেন সেই সাহসিনী, যিনি কাফিরদের অত্যাচারের দিকে একবারের মতো না ভেবে সরাসরি নিজের পুত্রসন্তান, স্বামীসহ ইসলামের আলো গ্রহণ করেন। তাকে লোহার শিকলে বাঁধা হয়, মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর উপর শুয়ানো হয়। কিন্তু তার পরেও তিনি আল্লাহর প্রতি আস্থা হারাননি, বরং সর্বদা সত্যের পতাকা কে উঁচু করে রেখেছেন। আর তার এই সাহস এবং ঈমানই তাকে ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী করে রেখেছে।
জন্মসূত্র ও পারিবারিক পরিচয়
হযরত সুমাইয়্যা (রাঃ) এমনই এক যুগে জন্মগ্রহণ করেন যে যুগে মক্কার সমাজ অন্ধকারে ডুবে ছিল, যে যুগে নারী ছিল অবহেলার পাত্র, আর দাস-দাসীরা ছিল সমাজের নীচু স্তরের মানুষ। যে যুগে নারীদেরকে কেউ মানুষ মনে করত না, দাসীদের জীবন্ত মাল-মসলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবত না, চাইলে বিক্রি করত, মারধর করত, কিন্তু এসব দৃশ্য দেখার পরেও কেউ কিছু বলত না।
হযরত সুমাইয়্যা (রাঃ) এর শৈশব শুরু হয় এক কঠিন অবস্থায়, যেখানে তিনি একজন দাসী ছিলেন। তার জীবনের শুরুটা ছিল অত্যন্ত কষ্টে ভরা। ছোটবেলা থেকেই অপরের ঘরে ঝাঁট দেওয়া, পানি টানা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া এমনকি গৃহস্থালির সব কষ্টকর কাজ তাকেই করতে হতো। তখন তিনি হযরত আবু হুযাইফা ইবনুল মুগীরা নামক এক কোরাইশি ব্যক্তির অধীনে ছিলেন ।
পরবর্তী সময়ে আবু হুযাইফা ইবনুল মুগীরা তাঁকে মুক্ত করে দেন এবং ইয়াসির (রাঃ) নামক এক ভদ্র ব্যক্তির সঙ্গে তার বিবাহ দেন। ইয়াসির (রাঃ) গরীব হলেও অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সৎচরিত্রের মানুষ ছিলেন। এরপর ইয়াসির (রাঃ) এর ঘরে জন্মনেন আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) যিনি পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ঘনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন।
সুমাইয়্যা, ইয়াসির এবং তাদের ছেলে আম্মার তারা তিনজনেই একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা সেই সাহসী মানুষ ছিলেন যারা ইসলামের শুরুর সময়ই ঈমান আনেন। তাদের পরিবারটি অত্যন্ত ভালোবাসা, একতা ও বিশ্বাসে পূর্ণছিল । তারা একে অপরের শক্তি ছিলেন। যখন কাফিররা নির্যাতন করত, তখন মা সাহস দিত ছেলেকে, আর ছেলে সাহস দিত বাবাকে।
তারা কেবল ঈমান এনেছে তা নয়, বরং তারা ঈমানের জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করেছে, নির্যাতন সহ্য করেছে এবং অবশেষে এই ঈমানের জন্যই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। হযরত সুমাইয়্যা (রাঃ) এমনই এক মা ছিলেন, যিনি সর্বদা ছেলেকে সাহসের সঙ্গে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহ দিতেন।
সাহসিনী সুমাইয়্যার হাসিমুখে আত্মত্যাগ
যখন ইসলাম পৃথিবীতে এল, যখন মক্কার বুকে একটি নতুন আহ্বান ধ্বনিত হচ্ছিল "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ", এবং রসূল (সাঃ) সবাই কে দাওয়াত দিতে শুরু করলেন, "তোমরা এক আল্লাহর উপাসনা করো, অন্য সব মূর্তিকে বাদ দাও" তখন মক্কার মানুষ খুব রেগে গেল। কিন্তু নবীজির এই কথা শুনে মক্কার বড় বড় কাফিররা ভয় পেয়ে গেল এবং বুঝতে পারল, নিশ্চয় একদিন এই নতুন ধর্ম আমাদের মিথ্যা শক্তিকে ভেঙে ফেলবে।
তাই তারা সবাইমিলে একজোট হয়ে ঠিক করল, যারা ইসলাম গ্রহণ করছে, তাদের ওপর অত্যাচার করবে। এরপর যে মানুষই ইসলাম গ্রহণ করত তারা তার প্রতি অত্যন্ত নির্যাতন চালাত। গরিব, দাস আর দুর্বল মানুষের উপর তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালাত কারণ সেই যুগে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেউ ছিল না।
এই কঠিন সময়ে, এক সাহসী নারী সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন । যার নাম হল হযরত সুমাইয়্যা (রাঃ)। তিনি একজন সাধারণ দাসী ছিলেন, কিন্তু মন থেকে ছিলেন অনেক সাহসী । তিনি সত্য কে নিজ অন্তরে অনুভব করতে পেরেছিলেন এবং বুঝেছিলেন, এই আহ্বান কোনো সাধারণ আহ্বান নয়, এটি এক স্রষ্টার প্রতি আহ্বান। সে সময় তিনি জানতেন, ইসলাম গ্রহণ করা মানে নিজের জীবনকে বিপদে ফেলা, এর সত্তেও তিনি, তাঁর স্বামী হযরত ইয়াসির (রাঃ) এবং তাঁদের ছেলে হযরত আম্মার (রাঃ) তিনজনই একসাথে ইসলামগ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণ করার কারণে কাফিররা সুমাইয়্যা (রাঃ) এর ওপর ভয়ংকর অত্যাচার শুরু করে। তারা সর্বদা তাঁকে রোদে পুড়ে যাওয়া গরম বালির ওপর শুইয়ে রাখত। শরীরে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিত, চাবুক মারত, গালাগাল দিত, মারধর করত কিন্তু এত নির্যাতন নিপীড়নের পরেও সুমাইয়্যা (রাঃ) একটি বার এর জন্য বলেননি “আমি ইসলাম ত্যাগ করছি ”।
তিনি বারবার বলতেন "আল্লাহ এক, মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল" এই কথা শুনে কাফিররা আরও রেগে যেত। একদিন কাফির নেতা আবু জাহল নিজে এসে সুমাইয়্যা (রাঃ) এর ওপর চিৎকার করতে লাগল এবং তাকে ইসলাম ছাড়ার হুমকি দিল। কিন্তু সুমাইয়্যা (রাঃ) নির্ভয়ে তাকে জবাব দিলেন, "তুই মিথ্যা বলছিস, আমার আল্লাহ সত্য"।
এই সাহসী কথা শুনে আবু জাহল অনেক বেশি রেগে গেল এবং নিজের হাতে থাকা এক বর্শা সুমাইয়্যা (রাঃ) এর পেটে দিকে ছুঁড়ে মারল। যার কারণে তিনি সঙ্গে সঙ্গে শহিদ হয়ে গেলেন । তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নারী শহিদা, যিনি নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, যারা সত্যকে কে ভালোবাসে তারা কখনও ভয় পায় না।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর দুঃখ ও সুমাইয়্যার প্রতি দোয়া
যখন হযরত সুমাইয়্যা (রাঃ) কে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, তখন রসূল (সাঃ) সেই নির্যাতন কে প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলেন। তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল। কিন্তু তিনি নিজ থেকে অনুভব করলেন, এ শুধু একজন নারী নয়, এই সাহসিনী গোটা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহিদা। এবং এই কঠিন মুহূর্তে তিনি ইয়াসির পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন:
"صبرا آل ياسر,فإن موعدكم الجنة "
"হে ইয়াসির পরিবার! ধৈর্য ধরো, নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিদান জান্নাত।"
সুমাইয়্যা (রাঃ) এর আত্মত্যাগ এতটাই পবিত্র ছিল যে, স্বয়ং রাসূল (সাঃ) জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন।
উপসংহার
ইতিহাস মানুষকে অনেক বীর ও রাজার কথা বলে, অনেক শহীদের গল্প শোনায় কিন্তু হযরত সুমাইয়্যা (রাঃ) এর মতো নারীর গল্প খুব কমই শোনায় যিনি এক দাসী হওয়ার সত্তেও হয়েছিলেন ঈমানের প্রথম শহিদা।
তিনি ছিলেন জাহেলি যুগের এক সাধারণ নারী । কিন্তু ঈমানের প্রশ্নে ছিলেন অটল ও অদ্বিতীয়। যিনি নিজের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে এক মহান মুক্তির পথ (ইসলামের পথ) গ্রহণ করেছিলেন। আর সেই পথেই তিনি নিজের জীবন কে কুরবানি করে দিয়েছিলেন এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
তিনি আমাদের শিখিয়ে যান "যার ঈমান অন্তরে শক্ত, তার শত্রু পৃথিবীর কোনো বাহিনী নয় এবং যে সত্যে বিশ্বাস রাখে, সে দুনিয়ার কোনো চাপে নত হয় না"। তিনি কাফিরদের সামনে নির্ভয়ে বলেছিলেন, "আমার মৃত্যু চাই, কিন্তু ঈমান বিক্রি নয়"। আর এটিই হল একটি মোমিনের পরিচয়, সত্যর জন্য জীবন দেওয়া কিন্তু মিথ্যার কাছে মাথা নত না হওয়া। আমরা যেন তার মতো অন্তর থেকে মুসলিম হতে পারি এবং সর্বদা সত্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি। কারণ, সত্য ও ঈমানের জন্য যারা কাঁদে, কষ্ট পায় ও অবশেষে প্রাণ দেয়, জান্নাত তাদেরই অপেক্ষায় থাকে।