ইসলাম ধর্মে জুমার দিনের ফজিলত, মাহাত্ম্য ও আধুনিক প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য

ভূমিকা:

ইসলাম ধর্মে জুমার দিনকে ‘সপ্তাহের সেরা দিন’ বলা হয়েছে। এটি শুধু একটি সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন নয়, বরং এটি মুসলিম সমাজের একতা, সংহতি ও আত্মশুদ্ধির এক মহা উপলক্ষ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে জুমার দিনের ফজিলত ও মাহাত্ম্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত করা হয়েছে।ইতিহাস, ধর্মীয় অনুশাসন এবং আধুনিক সামাজিক বাস্তবতায় জুমার দিনের তাৎপর্য এক বিশেষ আলোচনার দাবী রাখে।

কুরআন ও হাদীসে জুমার মর্যাদা:

আল্লাহ তাআলা তার পবিত্র কুরআন শরীফের ইরশাদ করে দিয়েছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا نُودِىَ لِلصَّلَوٰةِ مِن يَوْمِ ٱلْجُمُعَةِ فَٱسْعَوْاْ إِلَىٰ ذِكْرِ ٱللَّهِ وَذَرُواْ ٱلْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ অর্থাৎ: হে ঈমানদারগণ, যখন জুমার দিনে নামাযের জন্য আযান দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে ত্বরান্বিত হও এবং বেচা-কেনা বন্ধ করে দাও। যদি তোমরা জানতে, তাহলে এটাই তোমাদের জন্য উত্তম! এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, জুমার দিন শুধু নামাজ নয়, বরং আত্মিক শুদ্ধি ও ইবাদতের প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তাআলার প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা(সা.) বলেন:

সূর্য যেদিন উদিত হয়েছে, সেই দিনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এদিন হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়।(সহীহ মুসলিম)

জুমার নামাজের সামাজিক তাৎপর্য

জুমার নামাজ মুসলিমদের জন্য একটি সাপ্তাহিক সমাবেশ। যেখানে সবাই একত্র হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে এবং খুৎবা শুনে, যা একধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষা কার্যক্রমের ভূমিকা রাখে। একজন ইমাম বা খতীব মুসলিম সমাজের চলমান সমস্যা, নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধন, মানবতা, ইনসাফ ও দায়িত্ববোধের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে খুৎবা দেন। এটি সমাজে এক ধরণের ঐক্য ও সচেতনতা সৃষ্টি করে।

জুমার দিনের আমল

জুমার দিন গুসল করা, পরিষ্কার পোশাক পরা, আতর ব্যবহার করা, আগেভাগে মসজিদে যাওয়া, সূরা কাহফ পাঠ, দরূদ শরীফ পাঠ ও অধিক ইস্তিগফার করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন:

জুমার দিন এক মুহূর্ত আছে, যেখানে যদি কোন বান্দা দোয়া করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করে নিবেন।(বুখারি ও মুসলিম).

আধুনিক প্রেক্ষাপটে জুমার তাৎপর্য

আধুনিক জীবনে মানুষ কর্মব্যস্ততায় ডুবে থাকে। ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশীলন অনেক সময় উপেক্ষিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে জুমার দিন একটি বিরাট সুযোগ এনে দেয়, যখন একজন মুসলিম সপ্তাহে অন্তত একবার আত্মিক বিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য নিজেকে আল্লাহর সামনে হাজির করতে পারে। এটি কাজের ক্লান্তি দূর করে এবং এক ধরণের আধ্যাত্মিক প্রশান্তি দেয়।

তাছাড়া, আধুনিক সময়ে অনেক দেশে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, জুমার নামাজ ও সমবেত খুৎবা তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতার বন্ধনকে আরও মজবুত করে।

জুমা নাম রাখার কারণ এবং ইসলামে এর সূচনা

জাহেলিয়াতের যুগে এই দিনটিকে ‘উরুবা’ বলা হতো। একটি বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রপিতামহ কা‘ব বিন লুয়াই এই দিনে কুরাইশদের একত্র করতেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিতেন। তিনি তাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের সুসংবাদ দিতেন এবং জোর দিয়ে বলতেন যেন তারা তাঁর উপর ঈমান আনে এবং তাঁর সাহায্যে কোনো ধরনের গাফিলতি না করে।

হযরত কাব বিন লুয়াই এই দিনের নাম রাখেন ‘ইয়াওমুল জুমা’ (সমবেত হওয়ার দিন), কিন্তু সে সময় এই নামটি জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। ফলে আরবরা তখন একে ‘ইয়াওমুল উরুবা’ বলেই ডাকতো। কা‘ব বিন লুয়াই ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের মাঝে প্রায় ৫৬০ বছরের ব্যবধান ছিল।

যখন মদীনার ভূমিতে ইসলামের সূর্য উদিত হলো, তখন তার আশপাশ আলোক অজ্জল হয়ে উঠলো হেদায়াত ও নূরের মাধ্যমে। মুসলিমরা সেই দিন একত্র হয়ে ইবাদত করতে শুরু করলো এবং তখন থেকেই এই নাম ‘ইয়াওমুল জুমা’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার কঠিন ও অজ্ঞতার অন্ধকারময় পরিবেশে নবুয়তের ঘোষণা দেন, তখন ধীরে ধীরে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অতঃপর যখন ইয়াসরিবের (মদীনার) ভূমিতে ইসলামের সোনালি আলো পৌঁছে যায়, তখন ইয়াসরিববাসীর ভাগ্য পরিবর্তন হয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর সেখানে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ইয়াসরিববাসীদের সিদ্ধান্ত ও প্রথম জুমার নামাজ

ইয়াসরিব (মদীনা) বাসীদের মনে হলো যে, তারা সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিন ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করে নেবে। যেমন ইহুদিরা শনিবারকে (ইয়াওমুস সাবত) ইবাদতের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছে এবং খ্রিস্টানরাও রবিবার একত্র হয়ে প্রার্থনা করে থাকে। তারা চিন্তা করলো, আমরা এমন একটি দিন নির্ধারণ করি যেদিন ছোট-বড় সবাই একত্র হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবো এবং তাঁর জিকির করবো।

এই উদ্দেশ্যে তারা তাদের সম্মিলিত ইবাদতের জন্য ‘ইয়াওমুল উরুবা’ (বর্তমানের শুক্রবার) দিনটিকে নির্বাচন করলো। এরপর সেই নির্ধারিত দিনে ইয়াসরিবের সকল মুসলমান একত্র হলেন এবং আসআদ ইবনে জারারা খুতবা প্রদান করলেন ও নামাজ আদায় করালেন।

এটাই ছিল ইয়াসরিবের মাটিতে আদায়কৃত প্রথম জুমার নামাজ।

উপসংহার

জুমার দিন শুধুমাত্র একটি নামাজের দিন নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক জীবনদর্শনের প্রতিফলন। ধর্মীয়ভাবে এটি যেমন ফজিলতপূর্ণ, তেমনি সামাজিকভাবে এটি ঐক্য, শিক্ষা ও প্রেরণার এক অসাধারণ প্ল্যাটফর্ম। বর্তমান বিশ্বে, যেখানে মানুষ ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক ও একাকী হয়ে পড়ছে, সেখানে জুমার দিনের সামষ্টিকতা ও আত্মিকতা নতুন দিগন্তের পথ খুলে দেয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter