হায় রে মাধ্য়মিক !
মাধ্য়মিক, মাধ্য়মিক, মাধ্য়মিক, হায় রে মাধ্য়মিক ! দশম শ্রেণীর এই মাধ্যমিককেই বলা হয় নাকি
ছাত্রজীবনের প্রথম সর্ববৃহৎ পরীক্ষা। যারফলে আমরা ইদানিং যুগে বর্তমান সমাজকে দেখতে পাই যে, তিনারা
এই মাধ্যমিকের ফল দেখে একজন ছেলে বা মেয়েকে যাচাই করে থাকে যে, কে সফল আর কে অসফল। যদি কোনো
ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় ৯0 শতাংশ নম্বর বা প্রথম বিভাগ অর্জন করে থাকে তারাই নাকি সবচেয়ে শ্রেয় আর
যারা কম নম্বর অর্জন করে থাকে অথবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না তারাই নাকি অকার্য ছেলে । তারা নাকি
পরিশ্রমী নই, বুদ্ধিমান নই, চালাক নই, ভালো নই, তারা নাকি ভবিতব্য়ে কিছুই করতে পারবে না, কোনো চাকরি
পাবেনা, তাদের নাকি ভবিষ্য়ত অন্ধকার, জীবন নষ্ট। এমনকি সেই ছেলেটি যেই বিদ্য়ালয়ে পড়ে সেই বিদ্য়ালয়ে
ভালো শিক্ষা প্রদান করা হয় না বলে বিদ্য়ালয়টি পরিচিত হয়। ফলস্বরুপ, সেই ইস্কুলকর্তীপক্ষ সেই ছেলে বা
মেয়েটিকে ইস্কুল থেকে বিতাড়িত করে থাকে অথবা নানারকম কথা শুনিয়ে থাকে। যেই আপনার অর্জিত নম্বর
সমাজে কর্নগোচর হয় সেই শুরু হয় আপনার সমালোচনা করা। এক ছেলের সঙ্গে অপর এক ছেলের সহিত তুলনা
করে থাকে। অমুকের ছেলে বা মেয়ে পাঁচ দশ বছর থেকে নামি দামি হোস্টেলে পড়ছে, বাড়িতে বসে প্রাইভেট পড়ছে,
কোচিং নিচ্ছে ,বস্তা বস্তা বই কিনেছে , প্রতিদিন ইস্কুলে গিয়েছে তবুও সে এত কম নম্বর অর্জন করেছে
তারচেয়ে তো অমুকের ছেলে প্রতিদিন বিদ্য়ালয়ে না গিয়ে না পড়ে অত ভালো নম্বর পেয়েছে। এছাড়া অভিভাবকরাও
অতী রাগান্নিত হয়ে সেই ছেলেকে বলতে থাকেন, তোর দ্বারা আর পড়াশুনা করা হবে না বরং তুই সময় নষ্ট না করে
কোনো কাজে লেগে পড়। কম সে কম এটা তো করতে পারবি। পরিশেষে সেই ছেলে বা মেয়েটি বিষন্নতায় পড়ে এই
সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য় হয় যে, তার এই ধরনীতে বেঁচে আর কোনো লাভ নেই বরং পরকালে গমন করাটাই শ্রেয়।
এমনকি অনেকেই সত্য়িই অত্মহত্য়া করে ফেলে অথবা অধিকাংশই ছেলে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে নৃত্য়কাজকর্মে
লেগে পড়ে। যার কারনেই আজ শিক্ষার হার এত নিম্ন। এছাড়া ইদানীং সমাজে আমরা অন্য একটি কুধারণা
ভ্রূক্ষেপ করে থাকি, যদি কোনো ছেলে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে থাকে তো তাকে নাকি বিজ্ঞান বিভাগ নিয়েই
পড়াশুনা করতে হয়, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হই। কিন্তু আমার মনে কিছুদিন থেকে কয়েকটি প্রশ্ন মাথায়
ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সত্য়িই কী একজন ছেলে বা মেয়েকে মাধ্য়মিকের ফল দ্বারা যাচাই করা যায় যে ছেলে বা মেয়েটি
সফল কিংবা অসফল ? সত্য়িই কী তার জীবন, ভবিষ্য়ত নষ্ট ? ভালো নম্বর পেলেই কী সেই ছেলেটি চাকরি
অবশ্য়ই পাবে? ভালো নম্বর পেয়েছে বলেই কী তাকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশুনা করে শুধু ডাক্তার
ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে ? এই সকল প্রশ্নগুলির প্রতুত্তরে আমার মতে এটাই বলব যে “না” কক্ষনো একটি ছেলে
বা মেয়েকে মাধ্য়মিক পরীক্ষার ফল দ্বারা যাচাই করা যায় না, কক্ষনোই তার জীবন ভবিষ্য়ত নষ্ট নই, ভালো
নম্বর পেয়েছে বলেই যে তাকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশুনা করে শুধু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে এমন
কোনো কথা নেই, আর সুষ্ঠ নম্বর পেয়েছে বলেই যে সে চাকরি নিশ্চয় পাবে এমনও কোনো কথা নেই অথচ তাকে
সামনে নানারকম বাধার সম্মুখীন হয়ে সংঘর্ষ করে সামনে অগ্রসর হতে হই । সুতরাং আমরা আমাদের ছেলেদের
অর্জিত নম্বর দৃস্টিপাত না করে বরং পর্যাবেক্ষন করি যে আমার ছেলের কোন বিষয়ের উপর বিশেষ দক্ষতা বা
প্রতিভা রয়েছে। আর এটা চির সত্য় যে, সকল ছেলেরই কোনো না কোনো এক বিশেষ দক্ষতা বা প্রতিভা রয়েছেই।
চাই সেটা বিজ্ঞানে, কলাতে, আইটিতে,নেতৃত্তে, বক্তব্য় দেওয়াতে, গান সংগীত গাইতে, লেখালেখিতে, সমাজ
সেবায় কিংবা খেলাধূলোয়, যাই হোক না কেন তার যে কোনো এক বিশেষ দক্ষতা বা প্রতিভা রয়েছে এটি কিন্তু চির
সত্য়। উদাহরণস্বরুপ আমরা সুখ্য়াত শ্রুত ক্রিকেট খেলোয়াড় শচীন তেনডুলকারকে নিতে পারি। আমরা সকলেই
জানি তিনি মাধ্য়মিক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে পারেননি কিন্তু তিনি কারও কথায় কর্ণপাত না করে, সমাজের
সকল সমালোচনাকে এড়িয়ে তিনার যে দক্ষতা বা প্রতিভাকে অনুসরণ করে সামনে অগ্রসর হয়েছিলেন। যারফলে
আজ তিনার ক্রিকেট ময়দানের কৃতীত্বের জন্য় তিনি সারা বিশ্বে “মাস্টার ব্লাস্টার” নামে পরিচিত। ইদৃশ
মাইক্রোসফ্টের আবিষ্কারক বিল গেটসও ছিলেন একজন পিছু বেঞ্চের ছাত্র এমনকি তিনি কলেজ পর্যন্তও
ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি আজ বিশ্বের ধনী ব্য়াক্তীদের একজন এবং তিনার যে সকল সহপাঠী
পরীক্ষায় ভালো নম্বর নিয়ে আসত তিনাদের অনেকেই নাকি আজ তিনার কোম্পানিতে কর্মী হিসেবে কাজে
প্রবৃত্ত রয়েছেন। অতএব আমাদের উচিৎ যে আমরাও যেন আমাদের দক্ষতা অনুযায়ী ভবিষ্য়তের নিমিত্তে
নিতান্ত পরিশ্রম ও প্রয়াস করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তবেই আমরা ভবিতব্য়ে কোনো একটা কিছু করতে
পারব, হতে পারব।
এছাড়া আমি অভিভাবকদের সর্বপ্রথম আলো বা বালব আবিষ্কারক থোমাস আল্বার্ট এডিসনের জীবনে ঘটিত
সংক্ষিপ্তে গল্পাকারে এক ঘটনা বলি । যিনার কৃতীত্বের ফলে বর্তমানে সারা পৃথিবী নিশীথরাত্রীতেও
উজ্জ্বলময় হয়ে ওঠে। একদা তিনি যখন বিদ্য়ালয়ে শিক্ষা অর্জন করতেন সেই ইস্কুলের শিক্ষক তিনার হাত
দ্বারা একদিন এক চিঠি লিখে পাঠালেন এবং বললেন যে এটি তোমার আম্মুকে দিয়ে দিবে। তিনি তিনার শিক্ষকের
কথা অনুযায়ী তিনার জননীকে চিঠিটি দিয়ে দিলেন এবং দেখার শেষে তিনার মা তিনাকে বললেন যে, হে আমার প্রিয়
পুত্র! তোমাকে আর আজ থেকে বিদ্য়ালয়ে যেতে হবে না। সেই সময় তিনি তিনার মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন মা
আজ থেকে আমি আর বিদ্য়ালয়ে যাব না? তখন তিনার মা উত্তর দিলেন, কেননা তোমাকে পড়ানোর জন্য়
বিদ্য়ালয়ে কোনো যোগ্য় শিক্ষক নেই আর তুমি আজ থেকে আমার নিকটেই পড়াশুনা করবে। কিন্তু যখন তিনি
বড়ো হয়ে সেই চিঠিটি খুলে দেখেন সেইসময় তিনি বুদ্ধিভ্রষ্টের মত কাঠ হয়ে চিঠিটির দিকে চাহিয়া ছিলেন কেননা
সেই চিঠিটিতে এটা লেখা ছিল যে, আপনার ছেলে বিদ্য়ালয়ে এতটাই দুষ্টিমি করে যে আমরা আর তাকে বাগে আনতে
পারছি না। সুতরাং আপনার ছেলেকে আগামীকাল থেকে আর বিদ্য়ালয়ে পাঠাবেন না। তাহলে দেখুন তিনার মা পুত্রের
সহিত কেমন আচরণ করে ছিলেন, কীভাবে তিনার পুত্রকে উৎসাহিত করেছিলেন কিন্তু আজ আমরা পরীক্ষার
ফল যদি ভালো না হয় তাহলে তাকে কতোই না তিরস্কার করে থাকি। আপনি তাকে আপনার ইচ্ছা মত পড়াতে বাধ্য়
করেন তাকে তার দক্ষতা বা লক্ষ্য় অনুযয়ী এগোতে দেননা। পরিশেষে সেই ছেলে বা মেয়েটি বিষন্নতায় পড়ে এই
সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য় হয় যে, তার আর এই ধরনীতে বেঁচে আর কোনো লাভ নেই বরং পরকালে গমন করাটাই শ্রেয়।
এমনকি অনেকেই সত্য়িই অত্মহত্য়া করে ফেলে ।এই প্রসঙ্গে ভারতীয় সহজসরল ইংরেজি ভাষার লেখক চেতন
ভাগতের রচিত উপন্য়াস “Five Point someone” এবং “Revolution 2020” বই দুইটিতে বিস্তারিত উল্লেখিত
রয়েছে। প্রথম পুস্তকটিতে তিনি আরও বলেন,যে কোনো শিক্ষার্থীই সিলেবাসকে হৃদয়ঙ্গম করে তোতাপাখির
ন্য়ায় ঠোটস্থ করে পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করতেই পারে অথবা ভালো ফল নিয়ে আসতেই পারে কিন্তু
তার মানে নয় যে সে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। হতে পারে তোমার এই পরীক্ষার ফলের প্রদর্শন তোমাকে একটি
ভালো চাকরি দিতে পারে কিন্তু তদাপেক্ষা তোমার পরিবার,তোমার বন্ধু, তোমার অন্তরের ইচছা আকাঙ্খা এবং
লক্ষই হল অধিক উত্তম। এই জীবনটি হল অতি অল্প সময়ের ক্ষণিকের জন্য় অতএব আমাদের এই জীবনটিকে
আনন্দে উপভোগ করা উচিৎ।
আমরা যেন কক্ষনো দুঃখিত, সন্তাপ না হই,মন মরা না হই বরঞ্চ আমাদের দক্ষতাকে লক্ষ্য় করে সামনে
অগ্রসর হতে থাকি। কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা বলছেন:”তোমরা হতাশ হয়োও না দুঃখিত হয়োও না, তোমরাই
জয়ী হবে যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও” (সূরা আল-ইমরান:১৪১)। যদি সত্য়িই মাধ্য়মিক জীবনের প্রথম বড়ো
পরীক্ষা হয়ে থাকে তবে আমি বলব যে উচ্চমাধ্য়মিক আমাদের জীবনের দ্বিতীয় বড়ো পরীক্ষা। এই প্রসঙ্গে
সর্বপ্রথম টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজেন্দার গ্রাহামবেল বলেন: “When one door is closes,
another open” সুতরাং আমরা যেন প্রথম ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয়টির নিমিত্তে কঠর পরিশ্রম ও
অতিশয় প্রয়াস করি ও ভগবানের উপর বিশ্বাস রেখে জীবনে সফল হই। কেননা বাংলাই একটি প্রবাদ পরিচলিত
রয়েছে যে “ ভাগ্য়বানের বোঝা ভগবানই বয়”। যদি কোনো এক ব্য়াক্তি কোনো কাজে সফলতা অর্জন করে, চাই
হোক সেটা পরীক্ষা কিংবা চাকরি অথবা অনান্য় কিছুতে, তখন কিন্তু আমরা এটাই বলি যে, ছেলে বা মেয়েটি কত
ভাগ্য়বান। এমনকি পবিত্র কুরআন শরীফেও উল্লেখিত রয়েছে “ যে ব্য়াক্তি আল্লহর উপর ভরসা করে তার
জন্য় তিনিই যথেষ্ট ”।(সূরা ত্বলাক: ১৩)
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে মাধ্য়মিক : ইদানীং যুগে বর্তমান সমাজ এই মাধ্য়মিক পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হওয়া মানেই
ফাতহান মুবিনা বা আযিমা (বৃহৎ জয়)বলে মনে করছে কিন্তু আমরা আজ পার্থিব জীবনকে প্রধান্য় দিতে গিয়ে
ভূলতে চলেছি এই ধরণীটি প্রকৃতপক্ষে কী, ভূলতে চলেছি মহান আল্লাহ তায়ালা কী উদ্দেশ্য়ে আমাদের এই ভূবনে
পাঠিয়েছেন, ভূলতে চলেছি সেই আখিরাতের দিবসকে, যেই দিন কেউ কাওকে চিনবে না এমনকি মা ছেলেকে চিনবে না
ছেলে মাকে চিনবে না, ভাই বোনকে চিনবে না মোদ্দাকথায় কেউ কাওকে চিনবে না সকলেই নাফসি নাফসি করতে
থাকবে। এই রংবেরঙ্গে সুসজ্জিত পৃথিবী হল কেবল একটি রঙ্গমঞ্চ, মরীচিকা, মায়াজাল। এই পৃথিবীই তো হল
প্রকৃত পরীক্ষাগার। সেই দিন যখন আমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে, আমাদের জীবনকে কোন পথে ব্য়ায় করেছি?
সেই দিন আমরা এই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত এক চুল পরিমানও নড়তে পারব না। সেই দিন আমাদের
এই সকল সার্টিফিকেট, ডিগ্রী, ডিপ্লমা, কোর্স কিছুই কাজে আসবে না কেবলমাত্র আমাদের সলিহ
আমলগুলিই গ্রাহ্য় করা হবে। সুতরাং এই পার্থিব জীবনকে পেতে গিয়ে যেন আমরা আখিরাতকে ভুলে না যায়।