প্রতিকূলতার রসায়ন: কষ্টকে নির্দেশনায় রূপান্তরিত করা

আরবি শব্দ ‘রুতবা’ (رُتْبَة) অর্থ ‘পদমর্যাদা’ বা ‘স্থান’। আধুনিক পরিভাষায়, শব্দটি সামরিক ক্রমাধিকার বোঝাতে ব্যবহৃত হয়: জেনারেল, কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট। সেনাবাহিনীতে প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট অবস্থান রহিয়াছে, যাহা তাহাদের পদমর্যাদার পরিচায়ক। অনুরূপভাবে, আল্লাহর দরবারেও মানুষের মাঝে আধ্যাত্মিক ‘রুতুব’ (رُتُوْب)—বা পদমর্যাদা—রহিয়াছে। কিন্তু সামরিক স্তরবিন্যাসের বিপরীতে, এই রুতুব সম্পূর্ণ গুপ্ত। আল্লাহর নিকট একজন মানুষের প্রকৃত ‘মাকাম’ (অবস্থান) কী, তাহা কাহারও জানিবার সাধ্য নাই।

জনৈক মনীষী বলিয়াছেন:

"আল্লাহ তিনটি বস্তুকে তিনটি বস্তুর অন্তরালে গোপন করিয়াছেন। তিনি তাঁহার সন্তুষ্টিকে (রেযাকে) আনুগত্যের মাঝে, তাঁহার ক্রোধকে (গযবকে) অবাধ্যতার মাঝে, এবং তাঁহার নির্বাচিত অলিগণকে (আউলিয়াকে) সাধারণ জনমানুষের মাঝে লুকায়িত রাখিয়াছেন।"

ইহার তাৎপর্য এই যে, আমরা কদাপি জানিতে পারি না, কোন ক্ষুদ্র আমলটি ইলাহি দরবারে কবুলিয়াতের সৌভাগ্য লাভ করিবে। হইতে পারে, কোনো মহা দান-খয়রাত প্রত্যাখ্যাত হইল, অথচ এক তৃষ্ণার্ত কুকুরকে জল পান করানোর মতো ক্ষুদ্র, নিষ্ঠাপূর্ণ কাজই—যাহার ফলে এক নারীকে ক্ষমা করা হইয়াছিল—নাজাতের চাবিকাঠি হইয়া উঠিল। একইভাবে, আপাতদৃষ্টিতে নগণ্য অবাধ্যতার মাঝেই হয়তো তাঁহার অপ্রসন্নতা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে; যেমনটি ঘটিয়াছিল সেই নারীর ক্ষেত্রে, যে একটি বিড়ালকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিল।

ক্ষুদ্র কর্মই অন্তরের গূঢ় অবস্থাকে উন্মোচন করিয়া দেয়। বস্তুত, করুণা—অথবা তাহার শূন্যতাই—আমাদের প্রকৃত পরিচায়ক। ইহা বিস্ময়কর নহে যে, প্রত্যেক নবীই জীবনের কোনো না কোনো অধ্যায়ে মেষপালকের দায়িত্বে ব্রতী ছিলেন।

مَا بَعَثَ اللَّهُ نَبِيًّا إِلاَّ رَعَى الْغَنَمَ

পশুর প্রতি এই কোমলতা আত্মাকে করুণা ও দয়ায় প্রশিক্ষিত করে, পরিশেষে মানুষকে করুণা প্রদর্শনের তরে প্রস্তুত করিয়া তোলে।

"আপনি যদি প্রাণিকুলের প্রতি দয়ার্দ্র হন, তবে আপনি মানবতার প্রতি দয়া প্রদর্শনের অর্ধপথ অতিক্রম করিয়াছেন।"

পরীক্ষার স্তরভেদ

বিপদ বা পরীক্ষা মানুষের উপর তাহাদের আধ্যাত্মিক মর্তবা ও ধারণক্ষমতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব বিস্তার করে। ইমাম আল-গাযযালী (রহঃ) ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে, কাহারও জন্য পরীক্ষা তাহার পাপ মোচন (কাফফারা) করে; আবার অন্যের জন্য তাহা আধ্যাত্মিক মর্তবা বুলন্দ করিবার সোপান হইয়া দাঁড়ায়। এমনকি কখনও কখনও বিষণ্ণতাও এক প্রকার পরিশোধন হিসাবে কাজ করে—ইহা আত্মার সেই নীরব ভার লাঘব করিবার একটি উপায়। মানুষ প্রায়শই এই যন্ত্রণা হইতে পলায়ন করিতে চায়। তাহারা প্রমোদ, বিনোদন বা বিভিন্ন ব্যস্ততার মাঝে নিজেদের নিমজ্জিত করিয়া রাখে। কিন্তু আত্মার এই ক্রন্দনকে স্তব্ধ করা যায় না—কেবলমাত্র উপলব্ধি করা যায়।

কার্ল মার্ক্স বলিয়াছিল, "ধর্ম জনসাধারণের জন্য আফিমস্বরূপ।"

শায়েখ আব্দুল হাকিম উইন্টার প্রত্যুত্তরে বলিয়াছেন, "আফিমই (বস্তুবাদই) আজ জনসাধারণের ধর্ম।"

মূল কথা স্পষ্ট: অস্তিত্বের গভীর যাতনা বিস্মৃত হইবার নিমিত্তে অনেকেই আজ চিত্তবিক্ষেপের উপাসনা করে। কিন্তু এই যন্ত্রণার অস্তিত্বের এক বিশেষ কারণ রহিয়াছে—ইহা এই সতর্কবার্তা দেয় যে, আত্মা তাহার স্বীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হইতেছে। দৈহিক যন্ত্রণা যেমন আমাদিগকে ব্যাধির বিষয়ে হুঁশিয়ার করে, আধ্যাত্মিক বেদনাও ঠিক তেমনি নৈতিক ও রূহানি ভারসাম্যহীনতার বিষয়ে সতর্ক করে। এই বেদনা ব্যতীত, আমরা লক্ষ্যচ্যুতি সম্বন্ধে অন্ধ ও অসচেতন থাকিয়া যাই।

অন্ধকারের উপর অন্ধকার

যখন আত্মা ‘কুফর’ (অবিশ্বাস) দ্বারা ব্যাধিগ্রস্ত হয়, তখন যন্ত্রণা ভোলার প্রতিটি প্রচেষ্টা কেবল অন্ধকারকেই অধিকতর ঘনীভূত করে। প্রতিটি গাফলত অন্ধকারের এক একটি নূতন স্তর যুক্ত করে, যতক্ষণ না আলোকরশ্মি প্রায় বিলীন হইয়া যায়। ইলাহি হস্তক্ষেপ ব্যতীত, সেই আত্মা গোপনীয়তার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হইতে থাকে।

পক্ষান্তরে, নবী-রাসূলগণের (ﷺ) এবং পুণ্যবানদের পরীক্ষাসমূহ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁহাদের বিপদ শাস্তি নহে, বরং তাহা মর্তবা বুলন্দ করিবার মাধ্যম। ইহা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর নৈকট্যের উচ্চতর শিখরে আরোহণ করায়। নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করিয়াছেন:

أَشَدُّ النَّاسِ بَلاءً الأَنْبِيَاءُ ، ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ

"মানুষের মধ্যে নবীরাই সর্বাধিক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন, অতঃপর যাহারা তাঁহাদের নিকটবর্তী, অতঃপর যাহারা তাহাদের নিকটবর্তী।"

আমাদের এই সীমিত দৃষ্টিকোণ হইতে অন্যের যাতনা বা দুর্ভোগ বিচার করা কঠিন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেন: "এমন কোনো বিপদ নাই, যাহার চেয়ে গুরুতর বিপদ ঘটিতে পারিত না।"

মুমিনের পরীক্ষা তাহাকে পরিশুদ্ধ করে, শিক্ষা দান করে এবং উন্নত করে; কিন্তু যাহারা বিশ্বাসের গণ্ডি বহির্ভূত, তাহাদের ক্ষেত্রে এই বিধান ভিন্ন।

যন্ত্রণার অন্তরালে মাধুর্য

‘সালিহাত’ (পুণ্যবতী) নারীদের মাঝে একজন একবার হোঁচট খাইয়া পড়িয়া গেলেন এবং তাঁহার পা আহত হইল। কিন্তু ক্রন্দন করিবার পরিবর্তে তিনি হাসিতে লাগিলেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিনি উন্মাদ হইয়া গিয়াছেন কি না। তিনি উত্তর দিলেন:

"না। আমি পতিত হইবার পর যখন যন্ত্রণা অনুভব করিলাম, তখন রাসূল (ﷺ)-এর সেই হাদীসটি আমার স্মরণ হইল:

مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ... حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ

‘মুমিনের গায়ে একটি কাঁটা বিদ্ধ হইলেও, আল্লাহ তদ্বারা তাহার গুনাহ মাফ করিয়া দেন।’ আমার পাপ মোচন হইতেছে, এই উপলব্ধির মাধুর্য আমার যন্ত্রণাবোধকে ছাপাইয়া গিয়াছে।"

ইহা এমন এক গভীর ঈমান, যাহা তীব্র যাতনাকেও কৃতজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে। দৈহিক যন্ত্রণা লাঘবের জন্য যেমন শারীরিক এন্ডোরফিন রহিয়াছে, আত্মার প্রশান্তির জন্যও তেমনি আধ্যাত্মিক এন্ডোরফিন বিদ্যমান।

রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণও এমন অলৌকিক অবস্থার সাক্ষী হইয়াছেন। যখন একজনের শরীরে তীর বিদ্ধ ছিল, তখন নামাযরত অবস্থায় তাহা নিষ্কাশন করা হইয়াছিল, অথচ তিনি কোনো যন্ত্রণাই অনুভব করেন নাই। ইলাহি সান্নিধ্যের উপস্থিতিতে পার্থিব যন্ত্রণা বিলীন হইয়া যায়।

এমনকি জাগতিকভাবেও আমরা অনুরূপ প্রভাব দেখি। ফেন্টানিলের মতো শক্তিশালী বেদনানাশক ঔষধ তীব্র আঘাতের অনুভূতিকে অসাড় করিয়া এক প্রকার ঘোরের সৃষ্টি করিতে পারে। কিন্তু ইলাহি নৈকট্যে অর্জিত সেই অবস্থা রাসায়নিক নহে—তাহা আধ্যাত্মিক, অতীন্দ্রিয় এবং অতলস্পর্শী।

বিপদের শিক্ষা

বিপদের প্রথম এবং প্রধানতম ফায়দা হইল ‘রবূবিয়্যাত’ বা প্রভুত্বের উপলব্ধি। পরীক্ষা আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহই একমাত্র প্রতিপালক (রব) এবং আমরা তাঁহারই শাসনাধীন।

لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ

"আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত (পাপ হইতে) বাঁচিবার বা (সৎকর্ম করিবার) কোনো শক্তি নাই।"

إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ

"নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁহারই পানে প্রত্যাবর্তনকারী।"

আমরা এই মহাসত্য উপলব্ধি করি যে, স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা এক মায়া মাত্র।

আমাদের প্রতিটি সামর্থ্য, প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি কর্ম কেবল তাঁহারই মদদে চলমান।

‘গুইলান-ব্যারি সিনড্রোম’—এক বিরল ব্যাধি যাহা সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করিয়া দেয়—আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেয়: আমাদের এই চলৎশক্তি, স্বায়ত্তশাসন এবং সুস্থতা, সকলই ক্ষণস্থায়ী আমানত, যাহা তাঁহারই ইচ্ছায় অর্পিত ও গৃহীত হয়।

যখন মোহের অবসান ঘটে

যতক্ষণ না কোনো মহাসঙ্কট আপতিত হয়, ততক্ষণ মানুষের এই মোহ বা বিভ্রান্তি কাটে না। কিন্তু বিপদের ঝাপটায় সেই পর্দা সরিয়া যায় এবং কঠিন বাস্তবতা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়।

রিপাবলিকান স্ট্র্যাটেজিস্ট লি অ্যাটওয়াটারের জীবন ইহার এক জ্বলন্ত নিদর্শন। জাগতিক মাপকাঠিতে তাহার সকলই ছিল—যৌবন, সম্পদ, ক্ষমতা। কিন্তু ঊনচল্লিশ বৎসর বয়সে মস্তিষ্কের টিউমার তাহার সকল মোহ চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দেয়। মৃত্যুর সম্মুখীন হইয়া, তিনি সেই সকল মানুষের নিকট ক্ষমা চাহিয়াছিলেন, যাহাদের জীবন তিনি ক্ষতিগ্রস্ত করিয়াছিলেন।

ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা—নশ্বরতার করাল গ্রাসের সম্মুখে এই সকলই অর্থহীন।

বিপদাপদ আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেয় যে, আমরা আমাদের জীবনের প্রভু নই। ইহা আমাদের অন্তরে পরিপূর্ণ দাসত্ব (উবূদিয়্যাত) এবং আত্মসমর্পণের (তসলিম) গুণ সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:

الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ

"যাহারা বিপদে পতিত হইলে বলে: ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁহারই পানে প্রত্যাবর্তনকারী।’" (সূরা আল-বাকারা, ২:১৫৬)

এই বিশ্বচরাচর তাঁহারই সাম্রাজ্য। সকলই তাঁহার অধিকারে। আমরা কেবল বাহ্যত মালিকানার ভান করি; বস্তুত আমরা সকলেই ঋণগ্রহীতা, অতিথি এবং অনুগত দাস মাত্র।

অশুভের রহস্য এবং স্থূলদৃষ্টির সীমাবদ্ধতা

এই গভীর তত্ত্বটি হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনায় মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে। মূসা (আঃ) আপাতদৃষ্টিতে অন্যায় ও অবিচারমূলক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করিলেন: একটি নৌকা বিদীর্ণ করা হইল, একজন নিরপরাধ যুবককে হত্যা করা হইল এবং অকৃতজ্ঞ একদল মানুষের জন্য একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর পুনর্নির্মাণ করা হইল। বাহ্যিক দৃষ্টিতে (যাহিরি) সকলই ভ্রান্ত বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছিল।

কিন্তু সেই অন্তরালবর্তী (বাতিনি) প্রজ্ঞা উন্মোচিত হইল অনেক বিলম্বে। মূসা (আঃ) শিক্ষা লাভ করিলেন যে, প্রতিটি ঘটনা, তাহা যতই ধাঁধাচ্ছন্ন হউক না কেন, এক গভীর উদ্দেশ্য বহন করিতেছিল। এই শিক্ষা চিরন্তন: স্থূলদৃষ্টি কেবল বিশৃঙ্খলা ও অসংগতি অবলোকন করে, কিন্তু প্রজ্ঞার চক্ষু (বصيرة) দেখে ইলাহি বিধানের এক নিখুঁত ও সুসমন্বিত বুনন।

যখন কোনো বিপদ আপতিত হয়, তাহা এলোমেলো বা উদ্দেশ্যহীন নহে—ইহা এক সুবিন্যস্ত প্রজ্ঞা, যাহা আত্মাকে এই শিক্ষা প্রদান করে যে:

"তুমি আমারই অধিকারে আছ, এবং আমি আমার ইচ্ছানুযায়ী কর্ম সম্পাদন করি—এমন করুণা ও উদ্দেশ্য সহকারে, যাহা তোমার উপলব্ধির অতীত।"

লব্ধ শিক্ষা

বিপদাপদ ও পরীক্ষাসমূহ বস্তুত ছদ্মবেশী নেয়ামত। উহারা প্রচ্ছন্ন সত্যকে উন্মোচন করে, আত্মার উত্তরণ ঘটায় এবং ইলাহি নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করে। যন্ত্রণা, তাহা শারীরিকই হউক বা আধ্যাত্মিক, একজন মহান শিক্ষক।

মুমিন ব্যক্তি ইহা হইতে তিনটি গভীর শিক্ষা লাভ করে:

১. সমগ্র সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা'আলার নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব (রবূবিয়্যাত)।

২. আল্লাহর প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ দাসত্ব ও গভীরতম নির্ভরতা (উবূদিয়্যাত)।

৩. এবং এই সত্য যে, অস্তিত্বের এই গূঢ় রহস্য—যাহাকে আমরা অবিচার বা যন্ত্রণা বলিয়া মনে করি—তাহা আমাদের সীমিত উপলব্ধির অতীত এক মহৎ প্রজ্ঞা ধারণ করে।

এবং এই উপলব্ধির মাঝেই নিহিত রহিয়াছে প্রকৃত প্রশান্তি (সকিনা)। ইহা যন্ত্রণার অনুপস্থিতি নহে, বরং উপলব্ধির উপস্থিতি। ইহা পরীক্ষা হইতে মুক্তি নহে, বরং পরীক্ষার মাঝে থাকিয়াও অন্তরের মুক্তি।

“যখন আপনি সেই সত্তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন যিনি বিপদ প্রেরণ করেন, তখন কোনো কিছুই আর যন্ত্রণাদায়ক থাকে না।”

মহাসঙ্কট আমাদের স্বনির্ভরতার মোহকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দেয়, এবং ইহার মধ্য দিয়াই আত্মা তাহার প্রকৃত নিবাসকে স্মরণ করে—যেখানে সকল সুবিচার, সকল করুণা এবং সকল প্রজ্ঞা একীভূত হইয়া বিরাজমান।

সূরা দুহা থেকে শিক্ষা

নবী করীম (ﷺ)-এর জীবনের এক গভীরতম ব্যক্তিগত বিষাদ ও আধ্যাত্মিক নীরবতার (ওহীর বিরতি) ক্রান্তিকালে অবতীর্ণ সূরা আদ-দুহা, বস্তুত ইলাহি শব্দে আবৃত এক স্নিগ্ধ প্রলেপ—স্রষ্টার পক্ষ হইতে তাঁহার প্রিয়তমের প্রতি এক স্নেহসিক্ত প্রেমপত্র। ইহার সূচনা কোনো আদেশ দ্বারা নহে, বরং এক কসম দ্বারা:

وَالضُّحَىٰ (শপথ পূর্বাহ্ণের)।

এই সময়টি স্নিগ্ধ আলোকের, রাত্রির নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ধীর জাগরণের, উষ্ণতার। ‘দুহা’—এই একক শব্দটি এক গভীর ব্যঞ্জনা বহন করে। ইহা মধ্যাহ্নের প্রখর উত্তাপ নহে, কিংবা রজনীর গ্রাস করা তমিস্রাও নহে। ইহা সেই মধ্যবর্তী স্থান, আশার সেই চৌকাঠ, যখন ধরণী শান্ত অথচ ধীরে ধীরে স্পন্দিত হইতে শুরু করিয়াছে। ইহার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদিগকে স্মরণ করান যে, গভীরতম, শীতলতম নীরবতার অন্তরালেও, আলোকরশ্মি ফিরিয়া আসিতে বাধ্য।

এই সূরা, যদিও রাসূল (ﷺ)-এর হৃদয়ের বেদনা উপশমের জন্য নাযিল হইয়াছিল, তথাপি কালান্তরে প্রতিটি ব্যথিত আত্মার সহিত নিগূঢ় এক সংলাপ স্থাপন করে। ইহা তাহাদের কথা বলে, যাহারা রুদ্ধদ্বার কক্ষে একাকী অশ্রুপাত করিয়াছে, যাহাদের কম্পিত হস্ত দোয়ায় উঠিয়া ভাবিয়াছে, আদৌ কেহ শুনিতেছে কি না।

مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَىٰ (আপনার প্রতিপালক আপনাকে ত্যাগ করেন নাই এবং আপনার প্রতি অসন্তুষ্টও হন নাই।)

একটিমাত্র আয়াত—আর মনে হয়, কেহ যেন আপনার হৃদয়ের শীতলতম নীরবতায় সোজা পৌঁছিয়া গিয়াছে এবং ভিতর হইতে উহাকে উষ্ণ করিয়া তুলিতেছে। আমি এই আয়াতটিকে এক গুপ্ত অগ্নিশিখার মতো অন্তরে বহন করিয়াছি সেইসব দিনে, যখন আশা করিবার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট ছিল না। যখন মনে হইয়াছে, আমার প্রার্থনাসমূহ বুঝি শূন্যে মিলাইয়া যাইতেছে, তখন এই সূরা আমাকে বলিয়াছে: এই নীরবতা হয়তো প্রত্যাখ্যান নহে, বরং ইহা এক নূতন পথের দিশা। এই বিরতি হয়তো এক গভীরতর প্রস্তুতিরই অংশ।

রাসূল (ﷺ), যিনি ছিলেন অতুলনীয় ভালোবাসার পাত্র, তাঁহাকেও এই ইলাহি নীরবতার অভিজ্ঞতা দান করা হইয়াছিল—শাস্তি হিসাবে নহে, বরং ছদ্মবেশী ঘনিষ্ঠতার নিদর্শনস্বরূপ। ওহীর সেই সংক্ষিপ্ত বিরতি কোনো শূন্যতা ছিল না, বরং এক গভীর শিক্ষা ছিল: আল্লাহর উপস্থিতি কেবল নিরন্তর নিদর্শনের উপর নির্ভরশীল নহে। এবং তাঁহার সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া আমরাও এই শিক্ষা লাভ করি যে, আমাদের অপেক্ষার মুহূর্তগুলি বিস্মৃত হইবার চিহ্ন নহে। বস্তুত, ইহা সেই উর্বর মৃত্তিকা, যাহাতে ঈমানের মূল প্রোথিত হয়। সূরাটি যন্ত্রণার উপশমে ত্বরান্বিত হয় নাই—বরং প্রথমে ইহাকে সম্মান জানাইয়াছে। ইহা ভয়কে তিরস্কার করে নাই, বরং স্নিগ্ধতা দিয়া তাহার প্রত্যুত্তর দিয়াছে।

وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ الْأُولَىٰ (এবং অবশ্যই আপনার জন্য পরকাল ইহকাল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।)

এই আয়াতটি তাৎক্ষণিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয় না—ইহা যন্ত্রণার সমগ্র প্রেক্ষাপটকেই পুনর্গঠন করে। ইহা আমাদের দৃষ্টিকে সাময়িক ক্ষত হইতে অনন্ত পুরস্কারের পানে ফিরাইয়া দেয়। ইহা আমাকে শিক্ষা দেয় যে, এই নশ্বর পৃথিবীতে সকল কিছুর অর্থ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। আমার ভগ্ন হৃদয়, আমার প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি, আমার নীরব রজনীর ক্রন্দন—এই জীবনে হয়তো সেগুলির কোনো সমাধান মিলিবে না। কিন্তু তাহার অর্থ এই নহে যে, সকলই বৃথা। আমার অনুत्तरিত দোয়ার ভারে যখন অন্তর সঙ্কুচিত হইয়া আসে, তখন এই আয়াতের কথা ভাবি। ইহা স্মরণ করাইয়া দেয়, যাহা কিছু এখানে অসম্পূর্ণ বলিয়া মনে হইতেছে, তাহা সেখানে পূর্ণতা লাভ করিবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হয়তো আজ পূর্ণ হয় নাই—কিন্তু তাহা পূর্ণ হইবেই।

অতঃপর সূরাটি রাসূল (ﷺ)-কে—এবং আমাদিগকে—স্মরণ করিতে আহ্বান জানায়।

أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَىٰ (তিনি কি আপনাকে ইয়াতীম অবস্থায় পান নাই, অতঃপর আশ্রয় দেন নাই?)

এই অলঙ্কারিক প্রশ্নগুলি স্নেহের এক কালপঞ্জি নির্মাণ করে। আল্লাহ প্রথমে যন্ত্রণার উল্লেখ করিয়াছেন—ইয়াতীম, পথহারা (ضَالًّا), নিঃস্ব (عَائِلًا)—কিন্তু সেখানেই থামিয়া যান নাই। তিনি প্রতিটি অবস্থাকে যত্নের সহিত পূর্ণতা দিয়াছেন। আপনি একাকী ছিলেন—কিন্তু আমি আপনাকে আশ্রয় দিয়াছি। আপনি পথান্বেষী ছিলেন—কিন্তু আমি আপনাকে পথ দেখাইয়াছি। আপনি নিঃস্ব ছিলেন—কিন্তু আমি আপনাকে স্বাবলম্বী করিয়াছি।

ইহা কেবলই এক সান্ত্বনা নহে। ইহা গভীর চিন্তার এক খোরাক। আমি আমার নিজ জীবনের পানে তাকাইয়া দেখিলাম: যে মুহূর্তগুলি একদা আমাকে ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দিয়াছিল, তখনও আমি তাঁহারই আশ্রয়ে পরিবেষ্টিত ছিলাম। এমন সময় ছিল, যখন আমি ভাবিতেও পারি নাই যে, আমি আজকের এই অবস্থানে পৌঁছাইতে পারিব। কিন্তু আমি পৌঁছাইয়াছি। প্রতিটি নিঃশ্বাসে, কোনো এক অদৃশ্য উপায়ে, আমাকে বহন করা হইয়াছে।

এই সূরা আমাকে আমার জীবনের অধ্যায়গুলিকে কোমলতর দৃষ্টিতে দেখিতে শিখাইয়াছে। যে সময়গুলিতে ভাবিতাম আল্লাহ বুঝি মুখ ফিরাইয়া লইয়াছেন, বস্তুত সেই সময়গুলিতে তিনি আমাকে অন্য কোনো বিশেষ লক্ষ্যের পানে ফিরাইতেছিলেন। আমার জীবনের এমন এক অধ্যায়ের কথা মনে পড়ে, যাহা ছিল অসহনীয় শূন্যতায় ভরা—প্রশ্নভারে ক্লিষ্ট দিনগুলি একে অপরের সহিত মিশিয়া যাইত। আমি নিরন্তর প্রার্থনা করিতাম, কিন্তু সকলই নিষ্প্রাণ মনে হইত। অতঃপর এক আকস্মিক মুহূর্তে আমি আয়াতটি শুনিলাম:

وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَىٰ (এবং অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে এমন দান করিবেন যে, আপনি সন্তুষ্ট হইয়া যাইবেন।)

আমি থামিয়া গেলাম। আমি কাঁদিলাম। আমি ভাঙিয়া পড়িলাম। পরিস্থিতি পরিবর্তিত হইয়াছিল বলিয়া নহে—বরং আমি অবশেষে উপলব্ধি করিয়াছিলাম যে, আল্লাহ নিকটবর্তী থাকিবার জন্য পরিস্থিতির পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নাই। সেই আয়াতটি আমার জীবনরেখা হইয়া দাঁড়াইল। ইহা আজকের দিনে কোনো অলৌকিক ঘটনার প্রতিশ্রুতি ছিল না—বরং সন্তুষ্টি যে আমার তকদিরে ইতিমধ্যেই লিখিত হইতেছে, এই আয়াতটি ছিল তাহারই স্মারক।

এই সূরা কেবল আশ্বাসেই শেষ হয় নাই। ইহা সেই আশ্বাসকে কর্মে রূপান্তরিত করিয়াছে। ইহা বলিয়াছে:

فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ  وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ  وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ (সুতরাং আপনি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হইবেন না। এবং প্রার্থনাকারীকে ভর্ৎসনা করিবেন না। এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।)

যে স্বস্তি আমরা লাভ করি, তাহা কেবল আমাদের অন্তরে গুটাইয়া রাখিবার জন্য নহে। উহা উছলিয়া পড়িবার জন্যই। ইহা আমাকে শিক্ষা দেয় যে, ইবাদত কেবল নির্জনতা আর সিজদায় নহে—ইবাদত নিহিত রহিয়াছে কোমলতায়। অপরের বেদনাকে আমি কীভাবে ধারণ করিতেছি, তাহার মাঝে। সাহায্যপ্রার্থীকে আমি কীভাবে প্রত্যুত্তর দিতেছি, তাহার মাঝে। আমি যে নেয়ামত লাভ করিয়াছি, তাহা কীভাবে প্রকাশ করিতেছি—ঔদ্ধত্যের সহিত নহে, বরং গভীর কৃতজ্ঞতার সহিত—তাহার মাঝে। আরোগ্য লাভ কদাপি স্বার্থপর নহে। আমি যদি 'দুহা'-র উষ্ণতা অনুভব করি, তবে আমারও উচিত অন্যের তরে সেই আলোকরশ্মি হইয়া উঠা।

সূরা আদ-দুহা আমার নিকট কেবল কুরআনের একটি অধ্যায় নহে—ইহা এমন এক কথোপকথন, যাহাতে আমি ফিরিয়া যাই যখন কথা বলিবার ভাষা হারাইয়া ফেলি। ইহা এক পরম আশ্বাস যে, নীরবতাই গল্পের শেষ নহে। ইহা এক গভীর প্রত্যয় যে, বিলম্বের অর্থ বঞ্চনা নহে। আমি সূর্যোদয় দেখিতে পাইতেছি না, কেবল এই কারণেই যে সূর্য উদিত হইতেছে না, তাহা নহে। ইহা আমাকে বলে: যখন মনে হয় তোমার আর কিছুই অবশিষ্ট নাই, তখন স্মরণ করো সেই সত্তাকে, যিনি তোমাকে চিরকাল সকলই দান করিয়াছেন। ইহা আমাকে আল্লাহর উপর ভরসা করিতে শেখায়—কেবল তখন নহে যখন সকলই স্পষ্ট, বরং বিশেষ করিয়া তখন, যখন কিছুই স্পষ্ট নহে।

এবং হয়তো একারণেই সূরাটি এত ব্যক্তিগত—এত প্রিয়। ইহা আমার বিষাদকে লঘু করে না। আমার সংশয়কে তাড়াইয়া দেয় না। বরং ইহা বলে: "আমি দেখিতেছি। আমি তোমাকে দেখিতেছি।" ইহা যন্ত্রণাকে সবরের আবরণে আবৃত করে। ভয়কে ঈমানে রূপান্তরিত করে। এবং ইহার শেষ আয়াতগুলিতে, ইহা আমাকে আহ্বান জানায়, আমি যাহা প্রাপ্ত হইয়াছি তাহা যেন ধারণ করি এবং সম্মুখে প্রেরণ করি—কেবল দায়িত্ব হিসাবে নহে, বরং কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে। কারণ সেই আলো বিতরণের মাধ্যমেই আমি অপরকেও স্মরণ করাইতে পারি যে, তাহাদের সকাল আসিতেছে। কোনো রজনীই চিরস্থায়ী নহে। আল্লাহর কোনো প্রিয় আত্মাকেই তিনি সত্যই বিস্মৃত হন না। এবং আমি এই সত্যকেই আঁকড়াইয়া ধরি। রজনী যত দীর্ঘই হউক না কেন, 'দুহা'—পূর্বাহ্ণ—আসিবেই।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter