ইসলামী মানবতার আলো ও আদর্শ জীবন গঠনের দিশা
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে তাঁর সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ করে মান-হুঁশ-মনুষ্যত্ব, বিবেক-বুদ্ধি-উপলব্ধি ইত্যাদি সর্ব মানবীয় গুণযুক্ত করে সর্বোৎকৃষ্ট অবয়বে সৃষ্টি করেছেন; সঠিকভাবে ইসলামী আদর্শকে গ্রহণের উপযুক্ত করে। সেইসঙ্গে কুরআনী ভাবাদর্শে যথার্থ মানবিক মূল্যবোধযুক্ত মানুষ করতে, তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ চিরন্তন কিতাব ‘পবিত্র কুরআন’কে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন।
উক্ত ভাবাদর্শ-কে শেষ নবীর ব্যবহারিক জীবনে সার্থক প্রয়োগ করিয়ে, তাঁর জীবনলব্ধ প্রাসঙ্গিক অজস্র হাদিস দিয়ে তথা পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসের দ্বারা শান্তির ধর্ম দ্বীন-ইসলামের আদর্শ বিধান বা শরীআত-কে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কোরান শরীফে ইরশাদ করেন:
يُرِيدُونَ أَن يُطْفِـُٔوا۟ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفْوَٰهِهِمْ وَيَأْبَى ٱللَّهُ إِلَّآ أَن يُتِمَّ نُورَهُۥ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْكَـٰفِرُونَ هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ
অবিশ্বাসীরা আল্লাহর দ্বীনের জ্যোতি নেভানোর প্রচেষ্টায় থাকলেও, আল্লাহপাক তাঁর জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন চান ও সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করার জন্য সঠিক পথ-নির্দেশক সত্যধর্ম দ্বীন ইসলাম ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। (সূরা তাওবাহ, আয়াত: ৩২-৩৩)
আর তাঁর মনোনীত একমাত্র ধর্ম তথা ইসলাম ধর্মের আদর্শ মানবীয় বিধানে নিজেদের সমর্পণ না করে বিশ্বাসীদের মরতে নিষেধও করেছেন। (সূরা মায়েদা ৩/সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১৯-২০, আয়াত: ১০২)
এজন্য, আমাদের ব্যক্তিগত কিংবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও চিন্তা-চেতনা বা খেয়াল-খুশির অনুসরণকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে, স্পষ্ট শরীয়তে পরিপূর্ণভাবে নিজেদেরকে সমর্পণ করতে হবে।
সেই উদ্দেশ্যে মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি পর্যায়ের প্রত্যেকটি জীবন সংযুক্ত বিষয়ে, পবিত্র কুরআনের নির্দেশিকা ও রাসূল সা.-জীবনাদর্শের নানা সুন্নত দিয়ে আদর্শ মানবতার যেসব শিক্ষা তিনি দিয়েছেন, যেগুলিকে পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে খুঁজে বের করে জানতে হবে, বুঝতে হবে ও নিজের জীবনে প্রতিফলনের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে।
এই জানা, বোঝা বা জ্ঞানের মূল্যায়নে আল্লাহর একটি বার্তাকে উপলব্ধি করি- আল্লাহপাক যে জ্ঞানের-শ্রেষ্ঠত্বের জন্য মাটির মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি করে, নূরের ফেরেশতাদের সিজদা করতে বলে সন্মানিত করেছেন; জ্ঞানহীন, অন্ধ, আত্ম-খেয়ালখুশি অনসারী সেই মানষকেই তিনি নিকৃষ্ট,পশুর চেয়ে অন্ধ, পথভ্রষ্ট বলেছেন। (সূরা রা'দ, আয়াত : ১৬,১৯/সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৭২/ সূরা আনফাল, আয়াত: ২২)
তাই সর্বশ্রেষ্ঠ সর্ব মানবিক চেতনা-সমৃদ্ধ আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে ইসলামী ভাবাদর্শে।
আল্লাহতায়ালা কেবল ধর্মীয় কিছু আবশ্যিক আচার পালনের মধ্যে দ্বীন ইসলামকে সীমাবদ্ধ না রেখে, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন-পর্যায়ের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় নানারকমের আদর্শ মানবিক শিক্ষা দিয়েছেন পবিত্র কুরআনের সহস্রাধিক আয়াতের মাধ্যমে।
তাই তিনি পূর্ব পশ্চিম দিকের মুখ ফেরানোর ভূতি পালনে পুণ্যের সন্ধান না নিয়ে, তাঁর সব কিতাব, নবী, রাসুলে বিশ্বাস রেখে নামাজ মোতায়েন, যাকাত দেওয়ার সঙ্গে, তাঁর ভালোবাসায় আত্মীয় স্বজন অভাবগ্রস্ত পিতৃহীন মুসাফিরদের সাহায্যের নির্দেশ দিয়ে, মানবতার আদর্শকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
(সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৭৭)
নামাযের মাধ্যমে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রেখে, আদর্শ মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
(সূরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)
সিয়ামের বিধান পালনের দ্বারা ক্ষুধার্তের কষ্ট-যন্ত্রণা উপলব্ধি করিয়ে, পরিশুদ্ধ করিয়ে, মুত্তাকী তথ্য আদর্শ মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩)
সেবাদর্শে সম্পদ বৃদ্ধির সুসংবাদ দিয়ে তাঁর বার্তা- ‘তাঁর সন্তুষ্টির জন্য যাকাত দিলে তিনি ধন-সম্পদ বহুগুনে বৃদ্ধি করে দেবেন। (সূরা রুম, আয়াত: ৩৯)
মানব মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত শ্রেষ্ঠতম আশীর্বাদ প্রাপ্ত নিদর্শন কাবা-দর্শন তথা হজ পালনের মাধ্যমেও আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬-১৭)
“তাঁর কাছে কুরবানির মাংস রক্ত পৌঁছায় না পৌঁছায় ধর্মনিষ্ঠ। ‘এই বার্তা দিয়ে রীতি পালনের সঙ্গে মুত্তাকী তথা আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
(সুরা স্বফফাত, আয়াত: ১০১,১০৯/হাজ আয়াত: ৩৭)
আবার আল্লাহপাক মানুষকে আদর্শ মানবিক মানুষ করতে তাদের ব্যক্তিগাত, পারিবারিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, সম্পত্তি- উত্তরাধিকার, যুদ্ধ-বিবাদ শাস্তি, শুভ-অশুভ, পরস্পর বিরোধী নানা আচরণের সঙ্গে ধর্ম-বিশ্বাস সম্পর্কিত মানব জীবন-সংযুক্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর নানাধরনের বার্তা দিয়েছেন।এইসব বার্তার মাধ্যমে তিনি তাঁর সৃষ্টি-শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিধি- বিধান,আদেশ-নির্দেশ, দায়-দায়িত্ব-কর্তব্যপূর্ণ আদর্শ জীবন-ব্যবস্থা তথা দ্বীন ইসলামী শরিয়াত নিদিষ্ট করেছেন।
এই আদর্শ মানবিক জীবন ব্যবস্থাপনায় পরিপূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রত্যেকেরই যথার্থ আত্মসমর্পণকারী বা মুসলমান হতে বলেছেন তিনি।
এই উদ্দেশ্যে তিনি বিশ্বাসী সৎকর্মশীল মুমিন আদর্শ মানুষের রোল মডেল হিসেবে প্রিয় নবী সা. ব্যবহারিক জীবনের অজস্র দৃষ্টান্ত দিয়ে- সমগ্র মানব-জাতিকে সর্ব মানবিকগুণসম্পন্ন যথার্থ। মানবিক মানুষ করতে চেয়েছেন।
এজন্য তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী সা.-কো পাঠিয়েছেন পৌত্তলিকতা, রক্ষণশীলতা, নৃশংসতা, পাশবিকতা, অমানবিকতায়-পূর্ণ এমন এক সমাজে যেখানে উটের জল খাওয়ানো নিয়ে বছরের পর বছর বংশানুক্রমে যুদ্ধ হতো, মদের প্রাচীনতায় বংশের ঐতিহ্য নির্ধারণ হ’ত, তর্কের খাতিরে গর্ভবর্তী মায়েদের গর্ভ-চিরে পরীক্ষা করা হ’ত ওই গর্ভের শিশু পুত্র না কন্যা। সর্বোপরি বাবা তার নিজের কন্যা সন্তানদের নিজ হাতে মাটির মধ্যে জীবন্ত পুঁতে দিত।
এমন এক বর্বরতম মানবসমাজের মধ্যে তিনি নবী-কে পাঠিয়ে, তাঁর প্রেরিত কুরআনী মানবতার আদর্শে তাঁকে সর্বোত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম করে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিয়েছেন।
সেইসঙ্গে তিনি এই ইসলাম ধর্মে মানবতার চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ আদর্শকে স্থাপন করে, নবী সা-এর জীবনে তাঁর আলোকিত প্রয়োগের মাধ্যমে- চরমতম অন্ধকারময় তৎকালীন সমাজকে উজ্জ্বলতম আলোকিত করে দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
যে ইসলামী মানবতার আলোকময় স্পর্শে, নবী করীম সা.-এর প্রত্যেকটা সাথী সাহাবীও এক একজন আলোকিত তারকায় পরিণত হয়েছে। যাঁদের কোনও একজনকে অনুসরণ করলে হেদায়েতের পথ পাওয়া যাবে।
হযরত আবু জাহাম বিন হোযায়ফা রা. এক বর্ননায় ইয়ারমুকের যুদ্ধে মানবতা সহানুভূতি ও আত্মত্যাগের অপূর্ব নিদর্শন দেখিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায়, মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তেও নিজের জীবন না বাঁচিয়ে, অপরের জীবন বাঁচানোর জন্য জল-কে বাড়িয়ে দিয়ে- সহানুভূতি আত্মত্যাগ ও মানবতার চরমতম পরকাষ্ঠা দেখিয়েছেন সেইসব সাহাবীরা, যাঁরা, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নিজের মেয়েদেরকে জীবন্ত দাফন করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
হযরত ইবনে উমার রা. বর্ণনায়, একজন সাহাবী হাদিয়া স্বরূপ একটি বকরীর পেলে, তিনি আপন-প্রতিবেশীরকে অধিকতর অভাবগ্রস্ত মনে করে তা- দান করে দিয়েছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি তৃতীয় এক ব্যক্তিকে নিজের চেয়ে বেশি অভাবগ্রস্ত মনে করে তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এভাবে সাতটা বাড়ি ঘুরে, আবার সেটি প্রথম বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল। মানবতার এমন আদর্শ দৃষ্টান্ত, তারা তৈরি করতে পেরেছে- ইসলামী মানবতার সুশীতল ছায়াতলে এসে।
তাই সার্বিক মূল্যায়ণে আমাদের যে উপলব্ধি হল- আল্লাহ শান্তির ধর্ম ইসলামকে কিছু ধর্মীয় আচার পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, মানবতার পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত বিকাশের মধ্যে রেখেছেন।
মানবতার এই উজ্জ্বলতম আলোকিত দ্যুতি, নবী সা.ও তাঁর সাহাবী রা.-দের আরব-ভূমি থেকে সারা পৃথিবীর মানুষের হৃদয় আলোকিত করেছে।
এজন্য বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করেছি, এই পরিপূর্ণ মানবতার শান্তিময় ছায়াতলে আশ্রয় নিতে, অচিরেই বিশ্বের এক নম্বর ধর্মে পরিণত হতে চলেছে ইসলাম। আর এ সবকিছুকেই আল্লাহপাক আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শাস্তিময় মানব ধর্মের ইসলামী আদর্শকে উজ্জ্বলতমভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন।
তাই আমাদের সবাইকে- ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার সঙ্গে সঙ্গে, মানবজীবন-সংযুক্ত ইসলামী মানবতার আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে, ও তা পরিপূর্ণভাবে জীবনে প্রয়োগ করে; আল্লাহ-কাঙ্ক্ষিত যথার্থ, আদর্শ মানবিক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।