ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ পরিবার কেমন হওয়া উচিত

ইসলাম পরিবারকে সমাজের মৌলিক একক হিসেবে বিবেচনা করে এবং দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, একটি আদর্শ পরিবার হল পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং সহযোগিতার উপর ভিত্তিতে নির্মিত সুস্থ পরিবার। এই লেখনীর মাধ্যমে কুরআন, হাদিস এবং ইসলামী সাহিত্যের শিক্ষার উপর অঙ্কিত ইসলামের একটি আদর্শ পরিবারের কাঠামো অন্বেষণ করা হয়েছে।

একটি আদর্শ পরিবার গঠনে বিবাহের ভূমিকা:

ইসলামে বিবাহ হল পারিবারিক এককের ভিত্তি। সবল সক্ষম ব্যাক্তিকে সঠিক সময়ে বিবাহ করা সুন্নাত। কুরআনে বলা হয়েছে, "আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই তোমাদের সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে স্নেহ ও করুণা স্থাপন করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।" (কোরআন 30:21) ইসলামে বিয়ের উদ্দেশ্য হল শান্তি, সান্ত্বনা এবং স্ত্রীর সাথে সাহচর্য পাওয়া, সেইসাথে একটি সুস্থ পরিবার তৈরি এবং প্রতিষ্ঠা করা।

ইসলাম বিবাহের জন্য সঠিক সঙ্গী নির্বাচনের উপর অনেক জোর দিয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, "একজন মহিলাকে চারটি কারণে বিয়ে করা যেতে পারে: তার সম্পদ, তার বংশ, তার সৌন্দর্য, বা তার তাকওয়া। যে ধার্মিক তাকে বেছে নাও, তোমার হাত ধুলোয় ঘষে যাক [অর্থাৎ। তোমার উন্নতি হোক]।" (বুখারি ও মুসলিম) এই হাদিসটি নারীদের ধার্মিকতা এবং ধর্মীয় প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরেছে না, বরং উপরিভাগের গুণাবলীর চেয়ে।

একটি আদর্শ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অপরের প্রতি তাদের ইসলামী দায়িত্ব পালনের জন্য দায়ী। কুরআনে বলা হয়েছে, "আর তাদের (নারীদের) অধিকার রয়েছে তাদের উপর (পুরুষদের) অনুরূপ সদয়ভাবে এবং পুরুষরা তাদের উপর এক স্তরের। (কোরআন 2:228) এই আয়াতটি বোঝায় যে যদিও পুরুষদের পরিবারে নারীদের উপর একটি মাত্রার কর্তৃত্ব রয়েছে, তবে তাদের উচিত তাদের সাথে সদয় ও সম্মানের সাথে আচরণ করা। একইভাবে নারীদেরও তাদের স্বামীদের ওপর আর্থিক সহায়তা ও সুরক্ষা সহ অধিকার রয়েছে।

যোগাযোগ এবং সম্মান:

একটি সুস্থ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবার গঠনের জন্য কার্যকর যোগাযোগ অপরিহার্য। ইসলাম স্বামী/স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা ও সৎ যোগাযোগকে উৎসাহিত করে। কুরআনে বলা হয়েছে, "আর লোকদের সাথে ভালো কথা বল, নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং যারা রুকু করে তাদের সাথে রুকু কর।" (কোরআন 2:83) এই আয়াতটি বোঝায় যে অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সদয় এবং মৃদু শব্দ ব্যবহার করা অপরিহার্য। ইসলামে একটি আদর্শ পরিবার গঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সম্মান। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, "তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।" (বুখারি ও মুসলিম) এই হাদিসটি তাদের পটভূমি বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে অন্যদের সাথে দয়া ও সম্মানের সাথে আচরণ করার গুরুত্ব তুলে ধরে।

অভিভাবকত্ব ও পারেন্টিং:

ইসলামে একটি আদর্শ পরিবার গঠনের জন্য পিতামাতা একটি অপরিহার্য বিষয়। পিতামাতারা তাদের সন্তানদের ধার্মিক, নৈতিক এবং সমাজের দায়িত্বশীল সদস্য হিসাবে গড়ে তোলার জন্য দায়ী। কুরআনে বলা হয়েছে, "হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর, যার উপরে নিযুক্ত রয়েছে রূঢ় ও কঠোর ফেরেশতা, তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না, বরং পালন করে। তাদের যা আদেশ করা হয়েছে।" (কোরআন 66:6) এই আয়াতটি বোঝায় যে পিতামাতাদের অবশ্যই তাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে হবে। তাদের ইসলামের মূল্যবোধ শিক্ষা দিয়ে এবং তাদের সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করে জাতি ও মিল্লাতের আদর্শ সদস্য করতে হবে।

ইসলামি শিক্ষা শিশুদের সাথে ভালবাসা, দয়া এবং সম্মানের সাথে আচরণ করার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, "সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান করে না।" (তিরমিযী) এই হাদিসটি শিশুদের প্রতি সহানুভূতি ও সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরে, কারণ তারাই উম্মাহর (মুসলিম সম্প্রদায়) ভবিষ্যৎ।

