ইসলামী মূল্যবোধ : লজ্জা নেই তো জীবন নেই
ইমাম শুবা ইবনুল হাজ্জাজ যখন ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছেন, তখন আবদুল্লাহ নামে রাস্তার একটি বখাটে ছোকরা তার গতিরোধ করে দাঁড়াল। এটা শুধু ছোকরার অপরাধ ছিল না, সে ছিল আসলে নির্লজ্জ। ইমাম শুবাহ বুঝতে পারলেন, আবদুল্লাহ যখন তাঁকে থামিয়ে দিয়েছে, সামনে আরো বিপদ অপেক্ষা করছে।
শুবাহ ইবনুল হাজ্জাজ (মৃত্যু ১০০ হিজরী) ‘আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন; এবং তিনি ছিলেন হাদীস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য পন্ডিত। আবদুল্লাহ তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে জানতে এবং এটাও জানি যে, তিনি একজন বিশিষ্ট হাদিস-শাস্ত্রবিদ; কিন্তু সে তাকে নিয়ে কৌতুক করার জন্য কৃতসংকল্প। দুই চোখে শয়তানী ও ভ্রুকুটি নিয়ে সে বলল, ‘শুবাহ, তুমি আমাকে একটি হাদিস শোনাও।’ ইমাম শুবাহ জবাবে বললেন, ‘এভাবে হাদীস শেখা যায় না।’ আবদুল্লাহ ভয় দেখাল, ‘তুমি আমাকে একটি হাদীস বল, না হলে …’। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে শুবাহ বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে একটি হাদীস শোনাচ্ছি। তারপর তিনি হাদীস রেওয়ায়েত-কারীদের ধারাবাহিক নাম বর্ণনা করার পর (ইসনাদ) হাদীসটি উল্লেখ করলেন, ‘‘তুমি যদি তোমার লজ্জা বিসর্জন দাও তখন তুমি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পার।’’
আবদুল্লাহর আচরণ মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল। এটা যেন এ রকম যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আবদুল্লার দুর্বৃত্তপনা ধরা ফেলেছেন এবং তাকে বলছেন, ‘আবদুল্লাহ তুমি যদি তোমার লজ্জা বোধ হারিয়ে ফেল তখন তুমি যেমন ইচ্ছা তা-ই করতে পার।’ সে ভয়ে কম্পিত হয়ে উঠল। সে স্বীকার করল যে, সত্যই তার উদ্দেশ্য ছিল অশান্তি সৃষ্টি করা। ‘এখন অনুগ্রহপূর্বক আপনার হাতখানা বাড়িয়ে দিন। আমি অনুশোচনা প্রকাশ করতে চাই।’ এই হাদীস একটি জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিল। রাস্তার একটি বাজে ছোকরা এই আবদুল্লাহ শিক্ষাগ্রহণ শুরু করল; এবং তারপর হয়ে গেলেন হাদীস-শাস্ত্রের একজন বিখ্যাত পন্ডিত। আজ তিনি শায়খ আবদুল্লাহ বিন মাসলামাহ কানাবী নামে সুপরিচিত। সিহাহ সিত্তাহ অর্থাৎ সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য যে ছয় খানা হাদীস গ্রন্থ, সেখানে এই আবদুল্লাহর নাম মাঝে-মাঝে চোখে পড়বে; বিশেষ করে ইমাম আবু দাউদ-এর সংকলন-গ্রন্থে। আর ইমাম আবু দাউদ নিজে তাঁর (আবদুল্লাহ) একজন প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন।
লজ্জা কী? লজ্জা বলতে কী বোঝায়? সাধারণভাবে ‘হায়া’ বা লজ্জার প্রতিশব্দ ইংরেজি অনুবাদে Modesty অথবা Inhibition (শালীনতা, সংযম, আত্ম প্রতিরোধ) কিন্তু এরকোনোটাই ঠিক ‘হায়া’র তাৎপর্য ফুটিয়ে তোলে না। Modesty বলতে বোঝায় অশিষ্ট আচরণ থেকে দূরে থাকা। যা এক ধরনের নিস্তেজ সংকোচ। আর এই জন্যই Modesty যে বিপরীতার্থক বিশেষণ immodest তা কখনও কখনও প্রশংসাসূচক Courage অর্থাৎ সাহস বা নির্ভীকতা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। Inhibition (সংযম বা আত্মপ্রতিরোধ)-এর সংজ্ঞা হল, চেতন বা অবচেতন এক ধরনের অর্ন্তনিহিত যান্ত্রিকতা যা অগ্রহণযোগ্য মানসিক প্রবণতা কে অবদমিত করে রাখে। এই সংজ্ঞা শুদ্ধ-অশুদ্ধ, ভুল অথবা নির্ভুল, ভালো বা মন্দের সঙ্গে সম্পর্কহীন খুবই নিরপেক্ষ একটি সংজ্ঞা। এজন্যই অনেকে লক্ষ করবেন, মনোচিকিৎসক তাদের রোগীদের জন্য Inhibition বা আত্ম প্রতিরোধে জয় করার ক্ষেত্রে সাহায্য করেন।
বিপরীত পক্ষে, এই সকল শব্দের মধ্যে বিদ্যমান যে-নৈতিক অস্পষ্টতা, সেখানে ‘হায়া’ বা লজ্জা সুস্পষ্টভাবে একটি পরম কাঙ্খিত নৈতিক গুণের কথা বলে, যা আমাদেরকে সকল মন্দ ও পাপকার্য ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা (Protection) দান করে। কোনো অপরাধ কর্মে নিয়োজিত হওয়ার কথা ভাবলেই-যে আমরা ভেতরে-ভেতরে কষ্ট ও অস্বস্তি অনুভব করি, এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতারই ফল। যাই হোক, বাচিক অর্থের অতিরিক্ত যে-গভীর নৈতিক ব্যঞ্জনা, ইসলামের ‘হায়া’ বা লজ্জা সেই ব্যঞ্জনা পরিস্ফুট করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :‘প্রত্যেক ধর্মের একটি স্বতন্ত্র নৈতিক আহ্বান আছে, ইসলামের নৈতিক আহবান হল হায়া। (সুনানে ইবনে মাজাহ-হাদীস : ৪১৭১)
অন্য একটি বিখ্যাত হাদীস বলছে :
‘‘ঈমানের সত্তরটির বেশি শাখা রয়েছে; তার মধ্যে সর্বাগ্রে হল এই ঘোষণা যে, আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপাস্য নাই; আর সর্বনিম্নে হল রাস্তা থেকে কোনো ক্ষতিকর বস্ত্তকে সরিয়ে দেওয়া। এবং ‘হায়া’ (লজ্জা) হল ঈমানের একটি শাখা।’’(সহীহ মুসলিম-হাদীস : ৫১)
অনেক মুহাদ্দিস (হাদিস-শাস্ত্রবিদ) উল্লেখ করেন, সত্তর যে-সংখ্যা সেটা গাণীতিক। প্রকৃতপক্ষে এই হাদিসে যা-বলা হয়েছে তা হল, বিশ্বাসের ঘোষণা ঈমানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ; কিন্তু সেটাই সব নয়। বাস্তব জীবনের বহু চিন্তা-কর্মের মধ্যে ঈমানের স্বরূপ প্রতিফলিত হয়। অধিকন্তু ঈমানের যে-দাবি, ‘হায়া’ হল আমাদের সে-সকল অধিকাংশ কাজের সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় সারবস্ত্ত। ইসলামী নৈতিকতার যে- সৌধ, হায়া হল তারই মূল ভিত্তি। যখন এটা (হায়া) হারিয়ে যায়, তখন সবই হারিয়ে যায়।
উল্লেখযোগ্য, এই ধরনের শিক্ষার ভিত্তিতে এমন এক বিস্ময়কর ও বহুমাত্রিক নৈতিক-বিপ্লব সাধিত হল, ‘হায়া’ বা লজ্জা যার ভিত্তিপ্রস্তর, অপরিহার্য উপাদান। ইসলাম-পূর্ব আরবের জাহেলী-সমাজে শব্দটি অপরিচিত ছিল না, কিন্তু সে সমাজের মানুষ কথাটির অর্থ বুঝত না। হায়া-র সম্পূর্ণ বিপরীত যে নগ্নতা, সেটা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল না; এই উলঙ্গপনা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা যে-তাওয়াফ (কাবা শরীফের চতুর্দিকে পরিভ্রমণ) সেই তাওয়াফ-এর অংশ। অতএব অন্যসব কত-যে পাপকর্ম এই অবাধ লজ্জাহীনতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসলাম সে-সকল পাপ ও অপরাধকর্ম উৎখাত করে দিয়ে এমন এক সম্পূর্ণ নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করল, যে-নব-রূপান্তরিত সমাজে ‘হায়া’ হয়ে উঠল এক প্রীতিকর মূল্যবোধের অভিব্যক্তি।
আজও বিশ্বব্যাপী প্রতি শুক্রবার যে-জুমআর খুতবা প্রদান করা হয় সে খুতবায় তৃতীয় খলিফা সাইয়্যিদিনা হযরত উসমান রা.-এর কথা উল্লেখ করা হয় যে, তিনি ছিলেন সর্বাধিক লজ্জাশীল (আসদাকুহুম হায়া)। আছে-কি এমন কোনো ধর্ম, যেখানে ‘হায়া’ এত-বেশি উচ্চমূল্যে গৃহীত ও অভিনন্দন হয়?
ইসলামে যে-হিজাবের বিধান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষেত্রে ইসলামের যে-নিষেধ, পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক বিষয়ে ইসলামের যে-শিক্ষা, তা-সবই হায়া-র সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। যে-সকল পুরুষ ও নারী তাদের হায়া বা লজ্জা শীলতা হারিয়ে ফেলেনি, লজ্জা ও সম্ভ্রমের কী-মূল্য ও তাৎপর্য, সেটা তাদের কাছে সহজেই ধরা দেয়। ইসলামের প্রথম যুগের একজন নারীর একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা। এই মহিলা জানতে পারলেন যে, তার যুবক-পুত্র জিহাদে শাহাদাত বরণ করেছে। তিনি সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ছুটে চলেছেন; কিন্তু গৃহ থেকে বহির্গত হওয়ার আগে কিছু সময় নিয়ে তিনি নিজেকে সম্প্রতি নাযিলকৃত হিজাবের বিধান অনুযায়ী যথাযথভাবে আবৃত করে নিলেন। অনেকে জিজ্ঞাসা করল, এমন একটি হৃদয়বিদারক সংবাদ পাবার পর তিনি হিযাব-রক্ষা করার মতো সময় পেলেন কী-করে? জবাবে মহিলা বললেন, ‘আমি আমার সন্তান হারিয়েছি কিন্তু আমার হায়া আমি হারাইনি।’
যাই হোক, পরবর্তীকালে শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলিম সমাজে এই হায়া ও লজ্জাশীলতা ও সমভ্রমবোধ অক্ষত ছিল। কিন্তু তারপর, মাত্র তিন শতাব্দী আগের কথা, মুসলিম দেশগুলি যখন একে-একে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ হয়ে পড়ল, তারা এমন এক সভ্যতার মুখোমুখি হল, যার সাথে হায়া বা লজ্জাশীলতার প্রশ্নে ইসলামপূর্ব জাহেলী-সমাজের আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। এই নবাগত পশ্চিমা-সভ্যতার কাছে কোনো উৎকৃষ্ট নৈতিক গুণ ছিল না, ছিল শুধু উৎকৃষ্ট বন্দুক। আর এই বন্দুকের জোরে তাদের যে-সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম সমাজ প্রায় সামষ্টিকভাবে আমাদের এতদিনের লালিত হায়া বা লজ্জাশীলতার ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলতে বসল। পশ্চিমাদের শক্তিশালী ও প্রলুব্ধকর প্রচার হয়ে উঠল এই যুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার। প্রথমে বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্র দিয়ে শুরু, তারপর এল রেডিও, আর এখন টেলিভিশন।
সবকিছু একত্রে ও একযোগে এমন- সব ধারণা ও মনোভাবের প্রসার ঘটিয়ে তুলল, যা ছিল হায়ার জন্য খুবই ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক। তারা সুন্দরী ও অশ্লীলতাকে করে তুলল হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয়। আর বেহায়াপনার এই গতি অভাবনীয়রূপে বৃদ্ধি পেল টেলিভিশনের কারণে; যা পূর্ববর্তী সকল সম্মিলিত প্রচারের চেয়ে বহুগুণ ক্ষমতাধর ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। আর এখন-তো ইন্টারনেট, যা-এখন অশ্লীলতার যোগানদার হিসেবে টেলিভিশনের প্রতিদ্বন্দী।
একদিন যখন ঐতিহাসিকরা বিংশ-শতাব্দীতে মুসলিম সমাজের নৈতিক পতনের কথা তুলে ধরবে, তারা সম্ভবত সমাজের নৈতিক-বন্ধন ধ্বংস করার ক্ষেত্রে টেলিভিশনের অশুভ ভূমিকার কথাই সর্বাগ্রে ব্যক্ত করবেন। আমাদের দ্রুত গতি পতনের চিত্র কী ভয়াবহ, তা বহুলাংশে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখি, যা-মাত্র দশ বছর আগেও ছিল অচিন্তনীয়, আজ তা সাদরে গৃহীত হয়েছে। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। এই তথ্য কি সীমাহীন রূপে ভীতিজনক নয় যে, টিভি-তে গর্ভনিরোধক দ্রব্যের বিজ্ঞাপন যেখানে বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ, সেখানে এই বিজ্ঞাপন অবাধে প্রচার ও প্রদর্শন করছে ইসলামী রিপাবলিক অব পাকিস্তান?
এই জলাবদ্ধ নোংরা অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি ও পরিত্রাণ লাভ করতে পারি, আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক সমাজ জীবনে ‘হায়া’ অর্থাৎ লজ্জাবোধকে এক-নম্বর বিবেচনার বিষয় বলে গ্রহণ করি। ইসলামী-নৈতিকতা ছাড়া ইসলামী জীবন হয় না; আর ‘হায়া’ ছাড়া ইসলামী-নৈতিকতার কোনো অস্তিত্ব নেই।