মীর মোশাররফ হোসেন: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক মুসলিম অগ্রপথিক

বর্তমানে বাংলা ভাষা সাহিত্য হল পৃথিবীর উন্নতমানের ভাষা সাহিত্যেগুলির মধ্যে অন্যতম। এমনকি এই ভাষাকে আজ পুরো বিশ্ব জুড়ে ষষ্ঠতম সর্বাধিক কথিত ভাষা হিসেবে গন্য করা হয়। তবে পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও বৈচিত্রময়। এই ভাষা সাহিত্যকে মূলত হিন্দুরা অগ্রসর করলেও মুসলিমদের অবদান অতুলনীয়। যেমনকি ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেছেন, “এদেশের হিন্দুগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মদাতা বটে কিন্তু তাহার আশৈশব লালন পালনকর্তা বাংলার মুসলমান”। যে সকল মুসলিম সাহিত্যক এই ভাষা বিকাশে তিনাদের অতুলনীয় অবদান রেখেছেন তন্মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান হলেন মীর মোশাররফ হোসেন, আব্দুর রহিম, মুনশি রিয়াজুদ্দিন, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমূখ মহাব্যক্তিবর্গ।

তবে এমন অসংখ্য বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিক থাকা সত্বেও এই নিবন্ধে বিশেষ করে কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’-এর লেখক মীর মোশাররফ হোসেন প্রসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধটি সম্পূর্ণ ও সার্থক করে তুলতে বিভিন্ন গ্রহনযোগ্য গ্রন্থপঞ্জি ব্যবহার করা হয়েছে। পরিশেষে নিবন্ধটি পাঠকগণকে বিশেষ করে মুসলিমদের বাংলা সাহিত্যরসিক ও প্রেমিক করে তুলবে। ইনশাল্লাহ।  

বংশ পরিচয়

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূত মুসলিম সাহিত্যক মীর মোশারফ হোসেন ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তদানীন্তন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহুকুমার লাহিনীপাড়া গ্রামে (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায়) এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তিনার বংশগত উপাধি সৈয়দ। তিনার পিতার নাম মুয়াজ্জেম হোসেন ও মাতা দৌলাতুন নেশা। তিনি ছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দশ বছরের কনিষ্ঠ। তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর। এছাড়া কীর্তিমান সাহিত্যিক মাইকেল মধুসুদন দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তিনার সমকালীন।

শৈশব ও শিক্ষা

মোশাররফ হোসেন বাড়িতেই শিক্ষকের কাছে আরবি ও ফারসি এবং পরে পাঠশালায় বাংলা ভাষা শেখেন। তিনি কুষ্টিয়া স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন এবং পরে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি । তিনি তাঁর বাবার ভূসম্পত্তি দেখাশোনা করার জন্য কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ফরিদপুর নওয়াব এস্টেট এবং ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এস্টেটে চাকরি করেন। ১৯০৩ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতায় বসবাস করেন।

সাহিত্য চর্চা-

তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ ‘গ্রাম বার্তা’ নামে এখটি পত্রিকা সম্পদান করতেন। এছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায়ও তিনি কৌশোর হইতেই লিখতেন। এককথায় তিনি প্রারম্ভরিক কালে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদক ও সম্পাদক হিসেবে লেখালেখি করতেন। তৎপরে তিনি ভাবে ও ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ প্রণয়নপূর্বক তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিকশিত করেন। তিনি মোট ৩৫টি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। একাধারে প্রবন্ধ, উপন্যাস, প্রহসন, নাটক, জীবনি প্রভৃতিতেই সুখ্যাতি অর্জন করেন। তন্মধ্যে তিনার জনপ্রিয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’। অধিকন্তু তিনার প্রথম উপন্যাস ‘রত্নবর্তী’(১৮৬৯), প্রথম নাটক ‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩), ‘জমিদার দর্পণ’(১৮৭৩) নাটক, ‘গোজীবন’(১৮৮৯) প্রবন্ধ, ‘এর উপায় কি’(১৮৭৬) প্রহসনও বেশ কালউত্তীর্ণ হয়ে রয়েছে। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গৌরী-সেতু’ (১৮৭৩), ‘সবগীত লহরী’ (১৮৮৭), ‘বেহুলা গীতাভিনয়ে’ (১৮৮৯), ‘উদাসিন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০), ‘তাহমিনা’ (১৮৯৭), ‘তালা অভিনয়’ (১৮৯৭), ‘নিয়তি কি অবনাতি’ (১৮৮৯), ‘গাজী মিয়ার বস্তানি’ (১৮৯৯), ‘মওলুদ শরীফ’ (১৯০৩), ‘মুসলমান বাবগালা শিক্ষক’ (২ অংশ, ১৯০৩, ১৯০৮), ‘বিবি খাদেজার বিবাহ’ (১৯০৫), ‘হযরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ’ (১৯০৫), ‘মদিনার গৌরব’ (১৯০৬), ‘বাজিমত’ (১৯০৮), ‘আমার জীবন বানী’ (১৯০৮-১৯১০), ‘অমর জীবনের জীবনী বিবি কুলসুম’ (১৯১০) প্রভৃতি।

তৎসময় তিনারও অনান্য মুসলমানের মতো আরবী-ফারসী ভাষায় যথাযথ জ্ঞান ছিল। তত্রাচ তিনি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে দপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশভাষা বা মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষায় যাহার আস্হা নাই, সে মানুষ নহে”। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি একজন প্রকৃত মুসলিম বাঙ্গালি। জমিদার দর্পন সম্পর্কে বিখ্যাত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় সমালোচনা করতে গিয়ে সাহিত্য সম্রাট লিখেছিলেন, “জনৈক কতবিদ্য মুসলমান কর্তৃক এই নাটকখানি বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষায় প্রণীত হইয়াছে। মুসলমানি বাঙ্গালার চিহ্নমাত্র ইহাতে নাই। বরং অনেক হিন্দুর প্রণীত বাঙ্গালার অপেক্ষা এই মুসলমান লেখকের বাঙ্গালা পরিশুদ্ধ”।

প্রধান অবদান

উনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবর্তন হলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিগত পরিবেশ পরিবর্তন হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু সাহিত্যিকগন উন্নত মানের রস ও রুচিসম্পন্ন সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোযোগ দিলেন। অপরপক্ষে মুসলমান শিক্ষীত সমাজ তখনও আরবী-ফারসী ও পুঁথি সাহিত্যে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। রাজ্যহারা মুসলিম সমাজ তখনও পরম শত্রু ইংরেজদের সহিত আপোস করতে পারেনি। তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাকেও মনে প্রাণে গ্রহণ করেনি। ফলে সমাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল দিক থেকেই বাঙ্গালী মুসলিমের অধঃপতন ঘটে। বিলম্ব হলেও মুসলিমগনের মধ্যে যারা সমাজ সংস্কার শিক্ষা ও ধর্মীয় জাগরণের চেতনা নিয়ে সাহিত্যকর্মে অবতীর্ণ হন, মীর সাহেব হলেন তন্মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান অগ্রপথিক। বাঙালি মুসলমানের-মানসে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরক।

তাঁর পূর্বে বাংলা গদ্যে উল্লেখযোগ্য কোন মুসলিম সাহিত্যকর্ম ছিল না। তাই তো মীর সাহেবের সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে আক্ষয়কুমার মৈত্রের মন্তব্য- “মীর সাহেবের পূর্বে মুসলমান লিখিত বঙ্গ সাহিত্যে কবিতা ছিল, পড়িবার মত গদ্য ছিলনা। এখন অনেক সুখপাঠ্য গদ্য রচনা করেছন। মুসলমান গদ্য লেখকবর্গের মধ্যে এখন পর্যন্তও মীর সাহেব সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক বলিয়া পরিচিত”।

অধিকন্তু তিনি বাংলা ভাষায় মুসলিমদের মধ্য হইতে প্রথম ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। এমনকি তিনি সাময়িক পত্র-জগতে মুসলমান সম্পাদিত প্রথম সাহিত্য পত্র ‘আজীজন নেহার’(১৮৭৪) নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন।

লেখার বৈশিষ্ট্য

উনিশ শতকে মুসলিম সাহিত্য সাধনায় দুইটি ধারা পাওয়া যায়। একটি স্বাতন্ত্রধর্মী ও অন্যটি সমন্বয়ধর্মী। যিনারা সাহিত্য সৃষ্টি অপেক্ষা ইসলাম প্রচারে উৎসাহিত ছিলেন তিনাদেরকে স্বাতন্ত্রধর্মী বলা হয়। অপরপক্ষে যিনারা ছিলেন সাহিত্য বিকাশে আগ্রহী তাদেরকে সমন্বয়ধর্মী বলে অভিহিত করা হয়। মীর সাহেব ছিলেন দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত। তাই, তিনার রচিত গ্রন্থগুলি ধর্মীয় হলেও সেটি ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবেই দৃষ্টিপাত করা হয়। আর সেই উদার মানবিকতা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাঁর গ্রন্থগুলি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। অথচ জীবন, ধর্ম ইত্যাদি সম্বন্ধে তার ধারণা যে অগভীর তা নয়। মানবজীবনের জটিলতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও যথেষ্ট। ইসলাম ধর্মকথাকে সর্বজনীন সাহিত্যরসে সঞ্জীবিত করে শিল্পী তাকে রূপ দিয়েছেন। চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। 

লেখার বিষয়বস্তু

মীর সাহেবের প্রবন্ধের বিষয়বস্তু মূলত ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম ও জীবনচরিত কেন্দ্রীক। লেখক সামাজিক অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলাতা সমর্থন করতে পারেন নি। নিজের জীবনে সহজ বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে তাঁর নাটক-প্রহসনে প্রতিফলিত করেছেন। এমনকি নিজে জমিদার সন্তান হয়েও জমিদারের অত্যাচার সম্পর্কে এমন গন্থ রচানা তাঁর উদার মানবপ্রীতির পরিচায়ক। গো হত্যাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম সমাজের মধ্যে যাতে বিভেদ সৃষ্টি না হয় তার জন্য ‘গোহত্যা’ গ্রন্থে লেখক আলোকপাত করেছেন। এরই হেতু অদ্যও তিনি সকল বাঙালীর হৃদয়ের গভীরে জায়গা করে নিয়েছেন ও অমর হিসেবে গন্য হয়েছেন। মোশাররফ হোসেন তার অধিকাংশ লেখায় সমসাময়িক সমাজের মূর্খতা ও দোষ-ত্রুটিকে ব্যঙ্গ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, গাজীমিয়ার বাস্তানি গ্রন্থে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সাধারণভাবে বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি এবং বিশেষত নারীদের ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতার সমালো চনা করে ছিলেন, যা তিনি বিশ্বাস করতেন যে জীবনযাত্রার অভাবের দিকে পরিচালিত করে ।

পরকালগমন

তিনি ১৯০১ খীঃ দ্বিতীয় স্ত্রী কুলসুমের মৃত্যুর ফলে মুষড়ে পড়েন এবং তৎপর তিনি আর কিছু রচনা করতে পারেননি এবং পরিশেষে ১৯ ডিসেম্বর ১৯১২ সালে নবাবপুর,বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী হইতে এই দুনিয়া ফানিকে চিরতরে বিদায় দেন এবং পদমদীতে তিনাকে দাফন করা হয়। কিন্তু তাঁর সাহিত্য সাধনায় অতুলনীয় কৃতকার্য ও অবদান এক মূখ্য ভূমিকা পালনপূর্বক আজও তিনি বাঙ্গালিদের হৃদয় গভীরে জুড়ে রয়েছেন। সুতরাং, তাঁর সমস্ত রচনা ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করে তাঁর প্রতিভার প্রতি যোগ্য শ্রদ্ধানিবেদন সকল সাহিত্যরসিকদের কর্তব্য।

 

গ্রন্থপঞ্জি

১) ড. দেবেশ কুমার আচার্য্য, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, ১১৩ পৃষ্ঠা, কলকাতা,২০০৪খ্রীঃ

২) মাহবুবুল আলম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস,৬৪০ পৃষ্ঠা, ঢাকা, ষোড়শ সংস্করণ২০১৬খ্রীঃ

৩) ইসলামী বিশ্বকোষ, উনবিংশ খন্ড, ৩৭১ পৃষ্ঠা, ঢাকা, ১৯৯৫খ্রীঃ

৪) ড. সুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, কলকাতা, ১৯৪৩ খ্রীঃ

৫) ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, দ্বিতীয় খন্ড, কলকাতা, ১৯৬৩ খ্রীঃ

৬)ড. আনিসুজ্জামান, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, ঢাকা, ১৯৬৪খ্রীঃ

৭) ড. কাজী দীন মুহাম্মদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, ঢাকা, ১৯৬৪ খ্রীঃ

৮) বাংলা বিশ্বকোষ, ঢাকা,১৯৭৬খ্রীঃ..৪খ.,৬৩

৯) বিমল গুহ, মীর মোশাররফ হোসেন, বাংলাপিডিয়া, ইন্টারনেট তথ্য



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter