শ্রম ও শ্রমিক: ইসলামের আলোকে একটি মানবতাবাদী মূল্যায়ন
কর্মহীনতা, বেকারত্ব ও কর্মবিমুখতা গোটা মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চাইলে একমাত্র বিকল্প পথ হলো শ্রম। যখন সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি বেকারত্ব ও অলসতার বন্ধন ছিন্ন করে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে, তখনই সে তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। অন্যথায় তা হবে ‘উলুবনে মুক্তা ছড়ানো’র মতোই অর্থহীন।
একবিংশ শতাব্দীর সূচনায় দাঁড়িয়ে আমরা এমন এক বিষয় নিয়ে কথা বলছি—যেখানে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদ, যেমন সমাজতন্ত্র বা ধনতন্ত্র, সফলতার সাক্ষ্য রাখতে পারেনি। ধনতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী ১৮১৯ সালে ৫০০ শ্রমিকের একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়। অথচ তারাই আবার মানবাধিকারের বাণী তুলে ধরতে দ্বিধা করে না। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের অনুসারীরা সমানাধিকারের স্লোগান দিলেও বাস্তবে দুঃস্থ শ্রমিকদের ব্যবহার করে নিজেরাই সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে।
বিপরীতে, ইসলামই একমাত্র মতবাদ—যা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছে: “প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দাও।” ইসলাম বলে, যে ব্যক্তি নিজের অধিকার আদায়ের পথে প্রাণ হারায়, সে শহীদের মর্যাদা পায়।
শ্রমিকের অধিকার প্রসঙ্গে ইসলাম আরও বলেছে: শ্রমিকের সাথে করা চুক্তি পূরণ করো। কাজ শেষ হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করো। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন: ثَلَاثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ القِيَامَةِ:... وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ
“কেয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেব। তাদের একজন সেই ব্যক্তি, যে একজন শ্রমিককে নিয়োগ করে তার থেকে কাজ আদায় করে নেয়, অথচ তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেয় না।”
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: مَطْلُ الْغَنِيِّ ظُلْمٌ
“অহেতুক বিলম্ব করে শ্রমিকের পারিশ্রমিক না দেওয়া জুলুম।” – (মুসলিম)
শ্রমিক যেন চিরকাল শ্রমিক না থাকে, সে উদ্দেশ্যে ইসলাম শ্রমিককে মালিকের সঙ্গে যৌথ ব্যবসার সুযোগ দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই ‘শ্রম’ শব্দটির অর্থ বুঝতে হবে। কায়িক কিংবা মানসিক—যে পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করা হয়, তাকেই শ্রম বলা হয়।
শ্রম একটি গতিশীল ও সক্রিয় উপাদান। শ্রমিককে তার সামাজিক অধিকার দিতে হবে এবং তাকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। যেমন রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় অধিকার রয়েছে, তেমনি শ্রমিকেরও আছে।
খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান ও বিশ্রামের মতো মৌলিক অধিকার থেকে যুগে যুগে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছে শ্রমিক শ্রেণি। জাহেলী যুগ থেকে আজও শ্রমিকদের উপর চলে আসছে নির্যাতন। বিশেষ করে ১লা মে’র করুণ ইতিহাস মনে পড়লে আজও আমাদের গা শিউরে ওঠে। সেই দিন শ্রমিকরা যখন রাজপথে নেমেছিল, তাদেরকে পিষে মারা হয়েছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো—যারা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দেয়, তারাও শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে আগ্রহী নয়। বরং তারা কম মজুরিতে অধিক পরিমাণে শ্রম আদায়ের মাধ্যমে নিজ স্বার্থে তা বজায় রাখে। এই সত্য খুব সহজে উপলব্ধি করা যায় শিল্পনগরীর শ্রমিক কলোনি ও ধনিক শ্রেণির প্রাসাদোপম বাসভবনের পার্থক্য দেখে।
শ্রমিকদের দুইভাবে শোষণ করা হয়:
১. শ্রমের যথার্থ মূল্য না দিয়ে কম মজুরি দেওয়া।
২. স্বল্প মজুরিতে অতিরিক্ত কাজ করানো।
ইসলামে “শ্রমিক” এবং “অফিসার” নামে কোনো শ্রেণিবিভাজন নেই। ইসলামী সমাজে প্রত্যেকেই শ্রমিক, এবং সকলের অধিকার সমান।
ইসলাম মানবাধিকারের প্রতিটি দিককে বিবেচনায় নিয়ে সকল শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামই একমাত্র মতবাদ যেখানে মুচি, ধোপা, কামার, কুলি বা সুইপারদেরকেও সম্মানের চোখে দেখা হয়েছে।
“إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ”
অর্থ: “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই, যে সর্বাধিক মুত্তাকী।” – সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩
সুতরাং কারো পেশা নয়, বরং তার খোদাভীরুতা শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড। কবি নজরুলের ভাষায়—
“জাতিতে জাতিতে মানুষে মানুষে এ অভেদ জ্ঞান,
অভেদ আহাদ মন্ত্রে টুটিবে সকলে হইবে এক সমান।”
শ্রমিক যেই শ্রেণির হোক না কেন, মানুষের মর্যাদার প্রশ্নে সে সমান। উৎপাদনে পুঁজির চেয়ে শ্রমের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। কিন্তু বারবার শ্রমিকরা তাদের সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আজকের আধুনিক যুগেও অনেক শিক্ষিত মানুষ শ্রমকে তুচ্ছজ্ঞান করে।
ইসলাম এই কৃত্রিম শ্রেণিবিভাজনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِي ذَرٍ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِخْوَانُكُمْ جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ فَمَنْ جَعَلَ اللَّهُ أَخَاهُ تَحْتَ يَدِيْهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبِسُ وَلَا يُكَلِّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَا يَغْلِبُهُ فَإِنْ كَلَّفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ.
“তোমাদের ভাইদের আল্লাহ তোমাদের অধীন করেছেন, সুতরাং তোমরা যেমন খাও, তাদেরও তাই খাওয়াও; যেমন পরো, তাদেরও তাই পরাও; তাদের এমন কোনো কাজে নিযুক্ত করো না যা তাদের শক্তির বাইরে। যদি করো, তবে তাদের সাহায্য করো।” – (বুখারী, মুসলিম)
একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারীর সঙ্গে মুসাফাহা করে দেখলেন, তার হাত শক্ত ও খসখসে। জিজ্ঞেস করলেন কেন এমন? সাহাবি বললেন, আমি হাত দিয়ে কাজ করে খাই। নবীজি তখন বললেন:
“আসমানের নিচে জমিনের ওপর এই হাতের চেয়ে উত্তম কোনো হাত নেই।”
ইসলাম এইভাবে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকারকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করেছে। অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদ এতটা সম্মান দিতে পারেনি। আজও পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে প্রাসাদ তৈরি হয়।
তাদের এই নির্মমতা রুখে দিতে হলে ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শ্রমিকদের প্রকৃত মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
তাই আসুন, ইসলামকে জানি, ইসলাম অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন হই।
শেষে কবির ভাষায় বলি:
“শোনরে মানিক, শোনরে মজুতদার,
তোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত মানুষের হাড়,
হিসেব দিবি কি তার?”