একটি আদর্শ পরিবারে, পিতামাতা তাদের সন্তানদের জন্য একটি উত্তম উদাহরণ স্থাপন করার জন্য দায়ী। কুরআন বলে, "প্রবন্ধের আয়াত:

"এবং [উল্লেখ করুন, হে মুহাম্মাদ], যখন ইব্রাহীম বলেছিলেন, 'হে আমার প্রভু, এই শহরটিকে [মক্কা] নিরাপদ করুন এবং আমাকে এবং আমার পুত্রদেরকে প্রতিমা পূজা থেকে দূরে রাখুন।" (কোরআন 14:35) এই আয়াতটি বোঝায় যে পিতামাতাদের অবশ্যই তাদের সন্তানদের একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এবং মূর্তিপূজা এড়িয়ে চলতে শেখাতে হবে। 

পরিবারে লিঙ্গ ভূমিকা:

ইসলামে, লিঙ্গ ভূমিকা সু-সংজ্ঞায়িত কিন্তু কঠোরভাবে স্থির নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, "আল্লাহ একে অপরের উপর যা দিয়েছেন এবং তারা তাদের সম্পদ থেকে যা ব্যয় করে তার [অধিকারের] দ্বারা পুরুষেরা নারীদের দায়িত্বে রয়েছে। সুতরাং সৎ নারীরা আনুগত্যশীল, [স্বামীর] অনুপস্থিতিতে হেফাজত করে। আল্লাহ তাদেরকে যা রক্ষা করবেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন উপায় খুঁজবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহান।" (কোরআন ৪:৩৪)

এই আয়াতটি বোঝায় যে পরিবারে নারীদের উপর পুরুষদের একটি মাত্রার কর্তৃত্ব রয়েছে, তবে এই কর্তৃত্ব অবশ্যই দয়া ও সহানুভূতির সাথে ব্যবহার করা উচিত। নারীদের তাদের স্বামীর আনুগত্য করা আবশ্যক, তবে তারা সম্মান ও সুরক্ষারও অধিকারী। যদি কোন স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য হয় বা অহংকারী ভাবে আচরণ করে, তাহলে সে তাকে উপদেশ দিতে পারে, তারপর বিছানায় তার থেকে আলাদা হয়ে যাবে, এবং অবশেষে একটি শেষ অবলম্বন হিসাবে তাকে আঘাত করা হবে, যদি তার বাধ্যতামূলক অবসর আসে। তবে সুলাহ পরামর্শ করা সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে বিবেচিত। 

একটি আদর্শ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অপরের প্রতি তাদের নিজ নিজ ভূমিকা ও দায়িত্ব পালনের জন্য দায়ী। পুরুষরা আর্থিক সহায়তা, সুরক্ষা এবং নেতৃত্ব প্রদানের জন্য দায়ী, যখন মহিলারা পরিবার পরিচালনা, সন্তান লালনপালন এবং তাদের স্বামীদের সমর্থন করার জন্য দায়ী।

ইসলামে একটি আদর্শ পরিবার গঠনের প্রতিদ্বন্দ্বীতা বা কাঠিন্য:

ইসলামে একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তোলা সবসময় সহজ নয়, এবং অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীতার মুখোমুখি হতে পারে পরিবারগুলি। কিছু সাধারণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে:

- স্বামী / স্ত্রীর মধ্যে ভাব বিনিময় এবং বোঝাপড়ার অভাব

- আর্থিক অসুবিধা এবং চাপ

- ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চাপ

- নেতিবাচক মিডিয়া এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রভাব

- ধর্মীয় শিক্ষা ও নির্দেশনার অভাব

এই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে, পরিবারগুলিকে একসাথে কাজ করতে হবে এবং প্রার্থনা এবং প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশনা চাইতে হবে। তাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামিক নীতিগুলি কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তা শিখতে তাদের অবশ্যই ইসলামিক পণ্ডিত এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জ্ঞান এবং পরামর্শ চাইতে হবে।

উপসংহার

অবশেষে বলাবাহুল্য যে, ইসলাম সমাজের মৌলিক একক হিসেবে পরিবারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ইসলামে একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তোলার জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতার একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রয়োজন, সেইসাথে নিজ নিজ ভূমিকা ও বাধ্যবাধকতা পূরণের প্রয়োজন। পিতামাতাকেও তাদের সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে ও ইসলামের মূল্যবোধের সাথে লালন-পালন করে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বীতাগুলি দেখা দিতে পারে, পরিবারগুলি আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশনা চাওয়ার মাধ্যমে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামিক নীতিগুলি প্রয়োগ করার মাধ্যমে সেগুলি কাটিয়ে উঠতে পারে। ইসলামে একটি আদর্শ পরিবারের কাঠামো অনুসরণ করে, পরিবারগুলি একটি শক্তিশালী এবং উত্তম পরিকাঠামো তৈরি করতে পারে যা কেবল নিজেদেরই নয়, বৃহত্তর সম্প্রদায়ের জন্যও উপকৃত হবে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter