প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উপকরণ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশিকা
যে সমস্ত পরিবেশের অবিভেদ্য উপাদান বা প্রাকতিক সম্পদ রয়েছে সেগুলির প্রসঙ্গে ইসলাম কতটা গুরুত্ব দিয়েছে তা নিম্নে উল্লেখিত করা হল।
জল সংরক্ষন : পরিবেশের দুইটি মূখ্য উপাদান হল জল ও বৃক্ষ যে দুইটি ব্যতীত পৃথিবীর সকল প্রাণী মৃত্যুর শয্যায় ঢলে পড়বে। তাই, প্রারম্ভ থেকেই ইসলাম সেই দিকে লক্ষ্য রেখেছে এবং ফলাফলে একাধিক আয়াত ও হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ৬০ জায়গায় জল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। এমনকি আল্লাহ তায়ালা সমস্ত কিছুকে সৃষ্টি করেছেন সেই জল দ্বারায়। যেমনকি তিনি বলেন, “প্রানবান সবকিছু পানি হতে সৃষ্টি করেছি”।(সুরা আম্বিয়া-৩০) অতএব, এই জল কতই না গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেই জলকেই সংরক্ষনের জন্য কুরআনে ঘোষনা দেওয়া হয়েছে যে "... খাও ও পান করো, কিন্তু অপচয় করো না; নিশ্চয়ই তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না" (আনআম-১৪১)। অন্য জায়গায় তিনি আবারও বলছেন, নিশ্চয় যারা অপব্যায় করে তারা শয়তানের ভাই...(সূরা ইসরা-২৭)। তিনি জলসঙ্কটকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, বলো, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কী, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভে চলে যায়, তাহলে কে তোমাদের বহমান পানি এনে দিবে’? (সূরা মূলক:৩০)। এমনকি নবী (সাঃ)ও বলছেন, “তোমরা প্রয়োজনের অধিক পানি ব্যবহার করবে না। যদিও তোমরা বহমান নদীর তীরে থাকো।“(বুখারী) তিনি আবারও সতর্ক করে ইরশাদ করছেন যে, “আবদ্ধ পানি ও জলাশয়ের পানিতে তোমরা প্রস্রাব করবে না। প্রস্রাব করে তোমরা পানিকে দূষিত করে সেখানে আবার গোসল করবে না”।(মুসলিম শরিফ-৪২৪)
বৃক্ষ সংরক্ষন : এছাড়া পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে ২৫ ভাগ বৃক্ষ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা একান্ত প্রয়োজন। তাই ইসলাম এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষন ও বৃক্ষ রোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে কালজয়ী নির্দেশনা প্রদান করেছে। যেমনকি পরিবেশের সামাঞ্জস্যপূর্ণে গাছ লাগানোর শিক্ষা আমরা মহানবি (সা.)-এর হাদিস থেকেই পাই। তিনি বলেছেন, “যদি তুমি নিশ্চিত জানো যে, কিয়ামত আসন্ন আর তখন হাতে যদি একটি গাছের চারাও থাকে তবে তা রোপন করো”। (মুসনাদে আহমাদ-১২৯৮১) এমনকি গাছপালা সংরক্ষণের নির্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে নবিজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন’ (আবু দাউদ : ৫২৪১, বায়হাকী : ৬/১৪০)। তাছাড়াও অন্য একটি হাদিসে রাসূল (সাঃ) এক অমুল্য বাণী বর্নিত রয়েছে যে, কোনো এক ব্যক্তি যখন অকারণে একটি গাছের ডাল ভাঙে, তখন নবী করিম (সা.) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বলেন, তুমি যেমন শরীরে আঘাত পেলে ব্যথা পাও, গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়। তিনি বৃক্ষরোপন করতে আরও উৎসাহিত দিয়ে বলেছেন যে “বৃক্ষরোপণের পর যতদিন পর্যন্ত মানুষ ও জীবজন্তু ওই বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত ফল ভোগ করবে, ছায়া পাবে, ততদিন পর্যন্ত রোপণকারীর আমলনামায় সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব লেখা হতে থাকবে”। (সহিহ বোখারি : ২১৫২)
পশু ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষন: এছাড়াও বর্তমানে যে অজ্রস্য উদ্ভিদপ্রানী, পশুপাখি, জীবজন্তু নিয়ে যে জীববৈচিত্র্য রয়েছে, তন্মধ্যে কারোর যেন কখনোই আমদের কর্মকান্ডের ফলে ক্ষতি ও বিলুপ্তি না হয় সেই সম্পর্কেও কুরআন ও হাদিশে যথাযথভাবে বলা হয়েছে। যেহেতু সেগুলিও আমাদের সুষ্ঠ পরিবেশের এক অন্যতম অঙ্গ। কিন্তু আমাদের কৃতকার্যের ফলে আজ তাদেরও শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সাথে পাশবিক আচরন করা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় খাদ্য ব্যতীত নিজস্ব সুবিধার্থের উদ্দেশ্যে শিকার করে তাদের অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে অথচ তাদেরও রয়েছে এই ধরিত্রীতে বসবাস করার অধিকার। সেই কারণেই তো ইসলাম অহর্নিশি এই সম্পর্কে সতর্ক করে আসছে। যেমনকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলছেন, “কোনো জীবকে লক্ষ্য বস্তু হিসেবে গ্রহণ করো না” (সহিহ মুসলিম)। অন্যত্রে তিনি আবারও বলেন, 'যে ব্যক্তি ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া চড়ুই পাখি বা এর চেয়ে বড় কিছু হত্যা করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে জবাবদিহি করবেন। শ্রোতারা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল, ন্যায়সঙ্গত কারণ কী? তিনি বললেন, "সে যেন একে খাওয়ার জন্য হত্যা করবে, শুধু এর মাথা কেটে ফেলে দেবে না ' (সুনান নাসাঈ)। অর্থাৎ, হাদিসটিতে বোঝানো হচ্ছে যে তোমরা কেবল প্রানীদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য যবেহ করবে এবং অযথা বা ক্রিয়াচ্ছলে বা নিজস্ব উপকারের জন্য তাদের হত্যা করবে না। এছাড়াও ইসলামে তাদের সংরক্ষনের জন্য এতই গুরত্ব দেওয়া হয়েছে যে বাছুর, মৌমাছি, মাকড়সা এবং পিঁপড়ার মতো প্রাণীর নামে মহাগ্রন্থ কুরআনের বেশ কয়েকটি অধ্যায় বা সূরা অবতীর্ণ হয়েছে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সুষ্ঠ সুন্দর পরিবেশ
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সুষ্ঠ সুন্দর পরিবেশের প্রথম বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব বোঝাতে কুরআনে বলা হচ্ছে যে, “নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং পবিত্রকারীদেরও ভালোবেসে থাকেন”।(২:২২২) এবং অন্যত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আল্লাহ পবিত্র, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। অতএব, যেখানে তোমরা বাস কর সেখানে পরিচ্ছন্ন রাখো"।(মুহাম্মাদ ইবনে হাসান শাইবানী, আল-জামে আল-সাগীর, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা পৃ ২৬৭) অন্য এক বর্ণনায় প্রিয় নবি (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের আঙিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখ”। (জামিউত তিরমিজি : ২৭৯৯)। আরও একটি হাদিসে নবিজি (সা.) এরশাদ করেছেন, “পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ”। (সহিহ মুসলিম : ২২৩)। তিনি আরও বলেছেন, “পবিত্রতা ইমানের অর্ধাংশ”।
উপসংহার
সুতরাং, উপরুক্ত আয়াত ও হাদিশগুলি হতে দ্যার্থহীনভাবে বলা হচ্ছে যে তোমরা জল, বৃক্ষ, পশুপাখি, জীবজন্তু বিনাশ করো না বরং তোমরা সেগুলি সংরক্ষন করো। যেহুতু সেগুলি পরিবেশের অত্যন্ত অপরিহার্য প্রাকৃতিক সম্পদ ও উপাদান। এছাড়াও বোঝা গেল যে, ইসলাম স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তুলতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর তীব্রভাবে তাগিদ দিয়েছে। তাই তো বলা হয় ইসলাম ধর্ম মানেই দুনিয়াই শান্তি ও পরকালীন মুক্তি।
অতঃপর, মনে রাখতে হবে মানুষের কৃতকার্যের ফলেই আল্লাহর সৃষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ ও উপাদানগুলির উপর নিখুঁত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সুতরাং, আমাদের মৌলিক কর্তব্য হল যে, আল্লাহর একাত্ববাদের প্রচার করার সাথে সাথে তিনার নিখুঁতভাবে তৈরি এই বসুন্ধরাকে সঠিকভাবে সংরক্ষন করি, যেহেতু আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেই তিনার প্রতিনিধি হিসেবে এই পৃথিবীতে প্রেরন করেছেন।
পরিশেষে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, মহাবিশ্বে কোটি কোটি ছায়াপথ রয়েছে তন্মধ্যে রয়েছে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ আবার তাতে রয়েছে কোটি কোটি গ্রহ কিন্তু পৃথিবী রয়েছে কেবলমাত্র একটিই এবং আমাদের বাঁচাটাই শেষ বাঁচা নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই বসুন্ধরাটা বাসযোগ্য করে যেতে হবে। যেহেতু এই পৃথিবীতে বাসস্থানের অধিকার সকলের। সুতরাং, আমরা যেন আজ থেকে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে পূর্বের চাইতেও অধিক সচেতন হই এবং প্রতিজ্ঞা নিই, এই পৃথিবীকে রক্ষার জন্য আমারা আমাদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাব এবং সকলকে পরিবেশ দূষণ প্রসঙ্গে অবগত করাব ও নিতান্ত পরিমানে গাছ লাগাতে, বর্জ্য হ্রাস করতে এবং দূষণ বন্ধ করতে অনুপ্রাণিত করব ও ফলাফলে জাগিয়ে তুলব নব্য প্রানে একবিংশ শতাব্দীর এক সুষ্ঠ পরিবেশ।