২৫ মে: বিদ্রোহের ছন্দে সাহস ও স্বপ্নের জাগরণ

বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু নাম আছে, যাদের কথা উচ্চারণ করলেই বাঙালির হৃদয় গর্বে ভরে ওঠে। তাঁদের কৃতিত্ব, ত্যাগ ও সৃষ্টি যুগের সীমা ছাড়িয়ে এসে আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়। তেমনি একজন মহামানব হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ২৫ মে, অর্থাৎ ১১ই জ্যৈষ্ঠ, তাঁর জন্মদিন—নজরুল জয়ন্তী। এদিন কেবল একটি স্মরণ দিবস নয়, বরং একটি চেতনার উৎসব, একটি সাহস ও স্বপ্নের জাগরণ। এই দিনে আমরা কেবল একজন কবিকে স্মরণ করি না, বরং এক বিপ্লব, এক ভাবনা, এক মুক্তির আন্দোলনকে স্মরণ করি।

জন্ম ও শৈশব: সংগ্রামের শুরু:

১৮৯৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেন নজরুল। পরিবার ছিল দরিদ্র, বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ, পেশায় ছিলেন মসজিদের ইমাম। ছোটবেলাতেই পিতৃহীন হন নজরুল। জীবনের কঠোর বাস্তবতার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে অতি অল্প বয়সেই। কখনও লেটো গানের দলে গান গেয়ে, কখনও মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করে, কখনও আবার রুটির দোকানে দিনমজুরি করে তিনি টিকে ছিলেন। এই শৈশব-যন্ত্রণা তাঁকে নির্মাণ করেছিল এক ভিন্নধর্মী সৃষ্টিশীলতায়। নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কবিতা, গান, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ — সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তিনি অনন্য। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন:

"বল বীর—চির-উন্নত মম শির!"

এই একটি কবিতা বাংলা জাতিকে চিনিয়ে দেয় এক নতুন সাহসের সঙ্গে, এক নতুন ভাষায়। তাঁর লেখায় ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সব মানুষের মুক্তির আহ্বান ছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন বিদ্রোহ তাঁর কলমে ছিল বারবার। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বিখ্যাত ও শক্তিশালী একটি কবিতা। কবিতার প্রতিটি শব্দ যেমন গভীর অর্থ বহন করে, তেমনি এটি আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। এই কবিতার ভাষা, ছন্দ, ভাব ও আবেগ এতই সুন্দর ও প্রাণবন্ত যে, এটি যুগে যুগে পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। তাই বলা যায়, এই কবিতা বাংলা সাহিত্যের একটি স্থায়ী ও অমূল্য সম্পদ।

এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর নজরুল ইসলাম এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হন। তিনি আগেও জনপ্রিয় ছিলেন, তবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর তার খ্যাতি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এই কবিতাটি এমন এক শক্তি নিয়ে আসে যা মানুষকে সাহসী করে তোলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উৎসাহ দেয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের আগে বাংলা সাহিত্যে এ রকম তীব্র প্রতিবাদী স্বরের কবিতা দেখা যায়নি। এই কবিতার মাধ্যমে নজরুল শুধু একজন কবি হিসেবে নয়, একজন সাহসী মানুষ হিসেবেও আমাদের সামনে আবির্ভূত হন। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছেন, মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে নানা পৌরাণিক চরিত্র, প্রাকৃতিক শক্তি এবং নানান সাহসী রূপে কল্পনা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজের শক্তি, সাহস, ও প্রতিবাদী মনোভাবকে প্রকাশ করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে। এটি প্রথম ছাপা হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি, কলকাতার 'বিজলী' পত্রিকায়। এরপর এটি 'প্রবাসী', 'সাধনা', এবং নজরুলের নিজের সম্পাদিত 'ধূমকেতু' পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়।তাই এই কবিতা শুধু একটি সাহিত্যিক রচনা নয়, এটি একটি জাগরণ, একটি সাহসী কণ্ঠস্বর, যা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।

জাতীয়তাবাদ ও সমাজচেতনা:

নজরুল ছিলেন সত্যিকার অর্থে এক অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য তাঁর লেখা ছিল দৃঢ় ও জোরালো। তিনি লিখেছিলেন:

"মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান!"

ব্রিটিশ শাসনের অবমাননা, সমাজের গোঁড়ামি, ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা, নারীর অধিকার হরণ — সবকিছুর বিরুদ্ধেই নজরুল ছিলেন তীব্র প্রতিবাদী। তাঁর কলম কখনো ছিল তরবারির মতো ধারালো, কখনো আবার ছিল স্নেহময় বাউলের সুর।

নজরুলের সঙ্গীত: চেতনার সুরধ্বনি:

নজরুল গান বাংলা সংগীতকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। প্রায় ৪০০০ গান রচনা করেন তিনি, যার মধ্যে ইসলামিক সংগীত, ভক্তিমূলক গান, প্রেমের গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত — সবই ছিল। তাঁর রচিত ইসলামী সংগীত বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের একটি উৎস হয়ে উঠেছে।

শুধু তাই নয় তিনার সঙ্গীত বাঙালি চেতনার এক দুর্দান্ত সুরধ্বনি, যা বিদ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও সাম্যের মেলবন্ধন ঘটায়। তার গান শুধু সুরের আনন্দই নয়, বরং একটি জাগ্রত আত্মার আহ্বান, যা নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অনন্য সঙ্গীতধারা। ‘বিদ্রোহী’, ‘চল চল চল’ কিংবা ইসলামী ও শ্যামাসংগীত—প্রত্যেকটিতে মেলে ধরা হয়েছে এক বাঙালির আত্মপরিচয় ও স্বপ্নের রূপ। নজরুলের সঙ্গীত আজও আমাদের চেতনায় জাগরণ ঘটায় এবং প্রগতির পথে সাহস জোগায়।

রোগব্যাধি ও নিস্তব্ধতা: এক বেদনাদায়ক অধ্যায়:

১৯৪২ সাল নাগাদ নজরুল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। জীবনের বাকি অংশ তিনি নীরব অবস্থায় কাটিয়েছেন। তবে তাঁর এই নিস্তব্ধতা বাংলা জাতির হৃদয় থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর মুছে দিতে পারেনি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দেন।তাঁকে দেশের জাতীয় কবি হিসেবে সম্মানিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে নিউরোডিজেনারেটিভ রোগে আক্রান্ত হয়ে কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

২৫ মে: স্মরণ নয়, অঙ্গীকারের দিন:

২৫ মে শুধুমাত্র নজরুলের জন্মদিন নয়, এটি এক উপলক্ষ, যখন আমরা নিজেদের মধ্যে নজরুলের আদর্শ খুঁজে দেখার সুযোগ পাই। আজ যখন সমাজে বিভাজন, ঘৃণা, সহিংসতা বেড়ে চলেছে, তখন নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবোধ ও প্রতিবাদের ভাষা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। এই দিনে আমাদের উচিত শুধুমাত্র তাঁর কবিতা আবৃত্তি বা গান গাওয়া নয়, বরং তাঁর চিন্তা, আদর্শ ও জীবনদর্শনকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। স্কুল-কলেজে নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠান যেন কেবল আনুষ্ঠানিকতায় না সীমাবদ্ধ থাকে — বরং তা হোক চেতনার চর্চাস্থল।

উপসংহার:

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি নন, তিনি এক চলমান চেতনা, এক বিপ্লবের নাম। ২৫ মে সেই চেতনার জন্মদিন। বিদ্রোহের ছন্দে সাহস ও স্বপ্নের যে বীজ তিনি রোপণ করেছিলেন, তা আজও আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে বিকশিত হচ্ছে। আসুন, এই দিনটিকে আমরা শুধুমাত্র স্মরণের দিন না বানিয়ে, মানবতার জয়গানে মুখরিত একটি প্রতিজ্ঞার দিনে পরিণত করি।জয় হোক নজরুলের সাহসের, জয় হোক মানবতার!

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter