এক কুকুরের ক্ষুধা, এক খলিফার জবাবদিহি’: নেতৃত্বের প্রকৃত সংজ্ঞা

ভূমিকা: আজ ন্যায় কোথায়? এক প্রশ্ন এক প্রত্যাবর্তন

আজ আমরা নেতৃত্বকে কীভাবে বিচার করি? কথার জোরে নাকি নেতাদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে? গণতন্ত্র আমাদের বলেছে, "জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য।" কিন্তু বাস্তব চিত্রে আমরা দেখছি, সরকার জনগণের জন্য নয়, বরং জনগণের উপরে। প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু প্রতিফলন নেই। ভোটের আগে নেতাদের মুখে থাকে উন্নয়নের ভাষা, ভোটের পর সেটা হারিয়ে যায় তাদের বিশাল প্রাসাদ ও পুঁজিবাদী দম্ভের আড়ালে। এই সমাজে আইন ধনীর জন্য নমনীয়, গরিবের জন্য নির্মম। নেতৃত্ব মানে এখন একচেটিয়া ক্ষমতা, বিলাসিতা ও আত্মপ্রেম। আর জনগণ? তারা শুধু ব্যবহারের বস্তু — পাঁচ বছর পর পর ভোটের সারিতে দাঁড়ানো হাতগুলো।

এইখানেই প্রশ্ন আসে  এটাই কি নেতৃত্ব? এটাই কি ন্যায়? আমরা যদি ইতিহাসের পাতায় ফিরে তাকাই, সেখানে দেখি এমন এক শাসক, যাঁর রাত্রি কাটতো উপবাসী মানুষের জন্য খাবার বহনে, যিনি বলতেন

“যদি ফোরাত নদীর পারে একটি কুকুরও ক্ষুধায় মারা যায়, তবে কিয়ামতের দিনে উমর দায়ী হবে”।

তিনি ছিলেন হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রাঃ), ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, যাঁর শাসনব্যবস্থা ছিল শুধু ন্যায়ভিত্তিকই নয়, বরং মানবতার সর্বোচ্চ উদাহরণ।

এই প্রবন্ধে আমরা তুলনা করবো, আজকের আধুনিক গণতন্ত্র বনাম উমর (রাঃ)-এর খিলাফত কে বেশি ন্যায়নিষ্ঠ, কে বেশি মানবিক?

একদিকে ভোটে জেতা ক্ষমতা, অন্যদিকে আল্লাহর ভয়ে কাঁদা খলিফা।
একদিকে শাসক প্রাসাদে, অন্যদিকে খলিফা রাত্রে গরিবের পাশে।

নেতৃত্বের ভিত্তি: ক্ষমতা না দায়িত্ব?

গণতন্ত্রে নেতৃত্ব আসে নির্বাচনের মাধ্যমে। প্রার্থী নিজেই দাঁড়ান, নিজেই প্রচারণা চালান, আর জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চান। যদিও এটি “জনভিত্তিক” শাসন বলে দাবি করা হয়, বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এটি “ক্ষমতার প্রতিযোগিতা”তে রূপ নেয়। জনপ্রিয়তা, পুঁজিবাদী মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দানবত্বের উপর দাঁড়িয়ে থাকে এই সিস্টেম যেখানে নেতৃত্ব মানেই এক ধরণের ক্ষমতার আসন।

হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসনে কিন্তু নেতৃত্ব ছিল একেবারেই ভিন্ন ধারার।
তিনি নেতৃত্বকে বলতেন “আমানত” — এক তীব্র বোঝা, যা কাঁধে নিলেই জবাবদিহি শুরু হয় আখিরাতে। তাঁর নিজের ভাষায়:

“আমার নেতৃত্বের জন্য যদি একটি গাধাও না খেয়ে মরে, তবে আমি নিজেকে দায়ী ভাবি।”

যখন তাঁকে খলিফা বানানো হয়, তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন — কারণ তিনি জানতেন এর অর্থ শুধু সিংহাসনে বসা নয়, বরং একেকটি মানুষের অভাব, নিরাপত্তা, শিক্ষা ও অধিকার তাঁর জিম্মায় পড়ে যাবে।

আজকের গণতান্ত্রিক নেতারা যখন নিজেদের পরিচয় দেন ‘জনপ্রতিনিধি’ হিসেবে, উমর (রাঃ) নিজেকে বলতেন ‘জনসেবক’।
তিনি বলতেন 

 “আমি যদি দিনে কাজ করি না, তবে রাত্রে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে পারবো না।”

এই দৃষ্টিভঙ্গিই নেতৃত্বের সত্যিকারের অর্থ  দায়িত্ব, আত্মত্যাগ আর আল্লাহভীতির মধ্যে ভারসাম্য।

 জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা 

গণতন্ত্রের একটি বড় গর্বের জায়গা হচ্ছে “জবাবদিহিতা”। সংবিধান, মিডিয়া, বিরোধীদল ও নাগরিক সমাজ — সব কিছু মিলে সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনার কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কি সত্যিই এমন?

আজকের শাসকগোষ্ঠীর কাছে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার প্রায় অসম্ভব। প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেটি চাপা পড়ে যায় আমলাতন্ত্র আর সময়ক্ষেপণের জালে। দুর্নীতির মামলা চলে বছর বছর, কিন্তু রায় আসে না — কারণ উচ্চ ক্ষমতা বলয়ের সঙ্গে তাদের সখ্যতা।

উমর (রাঃ)-এর যুগে জবাবদিহিতা ছিল জীবন্ত, সরাসরি এবং স্বতঃস্ফূর্ত।
খলিফা হয়েও তিনি ছিলেন জনগণের সামনে সর্বদা উন্মুক্ত। কোনো প্রাসাদে থাকতেন না। একবার এক বয়স্ক লোক প্রশ্ন করলেন:

“উমর! তুমি যে জামা পরেছো, তা এত বড় হলো কীভাবে? আমাদের সবার ভাগ তো ছোট!”

উমর (রাঃ) সাথে সাথে দাঁড়িয়ে বললেন:

“আমার ছেলের অংশ দিয়ে আমি জামাটা সম্পূর্ণ করেছি।”
এই উন্মুক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন  শাসক যদি সত্যিকার অর্থে আমানতদার হন, তাহলে তাঁর জীবনে লুকোচুরি থাকবে না।

তিনি গভর্নর নিয়োগ দেওয়ার সময় বলতেন:

“তুমি কোনো জাতির ওপর শাসন করছো না, বরং আল্লাহর বান্দাদের সেবা করতে যাচ্ছো।”

আজকের শাসকগণ যদি উমর (রাঃ)-এর এই মনোভাব ধার করতেন, তবে গণতন্ত্র শুধু শব্দে নয়, বাস্তবেও হতো জনগণের জন্য কল্যাণকর।

আইনের চোখে সবাই সমান — কেবল কাগজে না, বাস্তবে

গণতান্ত্রিক সংবিধানে লেখা থাকে “আইনের চোখে সবাই সমান” । কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা।
সাধারণ গরিব মানুষের জন্য আছে পুলিশের কঠোরতা, আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়া আর সমাজের অবহেলা। অপরদিকে, ক্ষমতাবান, ধনী কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের অধিকারীরা প্রায়ই আইনের ঊর্ধ্বে রয়ে যায়। তারা বিচারের মুখোমুখি হলেও সাজা পায় না — বরং আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়, বা মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর।

উমর (রাঃ)-এর শাসনে এই ব্যবস্থাটা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো।
আইনের সামনে তিনি ছিলেন একেবারে নির্মম চেনা-অচেনা, আত্মীয়-পর, ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ ছিল না।

তাঁর নিজের ছেলেকে যদি অপরাধে দোষী প্রমাণ করা হতো, তাকেও শাস্তি দিতেন।
একবার এক গভর্নর, যিনি স্থানীয় এক ব্যক্তিকে চাবুক মেরেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে উমর (রাঃ) বলেছিলেন:
“তুমি দুনিয়ায় তাকে আঘাত করেছো, এখন কিয়ামতের দিনে সে তোমার থেকে বদলা নেবে।”
তারপর জনসাধারণের সামনে সেই ব্যক্তিকে চাবুক মারার সুযোগ দেন, গভর্নরকে।

তিনি বলতেন 

“তোমরা মানুষকে দাস বানিয়ে ফেলো কীভাবে, অথচ তাদের মা জন্ম দিয়েছে মুক্ত হিসেবে?

এই ছিল উমর (রাঃ)-এর ইনসাফ — যেখানে আইন ছিল সর্বজনীন, আর ন্যায় ছিল নিরপেক্ষ।

গণতন্ত্রে আইনের শাসন কেবল প্রিন্টেড কাগজে সীমাবদ্ধ। কিন্তু উমর (রাঃ)-এর খিলাফতে আইন ছিল মানুষের রক্তে, মননে ও কার্যক্রমে জীবন্ত — যেটা আজকের সভ্যতা শুধু কামনা করে, অর্জন করতে পারে না।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স

আজকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি যেন একটা অদৃশ্য রক্তচোষা — দেখাও যায় না, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে, অথচ ধ্বংস করে ফেলে জাতির ভিতর থেকে। প্রতিটি স্তরে ঘুষ, আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার নিত্যদিনের চিত্র। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’র কথা বলা হলেও, কার্যত সেটা কেবল রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ।
  প্রশাসনিক পদে বসেই অনেকেই রাতারাতি বিলিয়নিয়ার হয়ে যায়  অথচ বিচার হয় না।

হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতির কোনো স্থানই ছিল না।
তিনি একদম শুরু থেকেই কঠোর মনোভাব নেন:

প্রতিটি গভর্নরের সম্পদের তালিকা সংরক্ষণ করতেন
তাদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণে রাখতেন
যদি কারো সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তো, তিনি বলতেন

“তুমি রাষ্ট্রের টাকায় নিজের ঘর ভরেছো, এখন তা বায়তুল মাল এ ফেরত দাও।”

একবার এক গভর্নরের স্ত্রী বেশি দামী অলংকার পরে ফিরলে উমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “এই গহনার উৎস কী?”
  উত্তর সন্তোষজনক না হওয়ায় তিনি সেটি রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দিতে বলেন।

আরও চমকপ্রদ ঘটনা:
উমর (রাঃ) তাঁর এক ছেলে ব্যবসা করতে গিয়ে রাজকোষের সুবিধা নিয়েছিল   তখন তিনি বললেন:
“তোমার লাভ বৈধ নয়। তুমি রাষ্ট্রের সুবিধা নিয়েছো। সব ফেরত দিতে হবে।”

এইরকম কঠোরতা, আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান   আজকের গণতান্ত্রিক শাসকদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়।

উমর (রাঃ)-এর কাছে রাষ্ট্র মানে ছিল আমানত, আর দুর্নীতি মানে ছিল আল্লাহর সামনে চরম বিপদ।

সংখ্যালঘু অধিকার ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

গণতন্ত্র নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সকল সম্প্রদায়ের জন্য সমান বলে দাবি করে। তবে বাস্তবে অনেক সময় আমরা দেখি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শুধু নির্বাচনী হিসাবের একটা সংখ্যা মাত্র। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ নির্বিশেষে, সকল ধর্মের মানুষ নিরাপদে বাস করবে — এটাই গণতন্ত্রের মূলনীতি হলেও, দাঙ্গা, বৈষম্য, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার ইত্যাদি এই মূলনীতিকে প্রতিনিয়ত কলঙ্কিত করে চলেছে।

অপরদিকে, হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসন ছিল ধর্মীয় সহনশীলতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
তাঁর শাসিত এলাকায় ইহুদি, খ্রিস্টান, জরথুস্ট্রবাদী ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা পূর্ণ নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত।

জেরুজালেম বিজয়ের পর তিনি কোনো গির্জায় নামাজ পড়েননি, যাতে ভবিষ্যতে কেউ বলার সুযোগ না পায় যে— মুসলমানরা গির্জা দখল করেছে।
তিনি খৃষ্টানদের লিখিত নিরাপত্তা দিয়েছিলেন, যা ইতিহাসে "উমারী চুক্তি" নামে পরিচিত।
এতে তিনি বলেন:

“তাদের উপাসনালয় ভেঙে ফেলা হবে না, ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া হবে না, তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে।

এই সহিষ্ণুতার ভিত্তি কোরআনের এই আয়াত:

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ 

"ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।"
(সূরা আল-বাকারা, ২:২৫৬)

তিনি সব ধর্মের মানুষকে সমান মর্যাদায় দেখতেন। ইবনে কাসীর বলেন, “উমর (রাঃ)-এর আমলে এতবেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল যে, অমুসলিমরাও তাঁকে নিজেদের রক্ষক মনে করত।”

এখানেই গণতন্ত্র আর খিলাফতের পার্থক্য পরিষ্কার হয়:
গণতন্ত্র সহিষ্ণুতার প্রতিশ্রুতি দেয়, উমর (রাঃ) সহিষ্ণুতা বাস্তবে দেখিয়েছেন।

অর্থনীতি ও জনকল্যাণে সমতা

গণতন্ত্রের এক বড় দাবি হচ্ছে—সকলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখানে উন্নয়নের সুবিধা কেবল গুটিকয়েক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ধনীরা আরও ধনী হয়, আর গরিবেরা থেমে থাকে জীবনধারণের লড়াইয়ে। সরকারি প্রকল্প, ভর্তুকি বা পেনশন সুবিধা—সবই প্রায়শই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। ফলে “সাম্য” কেবল কাগজে রয়ে যায়, বাস্তবে নয়।

উমর (রাঃ)-এর অর্থনৈতিক নীতি ছিল অভূতপূর্ব ও বাস্তবিক অর্থে কল্যাণমুখী।
তিনি রাষ্ট্রের সম্পদকে জনগণের হক মনে করতেন, এবং তার সঠিক বণ্টনে ছিলেন আপসহীন।

তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “বায়তুল মাল” — ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগার, যা কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, বরং জনসাধারণের হক।
উমর (রাঃ) প্রত্যেক নাগরিকের জন্য খাদ্য, বাসস্থান ও পোশাক নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেন।
এতিম, বিধবা, বৃদ্ধ, অক্ষম এমনকি নবজাতক শিশুর জন্যও ছিল মাসিক ভাতা।

একবার এক মা রাতে শিশুদের না খাইয়ে ঘুম পাড়াতে চাইছিলেন, রান্নার হাঁড়িতে পাথর ফুটিয়ে। উমর (রাঃ) খবর পেয়ে নিজে খাদ্য নিয়ে তার ঘরে যান। তার চেহারার ঘাম আর বোঝা বহনের কষ্ট দেখে এক সঙ্গী বলেন:

“আমাকে দিন, আমি নিয়ে যাই।”
উমর (রাঃ) উত্তর দেন:
“তুমি কি কিয়ামতের দিন আমার বোঝা বহন করবে?”

এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে আলাদা করে তোলে।

আজকের রাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণে বিশ্বাস করত, তবে উমর (রাঃ)-এর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করাই হতো একমাত্র পথ।

জনগণের কথা শোনার প্রক্রিয়া

গণতন্ত্রের মূল ধারণা হলো—নেতারা জনগণের প্রতিনিধি। কিন্তু নির্বাচনের পর এ সম্পর্ক অনেকটাই একমুখী হয়ে যায়। নেতারা হয়ে ওঠেন দুর্লভ; সাধারণ মানুষের কণ্ঠ প্রায়শই শোনা হয় না, বরং উপেক্ষিত থাকে।

উমর (রাঃ)-এর আমলে কিন্তু জনগণই ছিলেন প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু
তিনি দিনের বেলায় প্রশাসনিক কাজ করতেন, আর রাতে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। তাঁর শাসন মানে ছিল “শুনো, বোঝো, কাজ করো”।

একবার এক নারী মসজিদে তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললে তিনি বলেন:

“এক নারী সঠিক, উমর ভুল করেছে।”

তিনি মাসজিদে খোলা দরবার বসাতেন, যেখানে যেকোনো ব্যক্তি অভিযোগ জানাতে পারতো—কোনো অনুমতি বা পরিচয়ের প্রয়োজন ছাড়াই। গভর্নর, সেনাপতি এমনকি নিজ ছেলেকেও তিনি তিরস্কার করতেন যদি প্রজারা অভিযোগ আনত।

এই ছিল শাসকের আসল পরিচয় —
ক্ষমতার আড়ালে নয়, মানুষের পাশে।

আজ যদি আমাদের নেতারা এইরকম শুনতে পারতেন, তাহলে "গণতন্ত্র" শব্দটা কেবল বইয়ের পাতায় নয়, মানুষের জীবনে প্রাণ পেত।

নারী অধিকার — বাস্তবে, প্রচারে নয়

আজকের গণতন্ত্র নারীর অধিকারের কথা বলে, নারী দিবস পালন করে, কিন্তু বাস্তবে বহু নারীর জীবন কেবলই নির্যাতন, অবহেলা আর বঞ্চনার গল্প। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি — এসব আজও অনেক নারীর নিত্যদিনের বাস্তবতা।

হযরত উমর (রাঃ) নারী অধিকারকে শুধু ভাষায় নয়, বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তিনি নারীদের উত্তরাধিকার, সম্পদ ও মতামতের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন।
একবার খুতবায় তিনি মহরের সীমা নির্ধারণ করতে চাইলেন।
  

সঙ্গে সঙ্গে এক নারী দাঁড়িয়ে বললেন:
আপনি কীভাবে সীমা নির্ধারণ করেন, যেখানে আল্লাহ তাআলা কোরআনে কোনো সীমা দেননি?
(সূরা নিসা ৪:২০)

উমর (রাঃ) সাথে সাথে নিজের সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেন এবং বলেন:

 “এ নারী ঠিক বলেছে, উমর ভুল করেছে।”

এছাড়াও, তিনি বিধবা ও অসহায় নারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা চালু করেন, পল্লী অঞ্চলগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, এবং নারীদের ইজ্জত রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ করেন।

তিনি নারীদের মর্যাদা দিয়েছেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, দয়া নয়—অধিকার হিসেবে।

আজকের সমাজ যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি নিত, তবে নারী-পুরুষ সবাই সত্যিকার অর্থেই সমান মর্যাদার আসনে পৌঁছাতে পারত।

  শেষের কোট:

قَدْ كُنَّا أَذَلَّ قَوْمٍ فَأَعَزَّنَا اللَّهُ بِالْإِسْلَامِ

"আমরা ছিলাম সবচেয়ে লাঞ্ছিত জাতি; আল্লাহ আমাদের ইসলাম দিয়ে সম্মান দিয়েছেন।"
— হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রাঃ), (সূত্র: হাদীস সংকলন — আল হায়সামী, মজমাউয যাওয়ায়েদ)

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter