ইসলামে নীরবতার সংস্কৃতি: অপ্রয়োজনীয় কথার ক্ষতি ও চুপ থাকার ফযিলত
কথা মানুষের ব্যক্তিত্বের আয়না। মানুষ যেমনভাবে কথা বলে, তেমনি তার অন্তরের চাল–চলন ফুটে ওঠে। ইসলাম আমাদের শেখায় যে, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। তার মধ্যে জিহ্বা বা ভাষার ব্যবহার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই জিহ্বা দিয়েই মানুষ আল্লাহর স্মরণ করে, এবং একই জিহ্বা দিয়েই গীবত করে, মিথ্যাবাদ করে কিংবা কারো প্রতি কটু কথা বলে। তাই ইসলামে নীরবতার একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে, যা মানুষকে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে বিরত রেখে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উন্নতির পথ দেখায়।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন:
“مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ”
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে ভালো কথা বলুক অথবা চুপ থাকুক।”
(বুখারি ও মুসলিম)
এই হাদিসটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও জীবনের গভীর নীতিগুলো নির্দেশ করে: কথার ক্ষেত্রে দুই বিকল্প — বলার জন্য যদি কোনো ভালো শব্দ থাকে, তা বলো; নাহলে নীরব থাকো।
ইসলামে অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন বা ক্ষতিকর কথা বলা অনুমোদিত নয়। আল্লাহ তায়ালাই কুরআনে বলেন:
“مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ”
“মানুষ কোনো কথা উচ্চারণ করে না, শুধু তার নিকট উপস্থিত থাকে একজন রক্ষক।”
(সূরা ক্বাফ ৫০:১৮)
অর্থাৎ, মানুষের প্রতি কথার জন্য একজন রক্ষী (ফেরােশতা) সর্বদা উপস্থিত আছে—এ কারণে কথার প্রতি দায়বদ্ধ হওয়া অপরিহার্য।
বর্তমানে, প্রযুক্তি ও সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারের ফলে অপ্রয়োজনীয় কথার ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়েছে। মানুষ একটি স্ট্যাটাস, মন্তব্য বা কথাবার্তার মাধ্যমে অচেনা দ্বন্দ্বে জড়ায়। কখনো কখনো এসব কথাবার্তার কারণে পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে যায়, বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়, সমাজে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ইসলামের নীরবতার শিক্ষা ঠিক এই সঙ্কট থেকে সুরক্ষা দেয়, এবং শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে অতিরিক্ত কথা বলা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। বিপরীতে, পর্যাপ্ত নীরবতা মনকে প্রশান্ত করে, চিন্তাকে গভীর করে তোলে। ইসলাম এই বাস্তবতাটিকে ১৪০০ বছরেরও আগে ধরিয়ে দিয়েছিল।
সাহাবায়ে কেরাম নীরবতা ও সংযমকে নিজের সাধারণ ও আচার-আচরণে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ:
- হযরত আবূ বকর (রা.) প্রায়শই বলতেন: “এই জিহ্বার কারণে আমি বিপদে পড়েছি।”
- হযরত উমর (রা.) বলতেন: “কথা কম বলো, নীরব থেকো; এতে তোমার জন্য নিরাপত্তা আছে।”
তবে, নীরবতা মানে একেবারেই নির্বিকার হয়ে থাকা নয়। যদি কেসে সত্য বলা, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রয়োজন হয়, তাহলে নীরব থাকা নয়, স্পষ্টভাবে কথা বলা দাওয়াত ও নির্দেশনা।
রাসুল ﷺ আরও বললেন:
“أَكْثَرُ أَشْيَاءٍ يُدْخِلُ النَّاسَ الْجَنَّةَ فِي أَلْسِنَتِهِمْ وَعَوْرَاتِهِمْ”
“আপনারা কি জানেন মানুষের মধ্যে কারো জাহান্নামে সবচেয়ে বেশি কী নিয়ে যাবে? জিহ্বা ও যৌনাঙ্গ।”
(তিরমিজি)
এই হাদিসটি জিহ্বার (ভাষার) ঝুঁকি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে — কথার সীমাবদ্ধতা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমানে, যখন মানুষ অহেতুক কথাবার্তায় নিমজ্জিত, তখন ইসলামের নীরবতার সংস্কৃতি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। পরিবারে শান্তি, সমাজে সম্প্রীতি ও আত্মিক প্রশান্তি অর্জনের জন্য নীরবতা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এক সচেতন মুসলিম হওয়া মানে হলো:
- কথাকে সংযত রাখা
- প্রয়োজন ছাড়া চুপ থাকা
- প্রতিটি শব্দকে আল্লাহর সামনে হিসাবের জন্য প্রস্তুত রাখা
নীরবতা হলো প্রকৃত আত্মসংযমের প্রকাশ। ইসলাম একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি দেয়: যেমন নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদির মতোই জিহ্বার নিয়ন্ত্রণও একটি ইবাদত। যে মুমিন অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে, তার নীরবতাকেই ইবাদতে পরিণত হয় — কারণ এই নীরবতা তাকে মিথ্যা, গীবত, পরনিন্দা ও কটূক্তি থেকে রক্ষা করে।
কুরআনে আরও বলা হয়েছে:
“وَقُل لِّعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ ۖ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُّبِينًا”
“আমার বান্দাদেরকে বল — তাদের বলুক এমন কথা যা উত্তম; নিশ্চয় শয়তান তাদের মাঝে ফাটল দেয়। শয়তান মানুষের জন্য কোনো গোপন শত্রু নয়।”
(সূরা ইসরাঈল ১৭:৫)
আরেকটি কুরআনিক আয়াত বলেছে:
“وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَـٰذَا حَلَالٌ وَهَـٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ”
“আপনারা বলেন না: ‘এটা তো হালাল’ বা ‘এটা তো হারাম’ — আপনারা কেন মিথ্যার কথা বলেন? নিশ্চয় যাঁরা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা প্ররোচিত করে, তারা সফল হবে না।”
(সূরা আনআম ৬:১৪; ইসরাঈল ১৭:৩৬ এমনমূলক আয়াত হিসেবে ব্যাখ্যা হয়ে থাকে)
নীরবতা কেবল আখলাক নয়, এটি জ্ঞান অর্জনের দ্বারও। যারা অল্প কথা বলে, তারা বেশি শুনে। বেশি শোনা মানে দ্রুত শেখা; এবং শিক্ষা মানেই জ্ঞানের বৃদ্ধি। সাহাবীরা রাসূল ﷺ-এর সামনে অযথা কথা বলতেন না — বরং নীরব থেকে শিখতেন। এভাবে, নীরবতা শুধু নৈতিক গুণ নয়, বরং প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তির উন্মুক্ত দ্বার।
নীরবতার পাশাপাশি, আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রত্যেক শব্দ ফেরেশতারা লিখে রাখে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই কিয়ামতের দিনে প্রতিটি কথার জন্য জবাবদিহি ঘটবে। কথার পরিমাণ কম করলে সেই হিসাবের বোঝা হালকা হয়।
আধুনিক মনোবিজ্ঞান ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে যে, দরকারের বাইরেও কথা বলা—অভিযোগ, নেতিবাচক মন্তব্য—মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়ায়। বিপরীতে, নীরবতা ও আত্মসংযম মানসিক শান্তি ও ভারসাম্য এনে দেয়। সুতরাং, ইসলামের শিক্ষা শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নয়, মানসিক সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য।
নীরবতা মানুষের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে। যে ব্যক্তি কম কথা বলে এবং শুধু প্রয়োজনীয় ও সুন্দর কথা বলে, তাকে সমাজ “গভীর”, “জ্ঞানি” ও “শালীন” হিসেবে মূল্যায়ন করে। অন্যদিকে, যে সব সময় অযথা কথা বলে, তাকে প্রায়শই সমাজ “হালকা” বা “গভীরতার অভাব” হিসেবে দেখবে। এক হাদিসে বলা হয়েছে:
“إِنَّ الْمُؤْمِنَ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ لَا يَأْمَنُ لِسَانُهُ وَلا يَدُهُ عَلَى أَهْلِهِ”
“নিশ্চয় মুমিন সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ থাকে।”
(তিরমিজি)
এই দৃষ্টিকোন থেকেই, নীরবতা একজন মুসলিমকে সামাজিক মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা এনে দেয়।
উপসংহার
নীরবতা ইসলামে শুধুমাত্র কথার সংযম নয়; এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি। এটি ইমানকে দৃঢ় করে, অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করে, এবং আখিরামে মুক্তির পথ প্রসারিত করে। তাই একজন মুসলিমের নীতিগত চরিত্র হওয়া উচিত — “যে সময় ভালো কথা বলা সম্ভব নয়, সেই সময় নীরব থাকাই উত্তম।”বর্তমান অশান্ত যুগে, যেখানে কথার পারদ কমেছে, নীরবতা নতুনভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। অনেক সময় কথার চেয়ে নীরবতাই বেশি মূল্যবান। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত — “ভালো কথা বলো, নাহলে চুপ থাকো।” মহান আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে এই নীরবতার শিক্ষা জীবনযাপনে প্রয়োগ করার তৌফিক দান করেন।