বিশ্ব পরিবেশ দিবস
“দাও ফিরে সে অরণ্য়, লও এ নগর,
লও যত লৌহ,লোষ্ট্র,কাষ্ঠ ও প্রস্তর।
হে নব্য় সভ্য়তা,হে নিষ্ঠূর সর্বগ্রাসী,
দাও ফিরে তপোবন,পুণ্য়চ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন অতীতের দিনগুলি।”
পরিবেশকে ইংরেজি ভাষায় Environment বলা হয় যেই শব্দের উৎপত্তি হল একটি ফরাসি শব্দ Environer
/ Environner থেকে যার অর্থ হল "প্রতিবেশী"। অতএব আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে; যেমন- আকাশ-
বাতাস, জলস্থল, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, উদ্ভিদপ্রাণী, গাছপালা, নদীনালা, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়পর্বত,
মরুভূমি, হ্রদ, পুকুর, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, যানবাহন, কলকারখানা ইত্যাদি উপাদান নিয়ে গঠিত আমাদের এই
পরিবেশ। এগুলো সবই মহান আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত। বিশেষ করে জল, স্থল, বায়ু এই তিনটি পরিবেশের
নিতান্ত অপরিহার্য উপাদান। পরিবেশের এই উপাদানগুলির সহিত মানব জীবনের সম্পর্ক অতি নিবিড়।
কেবলমাত্র সুস্থ পরিবেশেই সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। কিন্তু আজ এই সকল উপাদানই দূষিত।
কিন্তু কেন আজ পরিবেশ এত দূষিত ? এর উত্তর আমরা মহাগ্রন্থ কুরআন থেকেই পেয়ে থাকি। আল্লহ
তায়ালা বলছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলেই সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে’ (সূরা আর রুম : ৪১)।
আর এটিই তো প্রকৃতপক্ষে সত্য়ি,আমাদের নিত্য় কাজকর্মের দরুণ তো এমনটি হয়েছে। আমরা আজ
নিজেদের চাহিদা মেটাতে বনজঙ্গলকে উজাড় করে দিচ্ছি, জমিক্ষেতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক
সার,কীটনাশক দ্রব্য়াদির প্রয়োগ করছি, কলকারখানার নোংরা জল নদীনালায় ফেলছি, বাজিপটকা
বিস্ফোরন করছি, যানবাহন চালিয়ে ক্ষতিকারক গ্য়াস NOx, কার্বন নির্গমন করছি এছাড়াও আমাদের
ফ্রিজ/রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশন (AC) ব্য়বহারের ফলে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC) অতিমাত্রায়
বেড়ে চলেছে যেটি ওজোন স্তরের ক্ষতির জন্য দায়ী। এইসব কৃতকর্মের ফলে আমরা আজ নানা রোগে
জর্জরিত যেমন- যক্ষা, হাপানি, শ্বাসরোগ, ক্য়ানসার,বিভিন্ন চর্মরোগ, ইমফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, জন্ডিস,
রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ ইত্য়াদি ইত্য়াদি। তাছাড়া অম্ল বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে ও জমির উৎপাদন হ্রাস
পাচ্ছে, মৎস ও জলচর প্রাণীরা মারা যাচ্ছে, আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে ইত্য়াদি।
কিন্তু আজ মানুষ বুছতে পেরেছে যে,পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কেবল মানুষই, সুতরাং আত্ম-বিলুপ্তির হাত
থেকে রক্ষা পাওয়ার সমস্ত ব্য়বস্থাই তাদেরই গ্রহন করতে হবে। তাই তারা আজ এই দূষিত পরিবেশকে
রক্ষার নিমিত্তে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন; বিশ্ব পরিবেশ দিবস,পৃথিবী দিবস, বনমহাউৎসব ইত্য়াদি
ইত্য়াদি। এর মধ্যে সারা বিশ্বে একটি ব্যাপক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান বা উদ্য়েগ হল এই "বিশ্ব পরিবেশ দিবস"
বা "ইকো দিবস"। এটি সর্বপ্রথম 5ই জুন 1972 সালে স্টকহোম, সুইডেনে উদযাপিত করা হয় যার নেতৃত্বে
ছিল জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এবং এর থিম ছিল “Only One Earth”(একটিই মাত্র পৃথিবী)।
এই অনুষ্ঠানে বহু দেশ এমনকি ভারতও উপস্থিত ছিল। সেই সময় থেকে এটি প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে
উদযাপন করে চলেছে।
এই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ৫১তম বার্ষিকী হিসেবে পালিত হচ্ছে।
নেদারল্যান্ডসের সাথে অংশীদারিত্বে Côte d'Ivoire (কোট ডি আইভরি) দেশটি এই বছরের বিশ্ব পরিবেশ
দিবস অনুষ্ঠানটি নেতৃত্ব দেবেন। অর্থাৎ যেই দেশটিকে আমরা আজ মানচিত্রে আফ্রিকা মহাদেশের
Ivory coast (আইভরি কোস্ট) নামে ঠাহর করে থাকি। এই বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবস থিম “Solutions to
plastic pollution”। যেটি প্লাস্টিক দূষণের সমাধানগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, কারণ প্লাস্টিক
আমাদের গ্রহের দীর্ঘায়ুকে হুমকি দেয়৷
বিগত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ৫০তম বার্ষিকী হিসাবে উদযাপন করা হয়েছিল
এটিকে স্টকহোম+৫০ নামেও উল্লেখ করা হয়েছিল। এটি ছিল জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)-এর
পাঁচ দশক ছিল তাই, প্রথমবারের মতো একই থিম (“অনলি ওয়ান আর্থ”) রাখা হয়েছিল এবং এটি প্রথম
দেশের মতো একই দেশ (সুইডেন) দ্বারা আয়োজন করা হয়েছিল।
পরিবেশকে রক্ষার নিমিত্তে অন্য়তম আরও একটি উদ্য়েগ হল বনমহাউৎসব যেটি সর্বপ্রথম ১৯৫০
খ্রিস্টাব্দে পালিত করা হয়। সরকারি আনুকুল্য়ে ও সহযোগিতায় আজ তা সাধারণের উৎসবে পরিণত
হয়েছে। এই উপলক্ষে বিমামুল্য়ে নানারকম বৃক্ষের চারা বিতরণ করা হয়। তাছাড়া সরকার নতুন নতুন
বানাঞ্চল সৃষ্টির উদ্য়েগ নিয়েছেন। সমাজভিত্তিক বন সৃজন প্রকল্প যথেষ্ট কার্যকরী হয়েছে। কোনো
কোনো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও বৃক্ষ রোপণের কাজে এগিয়ে এসেছে।
এছাড়াও স্ট্রাটোস্ফেয়ারের ওজোন স্তর আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই সহায়ক কারণ এটি সূর্য থেকে
নির্গম অতিবেগুনি (UV) রশ্মিকে শোষণ করে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে বাধা দেয় এবং ধরিণীকে রক্ষা করে।
কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে আজ এই ওজোন স্তরও ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলস্বরুপ, বিশ্ব
উষ্ণায়ন ঘটছে এবং আবহাওয়াকে উৎপাত করে তুলছে,বরফ-হিমবাহ গলতে শুরু করেছে সমুদ্রের জল বৃদ্ধি
পাচ্ছে যা ভবিষ্য়তের জন্য অতিশয় ক্ষতিকারক। এর জন্য়েও জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)
নতুন এক উদ্য়েগ নিয়েছে যেটি Conference of Parties (COP) বলে পরিচিত। ২০২৩ সালের এই অনুষ্ঠানটি
28তম তাই এটির নাম COP28 দেওয়া হয়েছে। এই বছর এটি সংযুক্ত আরব আমিরশাহি(UAE) তে
অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
পরিশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মহাবিশ্বে কোটি কোটি ছায়াপথ আছে, আমাদের আকাশগঙ্গা
ছায়াপথে কোটি কোটি গ্রহ আছে কিন্তু পৃথিবী আছে কেবলমাত্র একটিই। সুতরাং আমরা যেন আজ থেকে
পরিবশ দূষণ সম্পর্কে আরও সচেতন হই এবং প্রতিজ্ঞা নিই যে, আমি একজন পরিবেশবাদী অর্থাৎ এই
পৃথিবীকে রক্ষার জন্য় আমি আমার যথাসাধ্য় চেষ্টা করব এবং এর সঙ্গে সকলকে পরিবেশ দূষণ প্রসঙ্গে
অবগত করাব।