ইখলাস ছাড়া সকল কর্মই বৃথা
পৃথিবীতে সকল সৃষ্টিকুলই নিজ নিজ ধারনে নিজের প্রতিপালকের উপাসনা করে থাকে । যেমন আমরা (আদম সন্তান) সকলেই নিজের প্রতিপালক বা আল্লাহ তায়ালাকে খুশী করার জন্য নামাজ আদায় করে থাকি । আমরা নামাজ পড়েও এতটুকুও সান্তনা পাই না যে আমাদের নামাজটি কবুল হয়েছে নাকি সকল কর্মও বৃথা গেছে। এর নিশ্চয়ই একমাত্র কারণ হতে পারে এটি যে আমরা এখলাসের সহিত আমল করি না। কোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে এটি জানিয়েছেন যে বিনা ইখলাসে আল্লাহ কোন আমলকেই কবুল করেন না । কিন্তু এই এখলাস শব্দটির মানে কি ? এটি এমন কোন বিষয় যেটি যদি কোন আমলে না পাওয়া যায় তাহলে সেই আমল কবুল হয় না । এখলাস বাংলায় এর আভিধানিক অর্থ আন্তরিকতা বা সত্যনিষ্ঠা। কোন একদিন যখন প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিনার সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন যে ইখলাস কি ? তখন তিনি তার প্রতুত্তরে বললেন যে ইখলাস হলো ইসলামের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। যার অর্থাৎ হলো এই যে যখন তুমি আল্লাহ তাআলাকে ইবাদত করবে কিংবা যখন তুমি কোন আমল করবে তখন এই ভেবে আমল করো যে তুমি আল্লাহর সামনে এবং তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ আর যদিও তুমি না দেখতে পাও তাহলে তিনি তোমার প্রতি সর্বদাই করা নজর রেখেছে । আরবী ভাষায় বলেন
أن تعبد الله كأنك تراه فإن لم تكن تراه فإنه يراك
অর্থাৎ "ঈশ্বরকে এমনভাবে উপাসনা করা যেন আপনি তাকে দেখছেন, আর যদি আপনি তাকে দেখতে না পান তবে তিনি আপনাকে দেখছেন" ।
নবী সাহেবের যুগ, এবং তারপর পরস্পর সালাফুস সালিহিনদের যুগের সকল ব্যক্তি ইখলাসের এক একটি রত্ন বলে জানা যায়। হযরত তামিম আল-দারিমী রাঃ কে একদা একসময় তাঁর একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করলেন যে হুজুর আপনি রাত্রে কত রাকাত নামাজ আদায় করে থাকেন ? তখন তিনি রেগে গিয়ে উত্তর দেন যে দিনের বেলায় সত্যনিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এক রাকাত নামাজ পড়া আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয় যে রাত্রেবেলায় হাজার রাকাত নামাজ আদায় করি এবং সকালে সকলের সামনে সেটি চর্চা করি।
ঠিক এমনই ভাবে, যাইনুল আবেদীন নামক তাবেয়ী রহঃ রাত্রেবেলায় যখন সকলেই ঘুমিয়ে যেত, তখন তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু খাবার রান্না করে রাস্তার ফকির মিসকিনদেরকে বিলিয়ে দিতেন ।
এই ছিল তাবেঈন এবং সাহাবীদের আমল। তিনারা ইখলাস এবং আন্তরিকতা ছাড়া সৃষ্টি কুলকে দেখানোর নিমিত্তে কোন আমলই করতেন না ।
ঠিক এমনই একটি আন্তরিকতার ঘটনা পূর্ব যুগে একজন মুসলিম রাজা সঙ্গে ঘটে। সেই রাজা একদিন নিজ রাজপ্রাসাদের ভাবতে শুরু করে যে আমার সম্পূর্ণ জীবনটাই রাজা হিসেবে কাটালাম, কিন্তু আমি কি কোন এরকম আমল করেছি যার কারণে আমাকে সকলেই চিরতরের জন্য মনে রাখবে। সে তার উত্তর হিসেবে যখন দেখে তখন কিছুই খুঁজে পাই না । সর্বশেষে সে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে আমার রাজ্যে একটি সবথেকে বড় মসজিদ তৈরি করব যেই মসজিদে আমার ছাড়া অন্য কারো খিদমত বা খরচ থাকবে না । এবং তার সকল প্রজাদেরকে অন্যজনের কাছ থেকে টাকা নিতে বাধ্য করে। এবং মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। অবশেষে মসজিদ তৈরি হয়ে যায়, এবং গেটের ওপরে একটি অনেক বড় তক্তায় রাজার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয় । কিন্তু রাজা স্বপ্নে দেখতে পাই যে মসজিদের দেয়ালের উপর থেকে তার নাম হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং কোন একটি বুড়ি নারীর নাম সেখানে লেখা হচ্ছে। এটা দেখে রাজা হতভঙ্গিত হয়ে যায় । সকালেই উঠে নিজের প্রজাদেরকে মসজিদে তার নাম আছে কিনা দেখতে পাঠায়। তারা গিয়ে যখন দেখে রাজার নাম সুরক্ষিতভাবে স্বর্ণাক্ষরে বজায় রয়েছে তখন তারা ফিরে এসে রাজাকে খবর দেয় নাই এবং রাজা অনেক খুশি হয়ে যায় এবং বলে যে স্বপ্নটি একটি ভুল বা খারাপ স্বপ্ন ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন সে ঘুমিয়ে যায় তখন সেই একই রকম স্বপ্ন দেখতে পাই, যে আকাশ থেকে একজন ফেরেশতা নেমে আসছে এবং তার নাম মিটিয়ে একজন নারীর নাম সেখানে লিখে দিচ্ছে । এমনভাবে রাজার সঙ্গে পরস্পর তিনদিন হতে থাকে। তারপর সেই রাজাটি সেই নারীটিকে রাজপ্রাসাদে নিমন্ত্রণ জানায়। যখন নারীটি রাজপ্রাসাদে চলে আসে, তখন রাজা রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে আমি আমার সকল রাজ্যবাসীকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম যে তারা যেন মসজিদে তৈরিতে কোন ধরনের খরচা না করে । তবুও তুমি কেন খরচা করেছ ? তখন সেই বুড়ি উত্তর দেয় যে আমার ছেলেদের খাওয়ানোর জন্য আমার কাছে কোন ধরনের টাকা নেই তো আমি মসজিদ তৈরি করতে কেন টাকা ব্যয় করব । রাজা অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি কিছুই করনি মসজিদের জন্য ? সেই নারীটি বলে না । রাজা তার পরে তাকে আবার জিজ্ঞেস করে তাহলে আমি যে তিন দিন পরস্পর স্বপ্ন দেখছি আমার নাম মিটিয়ে তোমার নাম লেখা হচ্ছে, সেটা আবার কি ? তখন নারীটি তার প্রতুত্তরে বলে যে "হে মহামিম, আমি মসজিদের জন্য কোন খরচা দিইনি কিন্তু একদিন যখন মসজিদ তৈরি হচ্ছিল তখন আমি তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি উটকে দেখতে পাই যে মসজিদ তৈরি করার ইঁট নিজের পিঠে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তৃষ্ণার্ত হওয়ার কারণে সে চলতে পারছিল না এবং তার জন্য বিশেষ্য জল অনেক দূর ছিল । তখন আমি সেই উটকে জল পান করেছিলাম । রাজা এই উত্তরের তারা জানতে পারলো যে এই নারীটি আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহর জন্য কিছু করেছে তাই আল্লাহ তার আমলকে কবুল করুন কিন্তু রাজা নিজের নাম চিরতরে মনে রাখার জন্য কিছু করতে চেয়েছিল যেটা শুধুমাত্র মানুষ দেখানোর জন্য ছিল তাই আল্লাহ তার আমল কবুল করেনি । অতএব রাজা নিজের প্রজাদের উপর থেকে তার নাম মিটিয়ে দিয়ে সেই নারীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিতে ।
অতএব বিনা ইখলাসের কোন আমল কবুল হয়না তাই আমাদের ওপর একান্ত প্রয়োজন যেন আমরা সকল আমল আন্তরিকতা ও সতনিষ্ঠার সঙ্গে করি ।