উসমানীয় সাম্রাজ্যের উৎপত্তি এবং প্রাথমিক বিকাশ

উসমানীয় সাম্রাজ্যের উৎপত্তি সম্পর্কিত ইতিহাস উসমান প্রথম (মৃ. ১৩২৪), তাঁর পিতা এরতুগ্রাল গাজী (মৃ. ১২৮০) এবং দাদা সুলাইমান শাহের (মৃ. ১২২৭) সঙ্গে বেশিরভাগ যুক্ত করা হয়।[1] যাইহোক, এই বিরাট সাম্র্রাজের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা উসমান থেকে মুহাম্মদ দ্বিতীয় (মৃ. ১৪৮১) পর্যন্ত টানা সাতটি শাসকের সাথে মিলিত। পরপর তিনজন শাসক বায়েজিদ দ্বিতীয় (মৃ. ১৫১২), সেলিম প্রথম (মৃ. ১৫২০) এবং কানুনি সুলতান সুলাইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট (মৃ. ১৫৬৬) সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অবশেষে, সাম্রাজ্যের উৎপত্তি এবং এর ক্রমবর্ধমান বিকাশ একটি দীর্ঘ ইতিহাসে শনাক্ত করা যেতে পারে।

   উসমানীয় সাম্রাজ্য ঐতিহাসিকভাবে ১৩ থেকে ২০ শতক (১২৯৯-১৯২৩) পর্যন্ত একটানা ছয় শতাব্দী ধরে শাসন করেছে।[2] স্পষ্টতই, এটি ভিত্তিমূলক দৃঢ়তা এবং একত্রীকরণের বিষয় যা এই রাষ্ট্রকে এত দীর্ঘ সময়ের জন্য বিশ্বের একটি এক বড়ো শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে রাখে।পনেরো এবং ষোড়শ শতাব্দীর সময়, উসমানীয় সাম্রাজ্যের তিনটি মহাদেশ যথা এশিয়া মাইনর, উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ইউরোপের একটি বিশাল অঞ্চলজুড়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল। যাযাবরে-পরিণত-ইসলামী সাম্রাজ্য সেই দীর্ঘ সময়ের পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বমানের সেনাবাহিনী পরিচালনা করে। এই মহান রাষ্ট্রের আবির্ভাবের পিছনে বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে - বেঁচে থাকা থেকে অভিবাসন পর্যন্ত, জীবন বাসস্থান থেকে ভূমি একত্রীকরণ এবং ভিত্তি থেকে প্রতিষ্ঠা, এবং ইতিহাসের আরও অনেক কথা।

   গৌরবকাল যেমন দীর্ঘ ছিল, তেমনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন-সময়রেখাও এত দীর্ঘায়িত যা তার স্বর্ণযুগকে দুয়াঁশা করে দেয়। অচলাবস্থার পর্যায় ১৭ শতকে শুরু হয়ে ২০ শতকের প্রথম দিকে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ ভাঙ্গন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বলা যেতে পারে যে, সালতানাত তার শিকড়ের মধ্যে এত শক্তভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে বিরোধীশক্তিকে তা উৎপাটন করতে অনেক সময় লাগে। তাহলে, কোন উপকরণে এবং কেমনভাবে উসমানীয় সাম্রাজ্যের উৎপত্তি এবং প্রাথমিক বিকাশ হয়েছিল যা তাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে কৃতিত্ব দেয়? ভূখণ্ডে বিশাল সম্প্রসারণের সত্ত্বেও কীভাবে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল যে দীর্ঘ ঐতিহাসিক সময়ের জন্য স্থায়ী, অটল এবং অবিচলিত থাকে?

জাতিসত্তা: ওঘুজ তুর্কি

বিভিন্ন সূত্র অনুসারে ঐতিহ্যগতভাবে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান প্রথম ওঘুজ তুর্কিদের কায়ি উপজাতির সাথে সম্পর্কিত, যদিও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতামতে ভেদাভেদ আছে। ওঘুজ বলতে তুর্কি জনগণের একটি জাতিগত গোষ্ঠী যা ২০০০ খ্রিস্টপূর্বের ওঘুজ খান বা খাগানের বংশোদ্ভূত কয়েকটি উপ-শাখা এবং ক্ষুদ্র-উপজাতি নিয়ে গঠিত।

   কিছু চীনা পাণ্ডুলিপি সহ বিভিন্ন ঐতিহ্যে উল্লেখ রয়েছে যে ওঘুজ খাগানের বংশতালিকা কারা খানের সাথে যুক্ত (যেখানে কারা খান তুর্ক থেকে এবং তুর্ক ইয়াফেসের বংশধর)। ওগুজ খান মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তাঁর পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত করে দেন ফলে সাম্রাজ্যের বিভাজন ঘটে।

   খ্রিস্টীয় ১১ শতক পর্যন্ত, তারা সাধারণত মঙ্গোলিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল। মধ্য এশিয়া এবং আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের অনেক প্রধান উপজাতির উৎপত্তি ওঘুজ তুর্কিদের সাথে জড়িত। এমনকি বেশ কিছু ঐতিহাসিক রাজ্য যেমন সেলজুক (কিনিক শাখা), অনুস্তাগিন পরিবার ইত্যাদি মূলত ওঘুজের জাতিসত্তার সাথে যুক্ত। অনুরূপ কিছু নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক উৎস তুর্কি ওঘুজের মূলধারার জাতিসত্তার সাথে প্রথম উসমান-এর কায়ি উপজাতির সংঘের কথা বলে।

কায়ি উপজাতি

উপরে উল্লিখিত মতামত হিসাবে, এরতুগ্রালের পুত্র উসমান কায়ি উপজাতির সাথে যুক্ত যা জাতিগত অনুসারে ওঘুজ। আক্ষরিক অর্থে ‘কায়ি' মানে ‘শক্তিশালী’। উপজাতি সদস্য তুলনামূলকভাবে প্রভাবশালী এবং শক্তিশালী থাকায় এই নামকরণ।

   এরতুগ্রালের পিতা সুলাইমান শাহের নেতৃত্বে, কায়ি উপজাতি মঙ্গোলদের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ থেকে বাঁচতে মধ্য এশিয়া থেকে এশিয়া মাইনরে অভিপ্রয়াণ করে। আধুনিক ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নাম কাইয়ের সাথে যুক্ত বলে অনেকে প্রস্তাব রাখে, তবে এর কোনো ঐতিহাসিক সমর্থন নেয়। যাইহোক, আজও কায়ি সদস্যদের আনাতোলিয়া, তুর্কমেনিস্তান এবং অন্যান্য বলকান অঞ্চলে বসবাস করতে দেখা যায়।

প্রাক-সাম্রাজ্য উপাদান

উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস বর্ণনার সময় ইতিহাসবিদরা উসমান প্রথমের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষদের ভূমিকা শীঘ্রই তুলে ধরেন, যেখানে তাঁর পিতা এবং পিতামহ স্পষ্টভাবে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে বিশাল অগ্রগতি দেখিয়ে গেছিলেন। তাছাড়া আঞ্চলিক শাসক, সেনাপতি এবং সেনাপ্রধান সহ তাদের সহায়তা এই রাজবংশের সূচনার জন্য অনিবার্য ছিল। অসাবধানতাবশত, তাদেরকে সাম্রাজ্যের মূলধারার ইতিহাসের পিছনে ফেলে দেওয়া হয় যা ব্যাখ্যাতীতভাবে প্রাক-সাম্রাজ্যের ইতিহাস বলা যেতে পারে।

সুলাইমান শাহ (মৃ. ১২২৭)

কায়ি ত্রাণকর্তা সুলেইমান শাহ নিজ উপজাতিকে মঙ্গোলদের আক্রমণ থেকে সফলভাবে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ইতিহাসে আজও স্বরণীয় যেখানে অন্যান্য সমসাময়িক বেশিরভাগ মুসলিম রাজ্যগুলি নিরস্ত হয়ে পড়েছিল।

   সুলাইমান শাহ ১৩ শতকের তুর্কি কায়ি গোত্র প্রধান ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়া খুরাসান থেকে আনাতোলিয়ার নিকটবর্তী আর্মানিয়া পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক উপজাতির লোকদের পরিচালিত করেন। অন্যদিকে আবার এশিয়া মাইনরে তাঁকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নৈমিত্তিক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়, যেহুতু তিনি তাঁর জনগণকে নিয়ে তাদের অঞ্চলগুলির কাছাকাছি বসতি স্থাপন করে।

   তিনি তাঁর পিতা কায়া আল্পের স্থলাভিষিক্ত হন। ইউফ্রেটিসে ডুবে তাঁর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পরে, পুত্রকে এরতুগ্রাল কায়ি প্রধান হিসেবে হতে দেখা যায়।

এরতুগ্রাল গাজী (মৃ. ১২৮১)

পিতার মৃত্যুর পর, এরতুগ্রাল তাঁর অন্যান্য উত্তরাধিকারী ভাইদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কায়ি উপজাতির বেগ হিসেবে আখ্যায়িত হন।[3] তিনি তাঁর সমর্থকদের সাথে আরও পশ্চিমে আনাতোলিয়ার দিকে আগ্রাসন হন।  এখানে তিনি প্রায় শেষ রুমি সেলজুক সালতানাতের সঙ্গে যুক্ত হন।  

   ক্ষমতাসীন বাইজেন্টাইন এবং বিরোধী মোকাবিলাকারী উপজাতিদের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জনে সেলজুকের সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ প্রথম (রাজত্ব ১২২০–১২৩৭) সন্তুষ্ট হয়ে এরতুগ্রালকে শাসনের জন্য সোগুতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খ্রিস্টান ভূমি বুর্সার কাছে একটি বিশেষ প্রদেশ প্রদান করেন।

   স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অবিরাম চেষ্টার পর, এরতুগ্রাল ১২৮১-এর মধ্যে  সোগুতে মারা যান। অতঃপর তাঁর পুত্র ওসমান প্রথম স্থলাভিষিক্ত হন এবং পিতার স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে সাকার দেন।

অন্যান্য উপকরণ

এটা স্পষ্ট যে ত্রয়োদশ শতাব্দীর সেই সময়কালে, বিশেষ করে আনাতোলিয়ার অঞ্চলে সেরকম কোন শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না। এমনকি সেলজুকের রুম সালতানাত (রাজত্ব ১০৭৭–১৩০৮) বিভিন্ন বিভক্তির কারণে একটি ভঙ্গুর রাজ্যে পরিণত হয়ে পরে। অবশেষে, ১৩১০-এর দশকের দিকে মঙ্গোল আক্রমণে সালতানাত সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায়।

   একটি রাষ্ট্র তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং কৌশলগত সেনাপতিত্বের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে। কায়ি উপজাতির সেই সময়ের একটি সুনির্মিত সেনাবাহিনী। তাছাড়া উদ্বর্তন এবং আশ্রয়ের জন্য গোত্রপ্রধানের নেতৃত্বে যে কোনও জায়গায় পর্যায়নের জন্যও তারা প্রস্তুত থাকতো। এক ঐতিহাসিক মতে, সামরিক লড়াকু তুরগুত আল্প (মৃ. ১৩৩৪) যিনি এরতুগ্রাল, উসমান প্রথম এবং ওরখানের জন্য অবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছিলেন মহান যোদ্ধা ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন।

 সর্বোপরি, যেহেতু তারা কনস্টান্টিনোপলে কেন্দ্রীভূত প্রতিবেশী বাইজেন্টাইন শক্তির পাশে বসতি স্থাপন করেছিল, তুর্কিদের মাঝে মাঝে সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়। এই ক্ষেত্রে, তারা সমসাময়িক বিভিন্ন তুর্ক বে, তাদের সৈন্য ও গাজীদের সমর্থন পেয়ে সঙ্গবদ্ধ হয়ে নামে ও অস্তিত্বের লড়ায়ে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে। অনুরূপ ক্রমবর্ধমান ঘটনা তাদের নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।

প্রোটো-ইম্পেরিয়াল যুগ

প্রথম উসমান (১২৯৯) থেকে মুহম্মদ দ্বিতীয়ের (মৃ . ১৪৮১) শাসনের ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়টিকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রোটো-ইম্পেরিয়াল (Proto-Imperial) বা প্রাক-সাম্রাজ্যিক যুগ বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে আনাতোলিয়া থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা, বলকান এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রায়ই অঞ্চল জুড়ে উসমানীয় সম্রাজ্য আধিপত্য প্রাপ্ত করে তাদের নিজস্ব প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

   ২৫০ বছরেরও বেশি সময়ের এই সময়ে, সাতজন শাসক তাদের সমস্ত শক্তি এবং কৌশল দিয়ে রাজবংশকে শক্তিশালী করে তোলেন। এদের আমলে উসমানীয় সম্রাজ্য একটি ছোট রাজত্ব থেকে সেই সময়ের এক সর্বশ্রেষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হয়। তারা হলেন উসমান, প্রথম ওরহান (রাজত্ব ১৩২৬ ‒ ১৩৬২), প্রথম মুরাদ (রাজত্ব ১৩৬২ – ১৩৮৯), বায়েজিদ প্রথম বায়েজীদ (রাজত্ব ১৩৮৯ ‒ ১৪০৩), প্রথম মুহাম্মদ (রাজত্ব ১৪১৩ –  ১৪২১), দ্বিতীয় মুরাদ (রাজত্ব ১৪২১ –  ১৪৪৪) এবং মুহাম্মাদ ফাতিহ (রাজত্ব ১৪৪৪ - ১৪৪৬, ১৪৫১ - ১৪৮১)।

  বায়েজিদের মৃত্যুর পরের দশকে আমির তৈমুরের (রাজত্ব ১৩৬৯ –  ১৪০৫) বন্দীদশায় এই সাম্রাজ্য বাইজেন্টাইন ও মঙ্গোলদের কাছে ক্ষমতা হারালে এক বিরাট হতাশা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। ১৪০২/৩  থেকে ১৪১৩ সালের মধ্যে বিশৃঙ্খলার এই সময়কালটি ইতিহাসে অটোমান ইন্টারেগনাম (Ottoman Interregnum) বা উসমানীয় অন্তবর্তীকাল নামে পরিচিত।

   আঞ্চলিক সম্প্রসারণ, শাসন ও প্রশাসনিক নীতিতে তাদের নির্দিষ্ট অবদান এবং জড়িত থাকার সাথে প্রোটো-সাম্রাজ্যকালের শাসকরা মৌলিক ভূমিকা রাখেন। তাদের নিয়ে আলোচনা অন্য লিখনিতে হোক। 

[1] অন্যান্য কিছু ঐতিহাসিক সূত্র ভিন্ন বংশের বর্ণনা দেয় যেখানে গুন্দুজ আল্পকে এরতুগ্রালের পিতা হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।

[2] সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত আছে। সম্পূর্ণ পতন হয়েছিল লোজান চুক্তির (Treaty of Lausanne, জুলাই ২৪, ১৯২৩) অনুসরণে, যার পর মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র উত্তরসূরি হিসাবে আবির্ভূত হয়।

[3] পদবি বেগ বা বে (Bey) হচ্ছে তুর্কি-মঙ্গোল গোত্রপ্রধানদের

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter