সীরাতে নববীর আলোকে মহরের সরলতা এবং যৌতুকের কুপ্রথা: আধুনিক যুগের জন্য নির্দেশনা
ইসলাম বিবাহকে একটি পবিত্র ইবাদত এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজন ঘোষণা করেছে। এই সম্পর্ক কেবল দুই ব্যক্তির মধ্যে নয় বরং দুই পরিবারের মধ্যে ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে একটি সম্পর্কের সূচনা। বিবাহের সময় ইসলাম নারীর জন্য যে আর্থিক অধিকার দিয়েছে, তা মহর বলা হয়, যা কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে ফরজ এবং অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় যে আজকের যুগে বিবাহের এই সুন্দর ধারণাকে রীতিনীতি, রেওয়াজ এবং আর্থিক বোঝার নিচে চাপা দেওয়া হয়েছে। যেখানে মহরকে কেবল আনুষ্ঠানিক শব্দের মধ্যে লিখে ফেলা হয়, সেখানে যৌতুককে আবশ্যিক মনে করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে অইসলামিক এবং জুলুম ভিত্তিক রেওয়াজ।
কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
"وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً"
(সূরা নিসা: ৪)
অর্থাৎ: "এবং নারীদের তাদের মহর আনন্দের সাথে প্রদান কর।"
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মহর কোনো অনুগ্রহ বা উপহার নয়, বরং নারীর অধিকার, যা আনন্দের সাথে এবং সম্মানের সাথে প্রদান করা উচিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনচরিত এ বিষয়ে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ যে তিনি তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ এবং কন্যাগণের বিবাহে সরলতা, ন্যায় এবং ভারসাম্যকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
হাদীস এবং সীরাতের কিতাবসমূহ থেকে জানা যায় যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের জন্য যে মহর নির্ধারণ করেছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত সাধারণ এবং সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের উপযোগী। হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মহর ছিল ৫০০ দিরহাম, যা আজকের হিসাবে প্রায় দেড় কেজি রূপার সমান। হযরত উম্মে সালমা, হযরত হাফসা এবং হযরত সফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুনার জন্য ৪০০ দিরহাম নির্ধারিত হয়েছিল। কেবলমাত্র হযরত উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্য ৪০০০ দিরহাম নির্ধারিত হয়েছিল, যা নাজাশী বাদশাহ্ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিনিধি হিসেবে প্রদান করেছিলেন, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) দেননি।
এভাবেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে ছোট এবং প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহার বিবাহেও সরলতা পরিস্ফুট ছিল। হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু তাঁর একটি বর্ম বিক্রি করে যে অর্থ সংগ্রহ করেন, তা প্রায় ৪০০ দিরহাম ছিল, এবং সেটিই হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহার মহর নির্ধারিত হয়। সেখানে ছিল না কোনো প্রদর্শন, না কোনো আসবাবপত্র, না কোনো দুনিয়াবি দাবি।
এর বিপরীতে আজকের যুগের অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। মহর কেবল প্রতীকীভাবে কয়েক শত বা কয়েক হাজার টাকায় স্থির করা হয়, কখনো কখনো শুধু "৭৮৬ টাকা" অথবা "এক ভরি সোনা" ইত্যাদির আনুষ্ঠানিক শব্দে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু যখন যৌতুকের প্রসঙ্গ আসে তখন আর কোনো সীমা থাকে না, না কোনো লজ্জা। গরিব পিতামাতার কাছ থেকে পাঁচ লাখ, ছয় লাখ, দশ লাখ, বরং কোনো কোনো স্থানে বিশ পঁচিশ লাখ টাকা পর্যন্ত যৌতুক চাওয়া হয়। এতে থাকে আসবাবপত্র, দামি কাপড়চোপড়, সোনার গয়না, মোটরসাইকেল বা গাড়ি এবং নগদ অর্থ। এই জুলুমের দাবির কারণে অনেক মেয়ে তাদের পিতামাতার বাড়িতে বসে থাকে, তাদের বিবাহে বিলম্ব ঘটে, এবং কখনো কখনো তারা আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
যৌতুকের এই অইসলামিক ব্যবস্থা কেবল আর্থিক জুলুম নয় বরং নৈতিক পতন এবং ধর্মীয় বিভ্রান্তির চিহ্নও বটে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো যৌতুক গ্রহণ করেননি, দেননি। তিনি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রশ্ন করেননি, "তুমি কী এনেছো?", বরং বলেছিলেন, "তোমার কাছে কী আছে যার দ্বারা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহার হক আদায় করা যায়?" হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আমার একটি বর্ম আছে", তখন তিনি বললেন, "ওটি বিক্রি করে মহর আদায় করো।"
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রসিদ্ধ উক্তি হলো: "মহরে বাড়াবাড়ি কোরো না, যদি এতে কোনো শ্রেষ্ঠতা থাকত তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কন্যাদের মহর সবচেয়ে বেশি রাখতেন।"
কিন্তু আজ আমাদের অবস্থা হলো, আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছেড়ে দুনিয়াবি প্রদর্শনীকে গ্রহণ করেছি। মহরে আর ভারসাম্য নেই, বিবাহে আর সরলতা নেই, যৌতুক থেকে আর কোনো বিরতিও নেই। সমাজ এমন একটি অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে যেখানে সম্পদকেই বিবাহের মানদণ্ড বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো এই পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তন করা যাবে? একমাত্র সমাধান হলো আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথের দিকে ফিরে আসি। মহরকে সম্মান এবং ভালোবাসার অধিকার মনে করে আনন্দের সাথে প্রদান করি; তাতে যেন কোনো বাড়াবাড়ি বা স্বল্পতা না থাকে। এবং যৌতুকের মতো অভিশাপ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকি।
সমাজের আলেম, খতিব, শিক্ষক এবং চিন্তাবিদদের উচিত এই বিষয়ে সাহসিকতার সাথে কথা বলা, বিবাহের খুতবা এবং দারসগুলিতে যৌতুকের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়া এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতকে প্রচার করা। এই আলোই আমাদের ঘরগুলিকে জান্নাতের অনুরূপ করে তুলতে পারে, সম্পর্কের মধ্যে ন্যায় এবং ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং একটি প্রকৃত ইসলামি সমাজের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।