ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা
ইসলাম এবং নারীবাদ-এই শব্দবন্ধ দেখে অনেকেরই মনে প্রথম যে প্রতিক্রিয়া হবে তা হচ্ছে এ দুটি পরস্পর বিরোধী একটি ব্যাপার। অনেক মুসলিম নারীবাদকে সমর্থন করেন না। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিতর্ক আর বিতণ্ডারও শেষ নেই।
নারীবাদীদের বক্তব্য, ইসলাম ধর্ম নারীর সমতাকে স্বীকৃতি দেয় না।
ইসলাম ধর্মে নারীদের জন্য পর্দা প্রথার কথা বলা হয়েছে, যেখানে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া চলাফেরা না করার বিধান আছে, এর ফলে নারীর সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে সীমিত করা হয়েছে,কিন্তু ইসলাম ধর্ম নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইসলামে নারীকে পুরুষের অধস্তন করা হয়নি। সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা হয়নি।
আধুনিক বিশ্ব ইসলামের সমালোচনা করে মূলত তার তাথাকথিক নারী বিরোধী মনোভাবের জন্য। সমালচনা করা প্রায়ই নারীর প্রতি যেন কোনো দমন বা নৃশংসতার বিষয়ে ইসলামের দিকে আঙ্গুল তুলে। অমুসলিমেরা প্রায়াই ইসলাম ও মুসলিমের ভৎসর্না করে যে এরা এখনও বহুবিবাহকে একটি প্রতিপ্রত্তির ও সাম্প্রদায়িক প্রতিক হিসাবে সমর্থন করে। এমন কী যখন বহুবিবাহ পালনকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকাংশই একাবগবাহ প্রথাকে মেনে নেওয়ার জন্য পুরোনোটিকে ছেড়ে দিয়েছে।
চরম অবজ্ঞার সাথে ইসলামের সমালচনা করা এই বিষয়টি উপস্থাপন করে যে ইসলাম একজন সাধারন পুরুষের জন্য মাত্র চারটি স্ত্রীর অনুমতি দিলেও মুহাম্মাদ, ইসলামের নবী, প্রায় এক ডজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন। তারা বহুবিবাহকে ইসলামের দুর্বলতা এবং বর্বরতা ও অসভ্যতার একটি প্রতিক হিসেবে চিহ্নিত করেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাল্যবিবাহ নিয়ে কেরালায় চরম বির্তক শুরু হয়।
বিতর্কটি তখন সূস্টি হয় ,যখন স্থানীয় সংস্থাগুলিতে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্য়তামুলক করা হয়। আইন অনুজায়ী বিবাহযোগ্য় বয়স পূর্ন করতে হয়। বর্তমান নিয়মানুসারে বরের বয়স ২১ এবং বধুর ১৮ বছর হওয়া আবশ্য়িক। কেরল সরকারের বিয়ের নিবন্ধনে মহিলাদের বয়স কমিয়ে ১৮ বছরের নিচে করার সিদ্ধান্ত প্য়ান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে ;এটি রাজ্য়ে অনেক বিশৃঙ্খলা সূস্টি করেছিল। সংশ্লিস্ট স্থনীয় স্বায়ওশাসিত দপ্তরের দায়িত্ব পালনকারী মুসলিম লীগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমালোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়। ইসলামও কটাক্ষের প্রাত্র হয়ে যায়।
আরকটি উদাহরণ হল মুসলিম মহিলাদের পর্দা পরিধান নিয়ে বিতর্ক কিছু বছর আগে এই বিতর্ক সূস্টি হয়। এবং অনেক সময় ধরে এই সমস্য দেখা গিয়েছিল। কেরলের কোকিকোড জেলা থেকে একটি অজ্ঞাত নোটিশ প্রচারিত হয়, যাতে এই নির্দেশ হয় যে মুসলিম মহিলারা পর্দা করবে, অন্যথায় ধর্মীয় শাস্তি দেওয়া হবে। বিভিন্ন মহলে এই বিষয়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রীয়া হয়েছে। মুসলিম মহিলাদের সাধারণ মানবাধিকার অস্বীকার করার জন্য় ধর্মীয় নেতাদের নিন্দা করা হয়েছিল। কিছু কাল পূর্বে সৌদি আরবে মুসলিম মহিলাদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিল এবং এই নিয়মটি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। সেখানে কিছু সাহুসী মহিলারা প্রকাশ্যে আইন ভাঙ্গতে এবং নির্ধারিত শাস্তি পেতে এগিয়ে আসে।
ইসলামের নারী বিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে অনেকজন সোশ্য়াল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্য়াপক অপ্রচার চালান , যখন সমস্ত বিশ্ব সর্বক্ষাত্রে যৌনতার সমতার প্রতিপন্ন করে , তখন ইসলাম একই তা অস্বীকার করে। এরকম এক সমালোচনা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায়ই বিরাজমান।
এবার দেখা যাক সবচেয়ে জঘন্য ও অমানবিক উদাহরণ, মালালা ইউসুফসাই নামে এক স্কুলছাত্রীর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা সারা বিশ্ব মনে রেখেছে।মেয়েদের শিক্ষার সমান সুযোগ দেওয়া উচিত বলে সোশ্য়াল মিডিয়ায় তার মতামত প্রকাশ করায় কিছু মুসলিম ধর্মন্ধরা তাকে গুলি করে । ধর্মের নামে একজন নিস্পাপ মেয়ের প্রতি এমন নিষ্ঠরতা কেউ সমার্থন করতে পারেনা । এটা খুব জঘন্য অপরাধ। সৌভাগ্য়ক্রমে হামলা থেকে বেঁচে যান মালাল। তিনি সাহসীকতার সাথে ঘোষনা করেছিলেন যে তিনি তার বাকি জীবন ও নারী শিক্ষার জন্য় তার আওয়াজ তুলতে থাকবেন। তার এই ঘোষনা মুসলিম ধর্মন্ধদের উসকে দিয়েছে,যারা তার জীবন কেঁড়ে নেওয়ার শপথ নিয়েছে । গোটা বিশ্ব মালালার জন্য় সমর্থন ও সাহায্য় নিয়ে এসেছে। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এখনো তার মুসলিম সন্ত্রাসীদের করুণায়। মালালাকে গুলি করা অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছে আদালত, এটা খবরসূত্রে জানা গিয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন পর, পাকিস্তান সরকার গোপনে সেই সন্ত্রাসীদের মুক্ত করেছে একথা শুনে সারা বিশ্ব হতভম্ব হয়। এই ঘটনাটি সেই ভয়ঙ্কর সত্য়ের সাক্ষ্য় বহন করে যে সন্ত্রাসীরা কতটা ভয়ঙ্কর, যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে এবং কর্তৃপক্ষ ও সরকার তাদের নিয়ে কতটা আতঙ্কে থাকে।
মহান আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত দ্বীন (আলে ইমরান ১৯)। আর এই দ্বীনে মহান আল্লাহ নারীর মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। নর-নারীর সমন্বয়েই মানব জাতি। নারী জাতি হ’ল মহান আল্লাহর এক বিশেষ নে‘মত। আল্লাহ তা‘আলা নারীকে পুরুষের জীবন সঙ্গিনী হিসাবে মানব জীবন পরিচালনার জন্য পারস্পরিক সহযোগী করেছেন। ইসলাম মর্যাদার দিক দিয়ে নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন করে দেখেনি। বরং ইসলামের আগমনেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত নারী সমাজ পেয়েছে মুক্তির সন্ধান। সারা দুনিয়াতে যখন নারীরা নিদারুণ অবস্থায় কালাতিপাত করছিল, আরব, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে তাদেরকে জন্তু-জানোয়ার বলে মনে করা হ’ত এবং মানুষ হিসাবে তাদের কোন মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করা হ’ত না, তখন ইসলাম নারীর যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে নারী জাতিকে সম্মানের সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক’ (বাক্বারাহ ১৮৭)।
তিনি আরো বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُواْ رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيْراً وَنِسَاءَ وَاتَّقُواْ اللّهَ الَّذِيْ تَسَاءَلُوْنَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْباً-
‘হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের স্বীয় প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একই আত্মা (আদম) হ’তে সৃষ্টি করেছেন এবং ঐ আত্মা হ’তে তাঁর জোড়া (হাওয়া)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং এতদুভয় হ’তে বহু নর ও নারী বিস্তার করেছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা পরস্পরের নিকট (স্বীয় হকের) দাবী করে থাক এবং আত্মীয়তা (এর হক বিনষ্ট করা) হ’তেও ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকলের খবর রাখেন’ (নিসা ১)।
ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা :
মর্যাদা অর্থ- গৌরব, সম্ভ্রম, সম্মান, মূল্য ইত্যাদি। আর নারীর মর্যাদা বলতে নারীর ন্যায়-সঙ্গত অধিকারকে বুঝায়। আর অধিকার অর্থ প্রাপ্য, পাওনা ইত্যাদি। কারো অধিকার প্রদানের অর্থ হচ্ছে তার প্রাপ্য বা পাওনা যথাযথভাবে প্রদান
করা। আর এ প্রাপ্য বা পাওনা বলতে তার অধিকারের স্বীকৃতি, কর্তব্যের সঠিক বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানের যথার্থ মূল্যায়নই বুঝানো হয়। সুতরাং নারী অধিকার বলতে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথা সকল ক্ষেত্রে নারীর যথার্থ মূল্যায়নকেই বুঝানো হয়। অতএব যদি কারো ন্যায্য অধিকার স্বীকার না করা হয়, অথবা তার কর্তব্যে বাধা দান বা তার সামর্থ্যের অধিক কোন দায়িত্ব-কর্তব্য তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, কিংবা তার অবদান সমূহের সঠিক মূল্যায়ন না করা হয়, তাহ’লে তার অধিকার ও মর্যাদা খর্ব করা হবে এবং তার প্রতি অবিচার করা হবে। আর যখন তার অধিকার সমূহ স্বীকার করা হয়, তার সামর্থ্য অনুসারে তাকে দায়িত্ব-কর্তব্য আদায় করার পূর্ণ সুযোগ দান করা হয় এবং সামাজিক জীবনে তার অবদান সমূহের মূল্যায়ন করা হয়, তখন তার উপযুক্ত মর্যাদা দান করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
ইসলাম পূর্ব যুগে নারীর অবস্থান :
ইসলাম পূর্ব যুগে নারী ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, লাঞ্চিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং অধিকার হারা জাতি। সে সময় নারীকে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বাজারের পণ্য হিসাবে গণ্য করা হ’ত। সেই সময়ে নারীদেরকে মানুষ হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হ’ত না এবং তাদের কোন সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এমনকি মানব জাতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও ছিল না। তাদের প্রতি খুবই কঠোর আচরণ করা হ’ত। সে যুগে নারীদেরকে মনে করা হ’ত দাসী এবং ভারবাহী পশু হিসাবে। যাদেরকে ক্রয়-বিক্রয় করা হ’ত। সে আমলে স্বামী যত খুশি স্ত্রী গ্রহণ করত এবং ইচ্ছা করলে তার স্ত্রীকে অপরের কাছে বিক্রি করে দিতে পারত কিংবা স্ত্রীকে দিয়েই কেউ ঋণ পরিশোধ করত। আবার কেউ উপহার হিসাবে কাউকে এমনিই দিয়ে দিত। তারা কন্যা সন্তান জন্মকে লজ্জাজনক মনে করে স্বীয় নিষ্পাপ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠিত হ’ত না। তাদের এমন বিবেক বর্জিত কর্ম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا الْمَوْؤُوْدَةُ سُئِلَتْ، بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ، ‘আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল’? (তাকভীর ৮-৯)।
সেযুগে তারা পিতা-মাতা বা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হ’ত। পিতৃহীনা সুন্দরী-ধনবতী বালিকার অভিভাবক যথাযথ মোহর দানে তাকে বিবাহ করতে সম্মত হ’ত না। আবার অন্যত্র বিবাহ দিতেও অসম্মতি প্রকাশ করত। সুন্দরী বাঁদী দ্বারা দেহ ব্যবসা করিয়ে অর্থ উপার্জন করা হ’ত। এ গর্হিত কাজ হ’তে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন, وَلاَ تُكْرِهُوْا فَتَيَاتِكُمْ عَلَى الْبِغَاءِ إِنْ أَرَدْنَ تَحَصُّناً لِّتَبْتَغُوْا عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا، ‘আর তোমরা দুনিয়ার ধন-সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে তোমাদের যুবতী দাসীদেরকে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’তে বাধ্য করবে না। যখন তারা পাপমুক্ত থাকতে চায়’ (নূর ৩৩)। উল্লিখিত যুগে একের অধিক নারী বিবাহ করে তাদের ন্যায্য পাওনা হ’তে বঞ্চিত করা হ’ত। তাদেরকে তালাক দিয়ে অন্যত্র স্বামী গ্রহণের অবকাশও দেওয়া হ’ত না। এ জাতীয় অমানবিক ও অমানুষিক যুলুম অত্যাচার নারী জাতির উপর করা হ’ত।